নাগরিক পেশাজীবী স্বপ্ন তার.
সেই কবে মার বুক খালি করে ছেড়ে এসেছিলাম প্রাণের শহর যশোর।
মোচওয়ালা মামার ঘন জংগলে, ঝমঝমিয়ে নামা বৃষ্টির মধ্যে, পচা কাঁদামাটিতে খালি গা, খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে ভিজে চুপচুপে হওয়া, গোড়ালী থেকে হাঁটুর নিচে কটা জোঁক লেগে রক্ত চুষেছে তাও টের পাইনি বর্ষার ঘোরে! কালু মামার লম্বা সিঁড়ি বাঁধানো পুকুরে গুনে গুনে ৫ হাজার ডুব দিয়ে; চোখ যখন টকটকে লাল, শরীর পুড়ছে সারা দিনমান পানিতে ডুবানোর ফল জ্বরে; সন্ধ্যার আগে নানী সৈয়দা রহিমা হকের কড়া শাসনে গোসল-উৎসব ভঙ্গ।
মসজিদের মেঝে পরিচ্ছন্ন করেছি পরম মমতায়। মসজিদের মেঝের মোজাইকের উপরের আস্তর ঘষতে ঘষতে হাতের আস্তর উঠে রক্ত ঝরেছে। এইচআর সিল্কের রাজ্জাক মামা বলতেনঃ শাহীন (আমার ডাক নাম) আজান দিলে বেশ কিছু মুসল্লি বেশি দেখি, উনারা কি মানুষ না জিন!
একুশের ভোর রাতে ওয়াপদা বাগানের ফুল আনতে গিয়ে কুঁচকিতে (ইনার থাই) তারকাঁটা বিঁধে ঝুলে থেকেছি সকাল পর্যন্ত! সে আকুলতা তো ছিল সৌরভের জন্যই!
যশোর ইন্সটিটিউট লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাঠে মগ্ন থাকা; রবিবাসরীয় সাহিত্য আসর জমিয়ে রাখা; টাউন হল মাঠে আজীজুল হক স্যারকে ঘিরে বসে ছন্দের আলোচনায় রাত গভীর। বেশ দেরি করে বাড়ি ফেরা। রাতের গোপন পিকনিকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মোরগ সংগ্রহের থ্রিল...
তারপর সব ছেড়ে একদিন পা বাড়িয়েছিলাম পৃথিবীর পথে। ঢাকা, নিউ ইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, ঢাকা হয়ে দুবাই, আবার ঢাকা এবং আবার কয়েকবার নিউ ইয়র্ক; এভাবেই কেটে গেছে চার চারটি দশক! সময় কিভাবে নদীর মত বয়ে যায়!
এখন আর দূরের জীবন ভালো লাগেনা। মনে হয় ছুটে যাই কারবালা গোরস্তানে। মা শুয়ে আছেন সেখানে সেই ১৯৮৮ সাল থেকে। কিছুক্ষণ কাটাতে মন চায় মায়ের শিয়রে। নীরবে কথা বলতে ইচ্ছে করে মার সঙ্গে। সারাজীবন ঢাকা-যশোর করে শেষে চৌদ্দ পুরুষের ভিটে ক্ষেত্রপালায় গিয়েই চিরবিশ্রামে গেছেন আব্বা, সেখানে যেতেও মন টানে।
ইচ্ছে করে জলকল-এর জোড়া দীঘির কাকচক্ষু জলে নেমে দাঁড়িয়ে থাকি কিশোর বেলার মত, দীর্ঘক্ষণ; সারাজীবনের দাহ ধুয়ে শীতল হোক দেহ-মন-প্রাণ! ঘন সবুজ শ্যাওলা-ধরা জলকল দীঘির চির রহস্যময় তলদেশের ভয় লাগা স্ফটিকস্বচ্ছ জলের আহ্বান যেন ডাকে ইদানীং ঘুমের ঘোরেও। ভোরের শিশির ভেজা ঘাসের গালিচা ডাকে পার্ক মাঠের বিস্তীর্ণ চরাচর। কাঁধে একগাদা বইখাতা নিয়ে ভোরের কুয়াশা ভেদ করে জেলা স্কুলের পথ ধরে হেঁটে যাই কিশোর আমি!
