এসে গেল পূজা
বাংলাদেশে যে প্রধান ধর্মীয় উৎসব বাঙালি সমাজের সবাইকেই স্পর্শ করে, তাহলো মুসলমানদের ঈদ আর হিন্দুদের পূজা। ধর্মীয় হলেও উৎসবগুলো সামাজিক-সর্বজনীন রূপ লাভ করে অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায়। বাংলাদেশের বাঙালি মাত্রই ঈদ বা পূজার আবহ সম্পর্কে অবহিত।
এই যে এখন শরতের প্রেক্ষাপটে হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা এসে গেছে, তার রূপ, গন্ধ, শব্দ, ছোঁয়া বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানের ছবিগুলোর সঙ্গে মিশে আছে শৈশবে দেখা অভিজ্ঞতা। দিনগুলো বদলে গেলেও উৎসব আর আনন্দের অভিজ্ঞতা তো থাকে অমলিন!
কখনো কখনো নিজের স্মৃতিযাপনে, বন্ধুর নস্টালজিক বিবরণে কিংবা সাহিত্যের পাতায় ভেসে আসে নিজস্ব অভিজ্ঞান। তখন চমকে ওঠি! যেমন চমক আছে বুদ্ধদেব গুহর 'হলুদ বসন্ত' গ্রন্থে। অনেক আগে পড়া বইটি। একাধিক বার পড়েছি। তবু বিশেষ একটি জায়গায় এলে প্রতিবারই চমকে ওঠি। পূজা এলেই 'হলুদ বসন্ত' গ্রন্থে বুদ্ধদেব গুহর দেয়া অসামান্য বর্ণনাটি বার বার মনে পড়ে:
"পুজো, পুজো, পুজো। এসে গেল পুজো। জানি, লাউড-স্পিকারের শব্দে প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে, লোকের ভিড়ে মাথা ধরবে। তবু, কেন জানি পুজো এলে ভালো লাগে।
বাঙালি বলে বোধহয়।
মনে প্রাণে পুরোপুরি বাঙালি বলে বোধহয়।
শম্পু সরকার বা রুশি বিয়ান্দকারের তো এমন মনে হয় না। ওরা সাহেব। পূজার ছুটিকেও ওরা অন্য যে কোনো ছুটি বলে মনে করে।
সকালে উঠে ওরা যথারীতি চান করবে, ব্রেকফাস্ট করবে, তারপর ড্রেইনপাইপ গলিয়ে কারুর বাড়িতে গিয়ে আড্ডায় বসবে, নয়তো ক্লাবে গিয়ে বিয়ার খাবে। চঞ্চল চন্দ হয়তো বারান্দায় পাজামা পড়ে বসে, নিউ স্টেটম্যানের ফিনফিনে পাতা খুলে নিজেকে যথেষ্ট কালচারড মনে করবে। যেন, পূজা তো কী? যেন পূজা কিছুই নয়।
আমি তা ভাবতে পারি না। মহালয়ার ভোরে, আধো-ঘুম-আধো-জাগরণে বালিশটা আঁকড়ে ধরে শুয়ে শুয়ে যখন মহিষাসুরবধের বর্ণনা শুনব রেডিয়োতে, যখন সেই শেষরাতে, সমস্ত পাড়া, সমস্ত কলকাতা শহর, সমস্ত বাংলাদেশ গমগম করবে এক শুদ্ধ, বিমুগ্ধ প্রভাতী বন্দনায়, তখন যে কী ভালো লাগবে সে কী বলব! শুধু আমার কেন? খাঁটি বাঙালি মাত্রেরই লাগবে। পূজা আসছে, ভালো লাগবে না?
তারপর মহালয়ার ভোর হবে। শরতের নীল আকাশে রোদ্দুর ঝিলিক দেবে। সকালে হয়তো রেডিয়োতে কণিকা ব্যানার্জির গান থাকবে - শরত-আলোর কমল বনে, বাহির হয়ে বিহার করে, যে ছিল মোর মনে মনে...শুনব। চুপ করে বসে কান পেতে শুনব; চোখ চেয়ে শরতের রোদ দেখব, নাক-ভোরে শিউলি ফুলের গন্ধ নেব; আর ভালো-লাগায় মরে যাব।
সেই পুজো এসে গেল।"
দিন আর পরিস্থিতি যতই বদলে যাক, উৎসব আসে চিরায়ত আবাহনে। শাশ্বত অবয়বে। ভালোবাসা ও কল্যাণের বার্তা হয়ে। বাঙালির ঘরে ঘরে। বিভেদ আর দূরত্বের দাগগুলো মুছে দিয়ে।
সবাইকে শুভেচ্ছা।