মরার আগে মায়ের মুখটা দেখতে চাই

ময়মনসিংহ, জাতীয়

রাকিবুল ইসলাম রাকিব, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ), বার্তা২৪.কম | 2023-08-28 12:34:53

‘তহন আমার বয়স তের কি চৌদ্দ। অভাবের লেইগ্যা প্রতিবন্ধী ইশকুলের লেহাপড়া ছাইড়্যা বাড়িত আইয়্যা পড়লাম। কিন্তু আমি অন্ধ বইল্যা বাড়ির পোলাপাইন কেউ আমার লগে মিশতো না, কথা কইতো না। হেরলেইগ্যা একলা একলা বাড়িত বইয়্যা গান গাইতাম। একদিন বাড়ির সামনের এক দোকানে বইয়্যা ওস্তাদ শাহ আলম সরকারের বিচ্ছেদি একটা গান ধরলাম। হেই গান হুইন্যা মানুষজন আমারে খুশি হইয়্যা-টেকা পয়সা দিলো। বাড়িত আইলে মা টেকা গুইন্যা কইলো ৬শ টেকা অইছেরে জুয়েল। হেই থেইক্যা গান গাওয়া ধরলাম। অহন তো বারো বৎস্যর ধইর‌্যা এই গান গাইয়া পেট চালাইতাছি।’

বার্তা২৪.কমের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী গানের শিল্পী মো. জুয়েল (২৬)। তার বাড়ি ময়মনসিংহ সদর থানার সিরতা ইউনিয়নের চর আনন্দীপুর গ্রামে। তিন ভাইয়ের মধ্যে জুয়েল দ্বিতীয়।

গতকাল শনিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী জুয়েলের দেখা মিলে গৌরীপুর পৌর শহরের ধানমহাল এলাকায়। সেখানকার সড়কের পাশে বসে তিনি প্লাস্টিকের একটি গ্যালনে লাঠির টুকরো দিয়ে আঘাত করে ছন্দ তুলে গান গাইছেন। গানের ফাঁকে ফাঁকে চাইলেন নিজের জন্য একটু সহযোগিতা। শ্রোতারাও তার ডাকে সারা দিয়ে যে যার মতো ৫ থেকে ১০ টাকা করে দিয়ে সাহায্য করলো তাকে।

গান শেষ হলে কিছুক্ষণ কথা হয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী জুয়েলের সঙ্গে। কথায় কথায় জমে উঠে গল্প। বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, ‘ছোট বেলায় আমার অসুখ হইছিল। তহন গেরামের এক ডাক্তারের ওষুধ খাওনের পর আমার মাথা ফুইল্যা যায়, আস্তে আস্তে আমার চোখের পাওয়ারও কইম্যা যাইতে থাহে। অহন বাম চোখে ঝাপসা দেখলেও, ডান চোখে কিছুই দেহিনা। মায়ের লগে থাকলেও জানি না তার মুখটা কেমুন। খালি স্বপ্নে দেহি মায়ের মুখটা।’

জুয়েলের বাবা মারা গেছে অনেক বছর আগে। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই রনি ঢাকায় ভ্যান চালায়। ছোট ভাই তুহিন রংমিস্ত্রির কাজ করে। আর মাকে নিয়ে জুয়েল একা বাড়িতেই থাকে। টাঙ্গাইল জেলার একটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুলে কয়েক বছর পড়াশোনা করেছেন জুয়েল। সেখান থেকে তিনি নিজের নাম, পরিচয় ও ঠিকানা লেখা শিখেছেন। তবে গান আয়ত্ত করেছেন তিনি মোবাইলে শুনে শুনেই।

প্রতিদিন সকাল হলে বাড়ি থেকে বের হন জুয়েল। এরপর স্থানীয় হাটবাজারে ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বাউল ও ফোক ঘরানার বিভিন্ন গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন তিনি। গান শুনে শ্রোতারা খুশি হয়ে যা দেয় তা থেকে দিন শেষে তার আয় ৪ থেকে ৫শ টাকা। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ভাতাও পান তিনি। এই টাকা দিয়েই মাকে নিয়ে অভাব-অনটনে সংসার চালান তিনি।

জুয়েলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা নেমেছে। সড়কে জ্বলে উঠেছে নগর বাতি। এমন সময় কয়েকজন শ্রোতা জুয়েলের গান শুনে তাকে সামান্য কিছু টাকা দেন। তাদেরই একজন জুয়েলকে বলেন, ‘বাউল তো তুমি ভালোই গাও, তয় চোখ ভালা থাকলে তো তুমি গাইয়া আরও নাম কামাইতে পারতা।’

কথার রেশ টেনে জুয়েল বলেন, ‘নাম কামানির আমার দরকার নাই। অন্ধ বইল্যা বাবার মরা মুখটা কেমুন দেহি নাই। খালি লাশের সামনে বইয়্যা কানছি। তয় মরার আগে নিজ চোখে মায়ের মুখটা দেখতে চাই। কিন্তু আমার তো এতো টেকা-পয়সা নাই যে চিকিৎসা কইর‌্যা অন্ধ চোখ ভালা করমু।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর