বাকলিয়া চরে বর্জ্য শোধনাগার: কর্ণফুলীকে এগিয়ে দেবে মৃত্যুর দিকে!

, জাতীয়

রেদ্ওয়ান আহমদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম | 2024-05-22 19:36:14

১৯৩০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কারণে শাহ আমানত সেতু থেকে আনুমানিক দেড় কিলোমিটার উজানে কর্ণফুলী নদীর মাঝখানে ধীরে ধীরে একটি চর জেগে ওঠে। যার নাম বাকলিয়া চর। কর্ণফুলী নদীতে জেগে ওঠা এই চরে গত বছরের অক্টোবরে বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর বাস্তবায়ন করবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এজন্য চসিকের অনুকূলে খাসজমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে। যা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে চট্টগ্রামের সচেতন মানুষের মনে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চরটির পশ্চিম দক্ষিণ পাশে কিছুটা খনন করেছে। চরটির মোট আয়তন প্রায় ১০৫ একর বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তবে, বর্তমানে চরটি সরকারি এক নম্বর খাস খতিয়ানে নদী শ্রেণির জমি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকদের দাবি, জেলার বোয়ালখালী উপজেলাধীন চর বাকলিয়া মৌজার ৩৫ একর জমিতে বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা দেশের বৃহত্তম বন্দরকে ঘিরে থাকা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড খ্যাত কর্ণফুলী নদীকে ধ্বংস করে দেবে। তাদের মতে, চট্টগ্রাম নগরের বর্জ্য শোধনাগারের প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, কিন্তু যে জায়গায় এটি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেটি মোটেও পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব এবং চট্টগ্রামবান্ধব হবে না।

তাদের দাবি, এই নদীর মোহনার কাছেই চট্টগ্রাম বন্দর। এজন্য কর্ণফুলী নদীকে দেশের প্রাণপ্রবাহও বলা হয়ে থাকে। বর্জ্য শোধনাগার স্থাপিত হলে এই প্রাণপ্রবাহ থেমে যাবে। দেশে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। পরিবেশ ধ্বংস হবে। জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। কর্ণফুলীর দুই তীরে বিস্তীর্ণ জনপদের জনজীবনে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।

এ কারণে পরিকল্পনাটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরা। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক এমন স্থাপনা নির্মাণ পরিকল্পনা বাতিলের জন্য যে কোনো কঠিন আন্দোলনে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে ‘কর্ণফুলী রক্ষায় জনগণের প্রতিবাদ মঞ্চ’।

চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম, চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র, আরএসকে ফাউন্ডেশন, কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশন মিলে ছয়টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত এই মোর্চা যেখানে এই স্থাপনা গড়ার পরিকল্পনা চলছে, সেই কর্ণফুলীর চরে গিয়ে সমাবেশ এবং সংবাদ সম্মেলনও করেছে।

এছাড়াও আজ বুধবার (২২ মে) এক সংবাদ সম্মেলন করে তারা বলেছেন, নদীর মাঝখানে বর্জ্য শোধনাগার হলে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। সেখানে ভূমি নিরীক্ষার কাজ করছে চীন দেশের একটি প্রকৌশলী কোম্পানি।

কর্ণফুলী রক্ষায় জনগণের প্রতিবাদ মঞ্চের নেতারা বলেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্টের রায়ে আমাদের দেশের নদীগুলোকেও জীবন্ত সত্তা, জুরিসটিক পারসন বা লিগ্যাল পারসন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে মানুষের মতো নদীর মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। হাইকোর্টের এই আদেশ অনুযায়ী নদীর মাঝখানে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প করা অবৈধ এবং আদালতের আদেশের লঙ্ঘন, সুতরাং এই প্রকল্প হতে পারে না।

ম্যাপে বাকলিয়া চর

তারা আরও বলেন, আমাদের সংবিধানেও উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। তার মানে জলাভূমি অর্থাৎ নদীর নিরাপত্তা বিধান সংবিধানস্বীকৃত এবং সেটি করতে হবে স্বয়ং রাষ্ট্রকে।’ আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করার সময় নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করেন। তারা রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে নদীর অধিকার রক্ষা করবে। কিন্তু বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প নদীর অধিকারকে হত্যা করবে।

প্রতিবাদ মঞ্চের নেতারা জানান, দেশের সংবিধান অনুযায়ী নদীর মাঝখানে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প থেকে সরে আসতে হবে। তা না হলে এটি আইনবিরুদ্ধ কাজ হবে।