সম্প্রতি এক মোহন স্বপ্নে বিভোর হয়েছে মন। আল্লাহ হায়াৎ দান করলে এবং সুস্থ রাখলে ২০১৮'র শেষে কিংবা ২০১৯-এর শুরুর দিক থেকে মাত্র তিন/সাড়ে তিন ঘণ্টায় ধুলি ধুসরিত, ট্রাফিক জ্যামে মৃতপ্রায়, জনভার জর্জরিত ঢাকা থেকে প্রাণের শহর যশোরে পৌঁছতে পারবো! ইদানিং মাঝে মধ্যেই রাতের খাবার টেবিলে জীবনসঙ্গী নুসরাতের (Nusrat Jahan) সঙ্গে এই স্বপ্ন নিয়ে নানা ছবি আঁকি। কিভাবে সাজাবো সপ্তাহের কাজের দিনগুলো তা বলি স্ত্রীকে। আমার খুব ইচ্ছে-বৃহস্পতিবার বিকেলে বাক্স-পেটরা গুছিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেবো যশোরের পথে। হাইওয়ে টু হ্যাভেন! স্বপ্নের পদ্মা সেতু পার হয়ে মাত্র তিন/সাড়ে তিন ঘণ্টায় স্বপ্নশহর যশোর!
পরদিন, অর্থাৎ শুক্রবার বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার ইচ্ছে, যদিও যশোরে, বাড়িতে গেলে, যত রাতেই শুই না কেন, ঘুম ভাঙে খুব সকালে। জুম'য়া আদায় করতে যাবো শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিময় ওয়াপদা মসজিদে। একসময়ের তুখোড় ফুটবলার সাথী ভাই (Mashuk Sathi) মিষ্টি করে হেসে বলবেঃ আয় কাছে বস। শহীদ ভাই বুকে বুক মেলাতে মেলাতে কপট শ্লেষ মেশানো কণ্ঠ বলবে, কি আমাদের কথা মনে পড়ল? জুম'য়া শেষে কারবালা গিয়ে মা'র কবর যিয়ারা। বাসায় ফিরে দুপুরের খাবার। তার আগে, অনেক সাধ্যি-সাধনা করে সঙ্গে খানা খাবার জন্যে বাল্যবন্ধু বাবুকে (Shahid Babu) রাজী করানো। মহাব্যস্ত বাবু, যার নাম আমি দিয়েছি 'ওয়াক অ্যান্ড টক' বলে! বিকেলে চার খাম্বার মোড়ে নিজেদের প্রাসাদোপম বাড়ির সামনে বসে চায়ে চুমুকরত Pavel Choudhury ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে। কি রানা কখন এলে? এসো চা খাই, পাভেল ভাইয়ের আমন্ত্রণ থাকবে সাবলীল...
গত বেশ ক' বছর ধরে প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় ষষ্টিতলা পাড়ায় বাল্যবন্ধু ডা. বাবু'র বাড়ির নিচতলায় আড্ডার জমজমাট আসর বসায় স্কুলের বন্ধুরা। এ আড্ডায় যেতে মন আনচান করে! বাল্যবন্ধুদের প্রায় অশ্লীল খিস্তি-খেউড় শুনতে মন চায়; মনে হয় ওসব অশ্রাব্য ভাষার কথোপকথনই অমিয় বচন। শুক্রবার সন্ধ্যায় ডা. বাবু'র বাসার বৈঠকখানায় বসবে 'সেইরাম আড্ডা'। ভাত ঘুম দিয়ে, চেহারায় মান্জা মেরে একে একে আসবে সাদী, বাদল, লিমন, সাগর, খসরু, শাহীন, ডাবলু, প্রফেসর, বিডিআর, মাস্টার, লিটন, মোস্তসহ আরো কত বন্ধু। কবু ওর হাসপাতালে এমডির দায়িত্ব করে আসতে নির্ঘাত একটু দেরি করবে! চোখের পলকে কয়েক ঘন্টা কখন পার হয়ে যাবে তার কোনো হিসাব পাওয়া যাবে না। এর মধ্যেই প্রাণকন্যা আয়েশা আরিয়ানা (Ayesha Aariana) ওর মা'র ফোন থেকে কল করবে কয়েকবারঃ বাবা, এখনো আসছো না কেন! আল্লাহ করলে ততদিনে আরেক প্রাণকন্যা আলভীনা ফিওনা'রও (Aalveena Fiona) কল করা শিখে যাওয়ার কথা। সেও হয়তো কল করে বড় বোনের মত গুনগুন করবে বাসায় ফিরতে দেরি হবার অনুযোগে!
