ভালুকায় বনের মাটি কেটেই দখল হচ্ছে বনের জমি

ঢাকা, জাতীয়

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 15:16:49

ভালুকা (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে: দখলে পর্যদুস্ত ভালুকা বনের আরেক অশান্তির নাম মাটি কেটে তুলে নেওয়া। বনের শত শত একর জমির মাটি কেটে পুকুর বানিয়ে ফেলা হয়েছে। শুষ্ক মৌসুম এলেই শুরু হয় মাটি কাটার মহোৎসব।

এই প্রক্রিয়ায় বনের ঝোপঝাড় ও ছোট চারাগাছে ঢাকা জমিই বেশি পছন্দ মাটি খেকোদের। অনেক সময় ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি থেকে মাটি কাটা শুরু করে আশপাশের বনের ছোট ছোট টিলাগুলো কেটে সাবাড় করে দেওয়া হয়। আর এই মাটি দিয়েই হয়তো বনের আরেকপ্রান্তে দখল করে নিয়েছে বাউন্ডারি শহীদের নেতৃত্বে রাঘব বোয়ালরা।

সিট (CEAT) টায়ার, ওরিয়ন ও এনভয় গ্রুপের মতো অনেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান কোনো কিছুই করেনি, শুধু বনের জায়গা দখল করে বাউন্ডারি দিয়ে রেখেছে। এই তালিকায় রয়েছে বীকন ও বাদশা গ্রুপসহ আরও অনেকে। শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ায় বন বিভাগের লোকেদের মধ্যে অস্বস্তি বাড়ছে।

অস্বস্তি শব্দটি হয়তো সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। পুলিশ প্রশাসনসহ বন বিভাগের অনেকে একে আয়ের বাড়তি পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তারা এই মাটি কারবারিদের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। এতে করে উজাড় হয়ে যাচ্ছে বনের জীব বৈচিত্র্য।

এখানে বলে নেওয়া আবশ্যক যে, এই অঞ্চলে কাকরবালিসহ এঁটেল মাটি শাল বাগানের জন্য খুবই উপযোগি। আর শাল বাগান সৃজন করার প্রয়োজন হয় না যদি আশাপাশে শালের বাগান থাকে। শিমুল বীজের মতো শালও বাতাসে ভেসে দূরে গিয়ে বংশ বিস্তার করতে পারে। আর শেকড় থেকেই নতুন গাছ জন্মায়।

কোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও বাদশা টেক্সটাইল বিশাল সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে নিয়েছে বনের জায়গা, ছবি: বার্তা২৪.কম

ভালুকা রেঞ্জের এসিএফ তবিবুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, শালের ফল বিশেষ রকম হয়ে থাকে। এগুলো পোক্ত হয়ে ঝরে পড়ার সময় বীচের সঙ্গে ফুলের শুকনো পাপড়ি থাকায় বাতাসে ভাসতে থাকে। আর বাতাসের মাধ্যমে অনেকদূর পর্যরন্ত ছড়িয়ে যায়। আর এটা মাটির স্পর্শে এসে গাছ জন্মায়। অর্থাৎ শালবাগানের কাছাকাছি পরিত্যক্ত জমি থাকলে সেখানে স্বয়ংক্রিভাবে শাল বন তৈরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি।

এই মাটা কাটার শীর্ষে রয়েছে যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান মনির। প্রত্যেক বছরেই সে মাটিন কারবার করে। আর তার আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে মাটির কারবার। হবিরবাড়ি ইউনিয়ন যুবলীগের এই নেতার ভয়ে বন বিভাগের লোকজন তটস্থ। তার হাতে অনেক বনের কর্মী অপদস্ত হয়েছে।

যে কারণে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই প্রক্রিয়ায় অনেকে ভয়ে মুখ খুলতে সাহস দেখাননি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাতের আঁধারে ভেকু লাগিয়ে মাটি কাটা হয়। বিশাল বিস্তৃত অঞ্চল এবং গহীন বন হওয়ায় অনেক সময় খোঁজ পেতে পেতে কাজই শেষ হয়ে যায়।

