বিশ্বে সর্বাধিক নারী যে দেশের সংসদে
উর্বর-পার্বত্য ভূমির কারণে আফ্রিকা মহাদেশের এই রাষ্ট্রটিকে বলা হয় ‘হাজার পাহাড়ের দেশ’। বসবাসের দিক থেকে মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘনত্বপূর্ণ দেশটি। উপজাতি সংঘাতে বহুদিন রক্তাক্ত এবং ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল পুরো দেশের মাটি। বিশ্বের নজরও কেড়েছিল প্রচণ্ডভাবে সংঘাত কবলিত হওয়ার কারণে। সেই দেশেই এখন বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক নারী সাংসদ পার্লামেন্ট আলো করে রয়েছেন।
রুয়ান্ডা। দেশটির নাম শুনলেই মনে পড়ে মধ্য-নব্বই দশকে হুতু আর তুসতি উপজাতির মধ্যকার ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গা ও দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের কথা। আফ্রিকা মহাদেশের পূর্ব-মধ্যাংশের রাষ্ট্র রুয়ান্ডা রাজধানী কিগালি ছাড়া পুরোটাই ধ্বসে গিয়েছিল সংঘর্ষে। ৮০ লাখ জনসংখ্যার অধিকাংশই হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত।
ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠা দেশটি এখন পার্লামেন্টে নারী সংসদ সদস্যের সংখ্যার দিক থেকে গড়েছে বিশ্ব রেকর্ড। এমনকি, নিজের গড়া রেকর্ড ভেঙে তৈরি করেছে নারী জাগরণ ও ক্ষমতায়নের নতুন রেকর্ড।
পার্শ্ববর্তী কঙ্গোর মতোই ১৯৬২ সালে বেলজিয়ামের উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হয় রুয়ান্ডা। ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে যা হয়, সেখানেও তাই হলো। বিশ্বের অন্যান্য কুখ্যাত উপনিবেশিক শোষকের মতো বেলজিয়ামও দারিদ্র্য, অনিয়ম, সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গা, সংঘাত ইত্যাদির মধ্যে ফেলে দেয় রুয়ান্ডাকে, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৯৪ সালের গৃহযুদ্ধ ও জাতিগত দাঙ্গার মাধ্যমে।
ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মরতে থাকে। বাড়ি-ঘর পুড়তে থাকে। বিপণ্ন ও শরণার্থীতে ভরে যায় পাশের কঙ্গো, উগান্ডা, বুরুন্ডি ও তানজানিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্র। স্বপ্নের মতো দেশ রুয়ান্ডা ছারখার হয়ে যায় ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয়ে।
চরম দুর্যোগ ও মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে শেষে মাঠে নামে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী। বহুজাতিক সেই বাহিনীর শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সৈনিকরাও অংশ নেন রুয়ান্ডায়। বহু বছর পর সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তি ও স্থিতিশীলতা।
রুয়ান্ডায় এখন যে পার্লামেন্ট দেশ চালাচ্ছে, সেখানে নারীর অংশগ্রহণের বিশ্বরেকর্ড স্থাপিত হয়েছে। ৮০ সদস্য বিশিষ্ট রুয়ান্ডার সংসদের ৫৪জনই নারী। শতকরা হিসাবে যা ৬৭.৫০%।
বিশ্বের মধ্যে সংসদে নারীর অংশগ্রহণের সর্বাধিক হার ছিল ৬৪ শতাংশ, তা-ও রুয়ান্ডার অধিকারেই ছিল। ২০১৮ সালের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের ফলে সদস্য সদস্য হিসাবে নারীর অংশগ্রহণ ৬৭.৫০ শতাংশে উন্নীত করে রুয়ান্ডা নিজেই নিজের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়েছে।
প্রেসিডেন্ট কাগামের নেতৃত্বাধীন ‘আরপিএফ’-এর নিরঙ্কুশ বিজয়ের ফলে নারীর অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি পায়। রুয়ান্ডার ক্ষমতাসীন দল ‘আরপিএফ’কে বলা হয় বিশ্বে সর্বাধিক নারীর অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংগঠন। বিশ্বব্যাপী নারীর রাজনৈতিক উত্থানের অগ্রণী দেশ হিসাবেও ব্যাপক পরিচিতিও পেয়েছে রুয়ান্ডা।
রুয়ান্ডার রাজনীতি ও সংসদে নারীর অংশগ্রহণ অর্ধেকের চেয়ে বেশি হওয়াও বিশ্ব রেকর্ড। যদিও দেশটির মোট জনসংখ্যায় নারীর অংশ ৩৫ থেকে ৩৮ শতাংশ। তদুপরি সমাজে তাদের অংশগ্রহণ ও অগ্রসরতা অর্জিত হয়েছে স্বক্ষমতা ও ক্ষমতায়নের ভিত্তিতে। নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের আধিক্য তাদের নেতৃত্বের যোগ্যতার প্রমাণবহ। এইসব পরিসংখ্যাগত তথ্য দ্বারা এই সত্যও প্রমাণ হয় যে, সংঘাত থেকে শান্তিতে উপনীত হতে এবং স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন বজায় রাখার ক্ষেত্রে রাজনীতি, প্রশাসন ও নীতি নির্ধারণে নারী নেতৃত্ব অনেক বেশি সফল ও কার্যকরী। যা তারা জনগণের ভোটোর সমর্থনের দ্বারা প্রমাণ করেছেন।
রুয়ান্ডায় নারী নেতৃত্বের প্রতি জনগণের সমর্থন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে নারীদের টেকসই সাফল্য ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিও বিশ্ববাসীর সামনে উজ্জ্বল নজির হিসাবে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। অবহেলিত আফ্রিকার দাঙ্গাজনিত সীমাহীন সঙ্কটের পরেও রুয়ান্ডা স্থাপন করেছে আশাবাদী দৃষ্টান্ত।