‘বাবা তো আমাদের কোন খোঁজ রাখেন না। সারাদিন তো বাইরেই থাকেন। তার কাছে তো অফিস আর কাজই সব। আমি কি চাই সেটা তো তার জানার কোন প্রয়োজনই নেই।’ এমন অভিযোগটা ছিল নবম শ্রেণীর রাসেলের।
বাবার উপরে তার ভীষণ রাগ আর অভিমান। গাল ফুলিয়ে মুখ গোমড়া করে এই কথাগুলো বলার সময় রাসেলের চোখ দুটো কি একটু ছলছল করছিল? করছিল হয়তো! কারণ যার উপরে রাসেলের এতো রাগ, যাকে নিয়ে রাসেলের এতো অভিযোগ, তাকে যে রাসেল খুব বেশী ভালোবাসে!
সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা বিদ্যমান থাকার বিষয়টি অনেকটা অক্সিজেনের মতো। মায়া, মমতা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা নিয়ে গড়ে ওঠে একটি সম্পর্ক। বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের, সহোদরের সাথে সহোদরের, আত্মীয়তা, বন্ধুর সাথে বন্ধুর সম্পর্ক ও প্রিয় মানুষটার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক।
একটি সম্পর্কের কোন বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি- এমন প্রশ্ন আসলে অবশ্যই বলতে হবে, যেকোন সম্পর্কের মাঝে ভালোবাসাবোধ বিদ্যমান থাকা অন্যতম জরুরি। তবে ভালোবাসার চাইতেও বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ’।
শ্রদ্ধাবোধ একটি সম্পর্ককে দীর্ঘস্থায়ী হতে এবং সম্পর্কের ভিত শক্ত করতে কাজ করে। কিছু ক্ষেত্রে সম্পর্কের সূচনা ভালোবাসা থেকে হলেও, সেই সম্পর্কটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে শ্রদ্ধাবোধ। বলা যেতে পারে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হলো একটি সম্পর্কের নৌকার পাল, যা সেই সম্পর্কটিকে সময়ের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যায়।
একজন ব্যক্তির জীবনে প্রতিটি সম্পর্ক আলাদা আলাদাভাবে গুরুত্ব বহন করে, প্রতিটি সম্পর্কই সেক্ষেত্রে মূল্যবান। নিজের পরিবার থেকে শুরু করে বন্ধু কিংবা সহপাঠী, সহকর্মী থেকে বাসের অর্ধপরিচিত কিংবা অপরিচিত সহযাত্রী- প্রতিটি ভিন্ন ধারা ও ভিন্ন মাত্রার সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা জরুরি।
প্রশ্নটা ছিল, সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কতটা জরুরি, কতটা গুরুত্ব বহন করে এই বিষয়টি! এখানে রাসেলের কথাটি আবারো নিয়ে আসা যাক। বাবার প্রতি তার ভালোবাসার কমতি নেই। কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসতেই পারে, কতটা শ্রদ্ধা করে রাসেল তার বাবাকে?
দিনরাত তিনি পরিশ্রম করে আয় করছেন নিজের পরিবারের মানুষগুলোকে ভালো রাখার জন্য। নিজের সন্তানকে সকল সুযোগ সুবিধা দেওয়ার জন্য, তার সকল আবদার পূরণের জন্য। রাসেল কি সেটা বুঝতে পারছে? এক্ষেত্রে ভালোবাসার সাথে প্রয়োজন শ্রদ্ধাবোধের, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের।
আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেসম্পর্কের মাঝে শ্রদ্ধাবোধের গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারি না। যার ফলে অনেক সময় বড় ধরনের ভুল করি, ভুল মানুষ নির্বাচন করি নিজের বন্ধু কিংবা সঙ্গী হিসেবে।নিজের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার উপরে যার নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে যে মানুষটিকে আমরা ভালোবেসে নির্বাচন করি, তাদেরকে আমরা কতটা শ্রদ্ধা করি? কতটা তাদের দিক থেকে শ্রদ্ধা পেয়ে থাকি আমরা? ‘আমি ওকে অনেক ভালোবাসি’ কিংবা ‘ও আমাকে অনেক ভালোবাসে’।
এতটুকুই যে একটি সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি বুঝতে অনেক দেরী হয়ে যায় আমাদের।
স্কুল শিক্ষিকা নীলা। বিবাহিত জীবনের ৪ বছর পার করে ফেলেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রেমের সম্পর্কটির হাসিখুশি পরিণয়, কেন যেন এখন ঠিক আগের মতো নেই। কিছু কথা থাকে যা কারোর কাছে বলা যায় না। বলতে চাইলেও বুঝিয়ে বলা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিমর্ষ হয়ে ছোটবোনের কাছে আফসোসের সুরে শুধু একটি কথাই বলেছিলেন নীলা, ‘আমি জানি ও আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমাকে ছাড়া ও কিছুই বোঝে না। কিন্তু কেন যেন আমার প্রতি ওর কোন শ্রদ্ধাবোধ নেই।
আমি ঠিকভাবে বোঝাতে পারব না। কিন্তু আমি বুঝতে পারি, ওর আচরণে খুব স্পষ্ট এই ব্যাপারটা। আচ্ছা, শুধু ভালোবাসাটুকুই কি তাহলে যথেষ্ট নয়?’
নীলার ভেতরে আজ যে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, এই একই প্রশ্ন হয়তো অনেক মনে ভেতরই ঘুরপাক খায় বা খাচ্ছে। ‘সম্পর্কের মধ্যে শুধু ভালোবাসা কি যথেষ্ট নয়?’ গুরুগম্ভীর এই প্রশ্নটিরউত্তর কিন্তু খুব সহজ। প্রয়োজন শুধু ব্যাপারটি অনুধাবন করা।