শুধু পরিচ্ছন্নতার বিষয়েই নয়, কোন জিনিস ময়লা হচ্ছে কিনা, ঘরের কোন জিনিসটি কোথায় কীভাবে রাখা আছে কিংবা কেউ ব্যথা পেল কিনা- এমন ধরনের বিষয়ে অকারণেই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করেন। যারা এমন আচরণ প্রকাশ করেন তাদের প্রতি প্রায়শ আমরা বিরক্ত হই। এমন আচরণের প্রকাশ বেশি দেখা দিলে রেগেও যাই। অহেতুক কেন কেউ এমন অদ্ভুত আচরণ করবে- এমন ভাবনা কাজ করে। অথচ আমরা জানিই না এটা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা।
OCD (Obsessive-compulsive disorder) হলো এই মানসিক সমস্যাটির নাম। এর ফলে ভুক্তভোগী একই বিষয় নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করেন এবং সে কাজটি বারবার করার তাড়না বোধ করেন নিজের মাঝে।
ওসিডি কিন্তু দাঁতে নখ কাটার মতো কোন সাধারণ বা প্রচলিত বদভ্যাস নয়। এটা বেশ গুরুতর ধরনের মানসিক সমস্যা। যা চাকরি, পড়ালেখা, সম্পর্ক, পারিবারিক ক্ষেত্র এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের উপরেও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে ওসিডি আক্রান্ত ব্যক্তির কাজকর্ম ও চিন্তাভাবনা তার নিজের নিয়ন্ত্রণের একদম বাইরে চলে যায়।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- কোন অপরিষ্কার জিনিস হাতে নেওয়ার পর সাধারণত আমরা সাবান দিয়ে একবার ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেবো। কিন্তু ওসিডি আক্রান্ত ব্যক্তি কিছুক্ষণ পরপর সাবান দিয়ে হাত ধুতেই থাকবে। সেটা ৬-৭ বারও হতে পারে। কারণ তার মাথা ও মনের মধ্যে অনবরত কাজ করতে থাকে যে হাতে এখনও ময়লা রয়ে গেছে। ফলে হাত পরিষ্কার করতে হবে। এই প্রবণতাই হলো ওসিডি।
বেশিরভাগ ওসিডি আক্রান্ত ব্যক্তিরাই জানেন যে তাদের কাজকর্ম ও আচরণগুলোর কোন মানেই হয় না। এমন নয় যে তারা এ ধরনের আচরণ করতে পছন্দ করেন। কিন্তু এটা অনেকটা ভাঙা রেকর্ডের মতো মাথার ভেতরে কাজ করতেই থাকে, ফলে একই কাজ বারবার করতে বাধ্য হন তারা। একজন ওডিসি আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে সাধারণ নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো প্রকট আকারে দেখা যায়।
১. অপরিষ্কার হওয়া ও জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়।
২. ব্যথা পাওয়া কিংবা অন্যের ব্যথা পাওয়ার আশঙ্কায় ভীত থাকা।
৩. যেকোন জিনিস একদম সঠিক স্থানে সঠিকভাবে রাখার প্রবণতা।
৪. নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যা ও রঙ ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’- এই ধারনা বিশ্বাস করা।
৫. অনবরত চোখের পলক ফেলা, বারবার বড় করে নিঃশ্বাস নেওয়া এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের অনুভূতি অনুভূত হওয়া।
৬. সঙ্গীকে অকারণে ও ভিত্তিহীন কারণ প্রবল সন্দেহ করা।
৭. একধারে কিছুক্ষণ সময়ের মাঝে বারবার হাত ধোওয়া।
৮. কোন একটি কাজ একইভাবে পরপর কয়েকবার করা অথবা নিজের ধারনা মতো ‘ভালো’ সংখ্যক বার করা।
৯. দরজার লক, ফ্যান-লাইটের সুইচ, পানির কল, গ্যাসের লাইন অন-অফ আছে কিনা বারবার চেক করা।
১০. যেকোন জিনিসই গোনা। সিঁড়ির ধাপ, জামার কাপড়ে বৃত্তের সংখ্যা, শেলফে প্লেটের সংখ্যা।
১১. একই জিনিস একইভাবে সারিবদ্ধভাবে রাখা।
১২. অন্য বাসার দরজার হাতলা ধরা, পাবলিক বাস বা যানবাহন ব্যবহার, পাবলিক টয়লেট ব্যবহার ভয় কাজ করা এবং ভয় থেকে ক্ষেত্র বিশেষে হাত কাঁপার মতো সমস্যা তৈরি হওয়া।
এখনও পর্যন্ত চিকিৎসকেরা নিশ্চিতভাবে জানাতে পারেনি কেন ওসিডির সমস্যাটি দেখা দেয়। তবে তারা এটা নিশ্চিত করেছেন, ওসিডি আক্রান্ত হওয়ার ফলে মস্তিষ্কের কিছু অংশ একজন সাধারণ মানুষের চাইতে ভিন্ন হয়। এই সমস্যাটি সাধারণত পুরুষদের চাইতে নারীদের মাঝে বেশি দেখা যায় এবং মাঝে মাঝে কিশোরকাল থেকেই অনেকের এই সমস্যাটির লক্ষণ দেখা দেওয়া শুরু হয়। ধারনা করা হয় ওসিডির সাথে জিনগত সম্পর্ক আছে। তবে চারটি ক্ষেত্রে ওসিডি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
১. বাবা-মা, ভাই-বোন বা পরিবারের কারোর ওসিডির সমস্যা থাকলে।
২. বিষণ্ণতা, মানসিক চাপ থেকে।
৩. কোন বড় ধরনের ট্রমা থেকে।
৪. অল্প বয়সে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে।
একদম সরল বাক্যে বলতে হয় ওসিডি আরোগ্যে কোন চিকিৎসা নেই। কিন্তু সঠিক ওষুধ সেবন, দিকনির্দেশনা পালন ও টক থেরাপিসহ অন্যান্য থেরাপির সাহায্যে এই রোগের প্রবণতাকে অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।
আরও পড়ুন: ফোবিয়া: ভীতি যেখানে গ্রাস করে সবকিছু