বাবু'র বাসার আড্ডা শেষে হোয়াইট প্যালেসে (The White Palace হোয়াইট প্যালেস আমাদের বাড়ীর নাম) ফিরে নামাজ সম্পন্ন করে রাতের খানা শেষ করতে না করতেই খোলা আকাশের নিচে দোতলার 'জোসনা-বৃষ্টি' নামের মার্বেল খচিত ওভারহেড লনে শুরু হয়ে যাবে গভীর রাতমুখী আড্ডার এক্সটেন্ডেড সেশন। রাত বেশ গভীর হলে, যখন আমরা ভাববো আজ রাতে হয়তোবা আর কেউ আসবে না; ঠিক তেমন সময়ে আমাদের অবাক করে গাড় পিংক পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে হাজির হবে আমাদের স্নেহভাজন সংসদ সদস্য Monir! ফল, মিষ্টি এসব তো ট্রলি ভরে আসবেই, সঙ্গে ওখান থেকেই ভেসে আসবে মনিরসহ আরও কয়েকজনের আব্দার মেশানো দাবি: 'ভাবী, পুদিনা চা লাগবে'। এভাবেই রাত ২/৩টায় গিয়ে ঠেকবে আমাদের প্রাণের কথার বারামখানা! কিন্তু এ কথামালা কি শেষ হবার? না মৃত্যুর আগে শেষ হবে কখনো!
শনিবার হোয়াইট প্যালেসের টুকিটাকি কাজ করিয়ে বিকেল বিকেল রওনা দেবো পোড়া জীবিকার শহর ঢাকার দিকে। মোহন এই স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব নিয়েছেন জেদী প্রধানমন্ত্রী, জাতিরজনক কন্যা শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংক নামক সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানটির ভুয়া অভিযোগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাষ্ট্রের নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ শুধু শুরুই করেননি, ইতোমধ্যে সে সেতুর ৫০ ভাগ কাজ শেষও হয়ে গেছে! সব কিছু অনকুল থাকলে ২০১৯-এ ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে জন্মশহর যশোর যেতে বা যশোর থেকে ঢাকা আসতে তিন/সাড়ে তিন ঘন্টার বেশি লাগার কথা না। ভাবা যায়!
তারপর...
তারপর আর কি? যতদিন ভালো লাগবে, শরীরে কুলোবে ততদিন ঢাকা-যশোর করবো। এমন এক সময় আসবে, যখন আর ঢাকা ফিরতে মন চাইবে না। একদিন যে শহরে জন্মেছিলাম, যে শহরের ১১ নম্বর স্মিথ রোডের বাড়ীর জমিনে পোতা আছে আমার নাড়ি, সেই শহর ছেড়ে আর ফিরবো না কোলাহলের হলাহল মেগাসিটি ঢাকায়। একদিন সেই ঘুঘু ডাকা, ফুলের সৌরভময় যশোরে ভূমিশয্যা নেবো, এ স্বপ্নই দেখি, পরম করুণাময় আল্লাহ যেন তা মাঞ্জুর করেন, আমিন...
সৈয়দ রানা মুস্তফী, সম্পাদক, অর্থকথা। জাতীয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব