বিভিন্ন কারণে দেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ ব্যথা ও প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত কিন্তু এই সমস্যাগুলোর প্রধান চিকিৎসা ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের মূল্যায়ন এবং উন্নয়ন একটি স্বার্থান্বেষী মহল এর বাঁধায় অর্ধশতাব্দী ধরে আটকে আছে।
স্বাধীনতা উত্তর মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং ব্যথা ও প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত জনমানুষের সুস্বাস্থ্য বিবেচনায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান এর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি বিভাগে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ব্যাপক ভাবে শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টিতে ফিজিওথেরাপি বিষয়ে শুরু হওয়া স্নাতক ডিগ্রী কোর্সটি পঙ্গু হাস্পাতালে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছে। উল্লেখ্য ১৯৬০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হলেও বর্তমানে একটি স্বার্থান্বেষী মহল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে প্রতিষ্ঠিত ফিজিওথেরাপি বিভাগ সমূহের এর নাম নিশানা মুছে ফেলেছে। অন্যদিকে এই মহলের বাঁধায় অর্ধশতাব্দী পার হলেও ফিজিওথেরাপি কলেজ, কাউন্সিল ও পদ সৃষ্টি হয় নাই। তাই দেশের মানুষ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । এর মধ্যেই প্রতিবছর পালিত হচ্ছে বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস। “ কোভিড ১৯ পরবর্তী সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবনে ফিরতে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ভুমিকাই মুখ্য” প্রতিপাদ্য নিয়ে বাংলাদেশ ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) উদ্যোগে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা, ফ্রি চিকিৎসাসহ সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি নিয়ে দিনটি পালন করছে।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা যায়, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি ব্যথায় আক্রান্ত। বিশ্বব্যাপী ব্যথার চিকিৎসায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে। আর এই রকম ব্যথায় আক্রান্ত ৪৯ শতাংশ মানুষকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে, অর্থাৎ বাধ্য হয়ে কাজে অংশ নিতে হচ্ছে। ব্যথা, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বার্ধক্যজনিত সমস্যা, স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, সেরিব্রাল পালসি, অটিজম, মেরুদন্ডে আঘাত, সড়ক দুর্ঘটনা, ক্যান্সার, অবেসিটি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ নানাবিধ অসংক্রামক রোগ জনিত কারণে বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেক বড় একটি অংশ আংশিক বা পুরোপুরি প্রতিবন্ধিতায় ভুগছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ব্যথায় ও প্রতিবন্ধি ভুক্তভোগীদের ৮০ শতাংশই সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না। চিকিৎসা মানেই ওষুধ নয়, আর ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক। যেমন ২০১৬ সালে শুধু আমেরিকাতে অতিরিক্ত ওষুধ সেবনে ৬৩ হাজার ৬৩২ জনের মৃত্যু হয় বলে একটি গবেষণায় বলা হয়েছে। এই ধরনের সমস্যায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাই উত্তম সমাধান ও প্রমাণিত পদ্ধতি এবং এ ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকেরাই প্রধান স্বাস্থ্য পেশাজীবী। এ রকম পরিস্থিতিতে ফিজিওথেরাপির ব্যাপক প্রসার খুব জরুরি। মেডিকেল সায়েন্সের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হিসেবে ফিজিওথেরাপি এখন ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা বিদ্যা হিসেবে অনেক জনপ্রিয়। ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে অনেক রোগ সারানোসহ ক্রীড়াঘাত, ওমেন্স হেলথ, কারডিও রেস্পিরেটরি হেলথ, বার্ন, ক্যান্সার, মানসিক হেলথে ফিজিওথেরাপির ভুমিকা অনেক এবং ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে সুস্থ ও সচল জীবনযাপনের সুযোগ আছে। আর এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারেন একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক ।
বাংলাদেশে ব্যথা ও প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত লাখ লাখ রোগী থাকলেও এদের সংখ্যা ও চিকিৎসা বিষয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। ব্যথা ও প্রতিবন্ধিতায় ফিজিওথেরাপি প্রধান চিকিৎসা হলেও বাংলাদেশে এই আধুনিক ও যুগোপযোগী ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতিকে অর্ধশতাব্দী ধরে প্রতিষ্ঠিত হতে না দেওয়ার কারণে এ দেশে রোগীরা একদিকে যেমন কষ্ট পাচ্ছেন, অন্যদিকে অক্ষম বা কম কর্মক্ষম জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে তারা নিজের কাছে, পরিবারের কাছে, সমাজ ও রাস্ট্রের কাছে বড় বোঝা হয়ে অবহেলিত হচ্ছে। দেশে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ ও কর্মক্ষম করা না গেলে টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি) অর্জনে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অথচ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা ও পরিসংখ্যান মতে ব্যথা ও প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্তদেরকে যথাসময়ে সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে পুরাপুরি কিংবা আংশিক সুস্থ ও কর্মক্ষম করার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখছে।
ফিজিওথেরাপি বিষয় পড়ানোর জন্য একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা গত ২৬ বছরেও সফল হয়নি। অনেক বছর ধরে ফিজিওথেরাপি শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের দাবী ও আন্দোলনের ফলে রাজধানীর মহাখালীতে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিওথেরাপি প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার ৫.২৮ একর জমি বরাদ্দ করে ২০০৮ সালে। ২০০৯ সালে ২ মাসব্যপি টানা আন্দোলনে সরকার ২০০৯ সালে কলেজের জমি থেকে বস্তি উচ্ছেদ করে সেখানে ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেই সব উদ্যোগ থেমে গেছে। ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা দূরের কথা, ওই জমিতে নতুন করে গড়ে উঠেছে প্রায় দুই হাজার অবৈধ বস্তিঘর। রাজনৈতিক প্রভাবশালী কিছু লোক ওই সব বস্তিঘর ভাড়া দিয়ে মাসে মাসে টাকা তোলে। সেখানে মাদকদ্রব্যের ব্যবসাও চলে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
কলেজের জন্য নির্ধারিত জমি থেকে অবৈধ বস্তিঘরগুলো তুলে দেওয়ার উদ্যোগ সরকার নেয়নি। একপর্যায়ে বস্তিবাসীর পক্ষে আদালতে রিট করেন এক ব্যক্তি। কিন্তু আদালত রিটের নিষ্পত্তি করে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন: সরকারের অধিগ্রহণ করা জমিতে আবেদনকারীর থাকার আইনগত অধিকার নেই। ২০১৩ সালের জুন মাসে হাইকোর্ট রিট আবেদনকারীসহ অবৈধ দখলদারদের দুই মাসের সময় দিয়ে ফিজিওথেরাপি কলেজের জন্য জমি ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। হাইকোর্ট একই রায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কলেজ ভবন নির্মাণে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু হাইকোর্টের সেই নির্দেশ আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
বাংলাদেশ ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যাসোসিয়েশন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক বছর থেকে দেন দরবার করে আসছে এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে পর্যন্ত ধরনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে এ বছরের ২৮ মার্চ ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়ে বলা হয়, মহাখালীতে ফিজিওথেরাপি কলেজের ভবন নির্মাণ এবং ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের জন্য সরকারিভাবে ফিজিওথেরাপি পদ সৃষ্টির প্রস্তাবনার ব্যাপারে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু তার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তাই ব্যথা ও প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত দেশের প্রায় ২ কোটি মানুষের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা অধিকার প্রতিষ্ঠায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি ও নির্দেশনা জরুরি ।
ডা. দলিলুর রহমান, সভাপতি, বাংলাদেশ ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)