৯৯৯-এ কল, পুলিশ ঠেকাল ১৭৬ আত্মহত্যা

ঢাকা, জাতীয়

শাহরিয়ার হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-31 18:12:16

১০ ফেব্রুয়ারি, রাত সাড়ে ১২টা। জাতীয় জরুরি সেবা সেন্টার অর্থাৎ ৯৯৯-এ ফোন কল। কলার বরিশালের উজিরপুরের নওশীন আফরোজ। নওশীন নিজের সমস্যায় নয়, ভাইয়ের জন্য ফোন করেছেন।

কলার নওশীন জানালেন, ‘তার ভাই নওশাদ হাসান হিমু (২৮) মোহাম্মদপুরের চন্দ্রিমা হাউসিংয়ে অবস্থান করছেন। তাকে ফোন করে জানিয়েছেন, সে আর মানসিক চাপ নিতে পারছেনা, সে আত্মহত্যা করবে। তাকে যেন ক্ষমা করে দেই।’

সেই মুহূর্তে কোনো উপায় না পেয়ে ৯৯৯-কল করে ভাইকে বাঁচানোর জন্য জরুরি পুলিশি সহায়তা চাইলেন। তাৎক্ষণিক জরুরি সেবা থেকে নওশীনকে মোহাম্মদপুর থানার ডিউটি অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হলো। এরপর মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইউসুফ আলী ঘটনাস্থলে রওনা দেন।

পরবর্তীতে এসআই ৯৯৯-সেবাকে জানান, আত্মহত্যার চেষ্টাকারী হিমুকে তার ফ্ল্যাট থেকে বুঝিয়ে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। এরপর পরবর্তী পদক্ষেপ। তার কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং তার অভিভাবকদের খবর দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় জরুরি সেবা সেন্টার ৯৯৯-এ এমন ঘটনা এখন নিয়মিত। গত ৯ মাসে ১৭৬ জনকে আত্মহত্যার চেষ্টা থেকে বের করে আনা হয়। এরমধ্যে কাউকে কাউকে বুঝিয়ে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আবার কারও প্রয়োজন পড়ে কাউন্সেলিংয়ের। 

জাতীয় জরুরি সেবা বিভাগের পুলিশসুপার মো. তবারক উল্লাহ বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ‘৯৯৯ যেহেতু জাতীয় জরুরি সেবা দানে কাজ করে, সেক্ষেত্রে সব ধরনের কল আমাদের এখানে আসে। আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে এমন ফোন কোনো কোনো দিন একাধিকবার পেয়ে থাকি। তবে গত ৯ মাসে ৯৯৯-এ কলের মাধ্যমে ১৭৬ জনের প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয় পুলিশ।’

মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বজুড়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন (আইএএসপি)। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘লেটস ওয়ার্কটুগেদার ফর প্রিভেন্ট সুইসাইড’ বা ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করি একসঙ্গে’।

এদিকে, দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। পুলিশ সদর দফতর ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, ২০১৮সালে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। যা গড়ে প্রতিদিন দাঁড়ায় ৩১ জন। ২০১৭ সালেও ১১ হাজার ৯৫ জনের আত্মহত্যার তথ্য দেয় পুলিশ সদর দফতর।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পরীক্ষা ও প্রেমে ব্যর্থতা, বেকারত্ব, অস্থিরতা, মাদকাসক্তিসহ নানাকারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জানা গেছে, পৃথিবীতে যত মানুষ আত্মহত্যা করেছে তার মধ্যে ২ দশমিক ৬ শতাংশ বাংলাদেশি। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রতি লাখে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ এভাবে নিজের জীবন নিজেই বিলিয়ে দিচ্ছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশর অবস্থান বিশ্বে দশম। আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে। বয়সের কারণে তারা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ। মানসিক আঘাত পেলে যুক্তির চেয়ে বেশি আবেগতাড়িত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন তারা।

জানতে চাইলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, ‘আত্মহত্যার ঘটনা যে হারে বাড়ছে তাতে পারিবারিক সচেতনতা জরুরি। তা না হলে এই সংখ্যা বেড়েই চলবে।তিনি বলেন, পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা, প্রেমে ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক ক্ষতি, মা-বাবার ওপর অভিমান এবং মানসিক চাপে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা যাদের কম তারাই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। তাদের ঝুঁকি কমাতে পরিবারের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের বিকল্প নেই।’  

প্রায় একই কথা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর আনোয়ার হোসেন। তিনি বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ‘যারা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, তারা একদিনের সিদ্ধান্তে জীবন নিয়ে এমন ঝুঁকি নেয় না। তাদের মস্তিষ্কে অনেক দিন ধরে এই সব বিষয় ঘোরাফেরা করে।’

এই সমাজবিজ্ঞানী আরও বলেন, ‘আমি মনে করি পরিবেশই মানুষের মস্তিষ্কের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। আমাদের এই জায়গা থেকে বের হতে হলে, সুস্থ ও মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেককেই তার আবেগ প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। তাহলেই আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর