বেফাকের সিনিয়র কয়েকজন দায়িত্বশীলের ফোনালাপ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার প্রেক্ষিতে কয়েকজনকে বহিস্কার করা হয়েছে। তবে দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি বোর্ডের সিনিয়র দায়িত্বশীলদের অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে বহু আগ থেকেই। ২০১৯ সালের কেন্দ্রীয় পরীক্ষার সময় প্রথমবারের মতো প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। চল্লিশ বছরের বেশি বয়সী প্রতিষ্ঠানটি দোষীদের চিহ্নিত করতে পারলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়। এরই মাঝে, সিনিয়র দায়িত্বশীলদের ফোনালাপের ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। এতে কওমি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খান।
আরও পড়ুন:
কওমি অঙ্গনে ক্ষোভ দানা বাঁধছে ধীরে ধীরে
অনিয়মই নিয়ম বেফাকে, মানা হয় না গঠনতন্ত্র!
বার্তা২৪.কম-এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, এর আগেও বেফাকে বেশ বড়সড় অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোকে নানা কারণে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। বেফাকের কর্মরত দায়িত্বশীলরা বলছেন, তখন ওইসব অনিয়মের সুরাহা হলে, আজকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না।
ভুয়া চিঠি ছড়ানো হয় মাওলানা মাহফুজুল হকের নামে
ফোনালাপ ফাঁস নিয়ে তোলপাড়ের মধ্যেই সম্প্রতি বেফাকের সহকারী মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হকের বিরুদ্ধে ৭ লাখ টাকা দুর্নীতির বিষয়ে একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হলে তা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বেফাকের মরহুম মহাসচিব আবদুল জব্বার স্বাক্ষরিত ২০১৬ সালের একটি ‘ইত্তেলা’ চিঠিতে দাবি করা হয়, নারী নীতি আন্দোলনের খরচ বাবদ বেফাকের সাধারণ তহবিল থেকে মাওলানা মাহফুজুল হক অগ্রিম ৭ লাখ টাকা নিলেও তার কোনো ভাউচার জমা দেননি। অবশ্য সেটিকে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও অপপ্রচার হিসেবে দাবি করে ১১ জুলাই বিবৃতি দিয়েছেন বেফাকের মহাপরিচালক অধ্যাপক মাওলানা জোবায়ের আহমদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এ জাতীয় কোনো ‘ইত্তেলা’ পত্র কখনও বেফাক অফিস থেকে ইস্যু করা হয়নি। এটা সম্পূর্ণ ভুয়া ও বানোয়াট।
এদিকে মাওলানা আবু ইউসুফের সঙ্গে বেফাক মহাসচিবের ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর বেফাকের পক্ষ থেকে এগুলো মিথ্যা বলে বিবৃতি দিতে বেফাকের মহাপরিচালক মাওলানা জোবায়েরকে চাপাচাপি করেন মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দস। কিন্তু তিনি বিবৃতি দিতে অসম্মতি জানান বলে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন।
বেফাকের নিজস্ব তদন্ত কমিটিতেও প্রমাণিত হয় অনিয়ম
২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মনীতি না মেনে ভবন নির্মাণে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়, মিডিয়া ও প্রশিক্ষণ খরচের নামে বেতন-ভাতা পরিশোধসহ নানা ধরনের অনিয়মের বিষয় উঠে আসে আট আলেমের সমন্বয়ে গড়া কমিটির তদন্তে। পরপর তিন অর্থবছরের আর্থিক হিসাবের অডিট না করানোর প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত তদন্ত কমিটি প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অনিয়ম তদন্ত করে। এসময় বোর্ডের কয়েকটি আর্থিক অনিয়ম ধরা পড়ে। ওই তদন্ত কমিটিতে ছিলেন- মাওলানা সাজেদুর রহমান, মাওলানা ছফিউল্লাহ, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা মাহজুফুল হক, মাওলানা নূরুল আমীন, মাওলানা মুনীরুজ্জামান, মাওলানা দিলাওয়ার হোসাইন এবং মাওলানা ইসহাক।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন মজলিসে আমেলার বৈঠকে জমা দেওয়া হলেও উল্লেখ করার মতো কোনো শাস্তি কাউকে পেতে হয়নি। এতে তখন সমালোচনার মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। পরে অবশ্য নিম্নপদের কয়েকজনকে শাস্তি দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়।
ভবন নির্মাণে অনিয়ম
স্টিলের অস্থায়ী ভবন নির্মাণের আগে বেফাক কোনো প্রকৌশলী বা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেনি বলে অভিযোগ করা হয় প্রতিবেদনে। এজন্য ভবন নির্মাণে পাঁচ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এ ছাড়া ভবন নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়ার আগে নির্মাণ কমিটির বৈঠক করা হয়নি। সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে বেশি দরদাতাকে কাজ দেওয়া হয়, টিনসেড ঘর নির্মাণে মজলিসে আমেলার অনুমতি নেওয়া হয়নি এবং খরচের বিবরণীতে ঘরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ উল্লেখ করা হয়নি।
কাগজ ক্রয়ে অনিয়ম
পরীক্ষা বিভাগে কাগজ ক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। নিম্নমানের কাগজ কিনে বেশি দাম দেখানো হয়।
মিডিয়ার খরচের নামে অনিয়ম
জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে ১ সেপ্টেম্বর মানববন্ধন এবং ১৭ অক্টোবর বেফাক সভাপতি আল্লামা আহমদ শফীর উপস্থিতিতে রাজধানীর মিরপুরের আরজাবাদ মাদরাসায় উলামা-মাশায়েখ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে মানববন্ধনে মিডিয়া খরচ বাবদ ৫৬ হাজার ৯৮০ টাকা এবং সম্মেলনে মিডিয়া খরচ বাবদ এক লাখ ৩১ হাজার ৬৭০ টাকা দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া মহাসমাবেশের যাতায়াত বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে দুই লাখ ১৩ হাজার টাকা। যেটাকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করে তদন্ত কমিটি।
বেতন-ভাতা পরিশোধে অনিয়ম
বেফাকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওভারটাইম, ভাতা পরিশোধের ক্ষেত্রেও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী অগ্রিম বেতন ও ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করেননি। এসব ক্ষেত্রে মজলিসে আমেলার সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বেফাকের সাতজন কর্মকর্তা নিয়মিত ছুটি না নিয়ে অফিসে কাজ করেছেন এবং ছুটির ভাতা নিয়েছেন। তবে তাদের কাজ করার বিষয়ে কোনও কমিটির অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
ঋণে অনিয়ম
বেফাকের অনেক কর্মকর্তা ঋণ নিয়ে তা সময়মতো পরিশোধ করেননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে হাফেজ ইলিয়াস ৭২ হাজার ৮১ টাকা ঋণ নিয়ে মাত্র ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। আর মাওলানা ফয়জুর রহমান ৩২ হাজার ৪১০ টাকা ঋণ নেন। তবে তিনি মারা যাওয়ায় পরিবারের পক্ষ থেকে দায়মুক্তির আবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক হিসাবরক্ষক আবদুল মতিন ৯০ হাজার ৬৬৭ টাকা ঋণ নিলেও তা পরিশোধ করেননি।
প্রশিক্ষণ বাবদ খরচে অনিয়ম
মক্তব প্রশিক্ষক মাওলানা আবদুর রহিমের সব কাজ অগোছালো ও অনিয়মে ভরা। তার কাজের কোনও রেজিস্টার রাখা হয়নি। প্রশিক্ষণ বাবদ খরচ দেখানো হলেও তিনি প্রতিষ্ঠানের কোনও আয় দেখাতে পারেননি। তিনি নিজের ইচ্ছামতো সহকারী নিয়োগ দিতেন। তাদের বেতনও নিজে রেখে দিতেন। এক পর্যায়ে তদন্ত কমিটি হিসাব চাইলে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। এছাড়া তার কাছে বেফাকের সর্বশেষ ৩টি প্রশিক্ষণের আয়ের টাকা বকেয়া আছে।
এসব বিষয়ের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলে, বেফাক মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস ফোন রিসিভ করেননি। আর সহকারী মহাসচিব মাওলানা নুরুল আমিন ব্যস্ত বলে ফোন রেখে দেন।
আগামী পর্বে: ক্ষুব্ধ তরুণ আলেমরা, চান অভিযুক্তদের শাস্তি