আবার খোঁজ পেলেও রাতে সেখানে যেতে সাহস দেখায় না নিরস্ত্র বন কর্মীরা। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশকে ফোন করলে অনেক সময় লোকবল সংকটের কথা বলে সময় ক্ষেপন করে তারা। ভালুকা রেঞ্জের গহীণে গেলে মাটি কেটে নেওয়ার এমন অসংখ্য চিহ্ন দেখা গেছে। আবার ভেকু ও মাটির ট্রাক আটকের মামলাও চলমান রয়েছে অনেকের নামে।

মাটির শীর্ষ কারবারি হচ্ছে মনির। আরও অর্ধশতাধিক মাটির কারবারি রয়েছে। এর মধ্যে আলম (টুপি আলম) নুরুদ্দিন, আব্দুল মুন্সি, নুর হোসেন, মজিবর রহমান, আক্কাস আলী, মফিজ উদ্দিন, কবীর হোসেন, পান কামাল , শফি ও নুরুল হক অন্যতম। এদের অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা চলমান। কিন্তু তারপরও তারা দমবার পাত্র নয়। বছর বছর ধরে একই কর্ম করে যাচ্ছেন নির্বিঘ্নে।

ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা মনিরের বিরুদ্ধে জমি দখল ও মাটি কাটার অপরাধে ২৯টি মামলা দায়ের করেছে বন বিভাগ। তারপরও তার মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি বলে মনে করছে বন বিভাগ।

যুবলীগ নেতা মুনিরুজ্জামান মনির বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি মাটির ব্যবসা করি এ কথা ঠিক। কিন্তু বনের কোনো জমি থেকে মাটি নেইনি। আমি ব্যক্তি মালিকানার জমির মাটি কিনে ভেকু দিয়ে কেটেছি। আমি একটু ‘উইট্টা’ (উন্নতি করছি) যাচ্ছি তাই মানুষের নজর পড়েছে। তারাই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

বন বিভাগের লোকজন মনে করে, দেশ থেকে মাদক নিমূর্লে যেভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; বনের জমি রক্ষায় তেমন উদ্যোগ প্রয়োজন। না হলে মল্লিকবাড়ি বিটের মতো পুরো ভালুকা রেঞ্জ হারিয়ে যেতে পারে।

সরকার সুফল প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর লক্ষ্য হলো- শালকে আবার ফিরিয়ে আনা। এ জন্য বিশাল বাজেট করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে শালের শেকড় যদি খুড়ে তুলে ফেলা হয় তাহলে সফল হওয়া কঠিন। সুফল প্রকল্পের সুফল পেতে হলে বনের মাটি কাটা বন্ধ করা খুবই জরুরি বলে মনে করে পরিবেশবিদরা। কারণ শাল শেকড় থেকে জন্ম নেয়, এর শেকড় অনেকদূর পর্যেন্ত বিস্তৃত।

ময়মনসিংহ বন বিভাগের ভালুকা রেঞ্জের মল্লিকবাড়ি বন বিটের ১ হাজার ৫৯৯ একর জমি পুরোটাই জবরদখল হয়ে গেছে। হবিরবাড়ি বিটের প্রায় ৭ হাজার ১০ একর জমির মধ্যে ৪ হাজার ১৪৪ একর জমি, কাদিগড় বিটের ৪ হাজার ৬৮৬ একর জমির মধ্যে ৩ হাজার ৬০ একর জমি অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে গেছে। এই বিটের পাড়াগাঁও মৌজায় বন বিভাগের জমি ছিলো ১ হাজার ৬৪৬ একর ৭২ শতক। এক শতকও আর বন বিভাগের দখলে নেই। প্রতিনিয়ত নানা ছুঁতোয় দখল করে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা।

আরও পড়ুন:

** বন বিভাগের আতঙ্ক কে এই মনির!

*
* ১৫৯৯ একর জমির মালিক মল্লিকবাড়ি বন বিট নিজেই ভূমিহীন

** বনের জমি দখলের খেলার নাম ‘ডিমার্কেশন’

** কে এই বাউন্ডারি শহীদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর