ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও নৌকার মাঝি মনির!

, জাতীয়

রাজু আহম্মেদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম | 2024-05-24 04:52:54

জীবন নামক শব্দে আছে অনেক উত্থান-পতন। দুঃখ-কষ্ট, আশা-হতাশা যার নিত্যসঙ্গী। তবু জীবন নৌকায় বসে বৈঠা হাতে পাড়ি দিতে হয় অকূল দরিয়া। আর জীবনের উত্থান পতনের করুণ পরিণতি মেনে নিয়ে, বাস্তব জীবনে নৌকার বৈঠা হাতেই বুড়িগঙ্গার ঘাটে কাটছে তার দিন রাত। ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে চলছে জীবন। তবে জীবনের সূত্রগুলোর সাথে এমন করুণ সমীকরণ মেলাতে পারেন না মনির।

স্বপ্নগুলো ভেঙে গেছে জীবন নদীর আছড়ে পড়া বড় বড় ঢেউয়ে। সেই ঢেউয়ের প্রভাবে পেয়েছেন ধোঁকা, লাঞ্ছনা, আর হতাশা। তাই তো জীবন বাঁচাতে দেশের সব থেকে বড় বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও আজ সদরঘাটের মাঝি হয়েছেন মনির। মা, বউ ও একমাত্র মেয়ের মুখে ভাত তুলে দিতে নদীর ঢেউয়ের সাথে প্রতিদিন যুদ্ধ করছেন এ যুবক।

তবে জীবনের এমন করুণ পরিণতি না হলেও পারত আক্ষেপ মনিরের। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সহজিকরণ ও চাকরি ব্যবস্থায় দুর্নীতি না থাকলে আজ হয়ত নৌকার বৈঠা বাইতে হতো না এমন অভিযোগ মনিরের।

নৌকার বৈঠা হাতেই বুড়িগঙ্গার ঘাটে কাটছে তার দিন রাত

কেন এমন অভিযোগ মনিরের?

কারণ জানতে চাইতেই আক্ষেপের সুরে মনির বলেন, বাবা ছিলেন কৃষক। নুন আনতে পান্তা ফুরাতো পরিবারে। ছোটবেলা থেকে বাবার সাথে কাজ করতাম। তবে বুক ভরা স্বপ্ন ছিল। পড়ালেখা করে ভালো চাকরি করব। পরিবারের হাল ধরব। তবে সে স্বপ্নের পথে বার বার বাধা এনেছে অভাব অনটন আর আর্থিক দৈন্য। তবুও সব প্রতিকূলতাকে পিছনে ফেলে এইচএসসি পাস করি ৪ দশমিক ৫৬ জিপিএ পেয়ে। স্বপ্ন দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। শিক্ষক ও আশেপাশের মানুষজন বলত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই নাকি জীবনে আর পিছনে তাকাতে হয় না। চাকরি মেলে। স্বপ্নের জীবন পাওয়া যায়। সে স্বপ্ন বুকে লালন করে সুযোগ পাই ভর্তির। তবে টাকার অভাবে ভর্তির সুযোগ কাজে আসছিল না। বাবা একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে আমাকে ভর্তি করিয়েছিলেন স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মনির বলেন, ভর্তির পর ৫-৬ মাস আমার রাস্তায় কেটেছে। ঢাকার কিছু চিনতাম না। আর সবার মতো আমার টাকাও ছিল না। অনেক চেষ্টা করেছি হলে একটা সিটের জন্য। স্যারদের বললে বড় ভাইদের সাথে যোগাযোগ করতে বলত। চেষ্টা করেও পাইনি স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট। ক্লাস বাধ্যতামূলক থাকায় রাতে ইটভাটায় কাজ নিয়েছিলাম। তবে কাজ করে দিনে ক্লাস করতে পারতাম না। এভাবেই থমকে গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সুযোগ। পরে ২০১৪ সালে বরিশালের বিএম কলেজ থেকে ডিগ্রি শেষ করে প্রায় ২০০ চাকরিতে আবেদন করি। ইন্টারভিউ দিয়েছি প্রায় ৪০টা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তবে বার বার উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি পাইনি।

রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে নৌকায় মানুষ পারাপার করছেন মনির

প্রতিটা সেক্টরে হয়ত টাকা, নয়তো মামা-চাচা না থাকায় চাকরি বঞ্চিত হয়েছি আমি। বাবা মারা যাওয়ার পর কোন দিশা না পেয়ে আমি পরিবার বাঁচাতে হাতে তুলে নিই নৌকার বৈঠা।

মনিরের গ্রামের বাড়ি বরিশালের বানারিপাড়া উপজেলার বিসারকান্দি গ্রামে। সেখানে তার তিন বছরের মেয়ে, বউ ও মা থাকেন। বাবার মৃত্যুর পর তাদের মুখে দুবেলা ভাত তুলে দিতে দিনরাত পড়ে থাকেন বুড়িগঙ্গার ঘাটে। দিন শেষে আয় হয় ৩০০-৪০০ টাকা, তা দিয়ে নিজের খরচ শেষে পাঠান গ্রামে।

আর্থিক দৈন্যের জীবনে কিছুটা স্বস্তি আনতে ছোটবেলা থেকে সমাজের সাথে যুদ্ধ করেছেন মনির। তবে সমাজের ব্যতিক্রম নিয়মের কাছে হারতে হয়েছে বারবার। সফলতার পথে বহুদূর পাড়ি দিয়েও ফিরে এসে এখন মনিরের আক্ষেপ বাংলাদেশের পড়ালেখা গরিবের জন্য নয়!

এ সম্পর্কিত আরও খবর