কর্ণফুলী নদীর প্রাণপ্রকৃতি, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও দূষণ নিয়ে বন্দরনগর ভিত্তিক পরিবেশ সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়ন (ইসিএইচও) ২০২২ সালে এক গবেষণা চালায়। তাতে দেখা গেছে, কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী ৮১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। দূষণ রোধে কোনো ব্যবস্থা না নিলে আরও ৬১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে পড়বে। ৫৩টি শিল্পসহ ৮৯টি উৎস থেকে কর্ণফুলী নদী দূষিত হচ্ছে। গবেষণায় কর্ণফুলী নদীর তীরে ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। যার কারণে জনগণের প্রতিবাদ মঞ্চের নেতারা ঝুঁকিতে থাকা ৮১ প্রজাতির দেশীয় উদ্ভিদ সংগ্রহ করে সেগুলোর চারা চরে লাগানোর দাবি জানান। তাতে কর্ণফুলী নদী প্রাণ ফিরে পাবে বলে তারা মনে করেন।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিনোদনের তেমন কোনো স্থান নেই। পৃথিবীতে অনেক দেশে নদী বা সাগরের মাঝখানের চরে নান্দনিক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। সেগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। চর বাকলিয়ায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি ইকোট্যুরিস্ট স্পট গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।

তারা দাবি জানান, আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই প্রকল্প বাকলিয়া চর থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে হবে। অন্যথায় তারা সিটি করপোরেশন ঘেরাওসহ উচ্চ আদালতে নির্দেশ অমান্য করাসহ সংশ্লিষ্ট আইনে প্রতিকার প্রার্থনা করে রিট দায়ের করা হবে বলেও জানিয়েছেন।

কর্ণফুলী নদী গবেষক প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘নদী ভরাট হয়ে জেগে ওঠা দ্বীপ এমনিতেই কর্ণফুলীকে দুই ভাগ করেছে। উন্নয়নের নাম দিয়ে এই চর বা দ্বীপে বিষাক্ত বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনা আত্মঘাতী। এটি কর্ণফুলীকে হত্যা করবে। চসিক মেয়রকে এই কাজ করার কুপরামর্শ যারা দিয়েছে তারা দেশের শত্রু। বীর মুক্তিযোদ্ধারা আধুনিক প্রজন্মকে নিয়ে এই অন্যায় প্রতিহত করবে।’

প্রতিবাদ মঞ্চের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘জনগণের দাবি মেনে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প স্থাপন বন্ধ করুন। প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা, যুবসমাজ, সাম্পান মাঝিরা লাঠি বইঠা নিয়ে মেয়রের কার্যালয় ঘেরাও করবে। দেশকে ধ্বংস করে কার স্বার্থে কীসের এই প্রকল্প?’

এদিকে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের দাবি, বাকলিয়া চরে চসিকের বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন প্রকল্পটি আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করেই করা হবে। এর বর্জ্য নদীতে পড়বে না।

এ বিষয়ে বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, ‘আমরা যতোটুকু জানি, এই প্রকল্পটা হবে গ্রিন ফ্যাসিলিটিসের মধ্যে। এখানে পরিবেশ দূষণের খুব বেশি কিছু থাকবে না। এরপরও বিষয়টা ভূমি মন্ত্রণালয় দেখছে, এখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে পরিবেশের জন্য এটি কোন প্রকার ক্ষতি হবে কিনা। পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকেও এটার ওপরে একটা এনওসি পাওয়া গেছে। তবুও, বিষয়টা নিয়ে আরও অনেক স্টাডি হবে, গবেষণা হবে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। কেননা, এটা তো অনেক বড় একটি প্রকল্প। প্রায় ৬-৭ হাজার কোটি টাকার। সুতরাং কিছু করার আগে অবশ্যই ভালো করে যাচাই বাছাই হবে।’

কোন বিকল্প জায়গা আছে কিনা প্রশ্নের জবাবে চসিকের এই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘না, প্রকল্পটা বাস্তবায়নের জন্য চট্টগ্রামে তেমন কোন বিকল্প জায়গা নেই। কেননা, আমাদের বর্জ্য শোধনাগার করতে প্রায় ৩৫ একর জায়গা লাগবে। আর ওখানে একসাথে প্রায় ৩৫ একর জমিই পাওয়া যাবে। যেটা চট্টগ্রামে আর কোথায় পাওয়া যাচ্ছে না। যার কারণে, ওখানে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর