উপমহাদেশে শীতের ভয়াল থাবা!
বাঘের থাবা হানছে শীত। উপমহাদেশ জুড়েই চলছে শীতের ভয়াল প্রকোপ। পুরো শীতকালটাই কাটবে শীতের তাণ্ডবে। আবহাওয়াবিদদের মতে, ‘শীত আরো বাড়বে। ভাঙবে অতীতের রেকর্ড।’ এ আশঙ্কা সত্য হয়েছে। ৫০ বছরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় কেঁপেছে শীতমগ্ন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের আবহাওয়ার রেকর্ডে গত ৫০ বছরে সবচেয়ে কম তাপমাত্রা ২.৬ সেলসিয়াস ছিল পঞ্চগড়ের সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়ায়। গত বছরে তা ছিল ৮.৫ ডিগ্রি। এক বছরে ৬ ডিগ্রি কমে তা অর্ধ শতকের রেকর্ড ভেঙেছে। ১৯৬৮ সালে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার রেকর্ড ৫০ বছর পর এবার
ভাঙলো।
আবহাওয়া বিষয়ক গবেষণা সংস্থাসমূহের নিজস্ব ওয়েব সাইটে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ‘পশ্চিমা ঝঞ্ঝার কারণে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে লাগাতার তুষারপাত হচ্ছে। শীতল উত্তুরের হাওয়ার-কুণ্ডুলী হিমালয়ের বরফ-তুষার প্রান্তর পেরিয়ে কনকনে হয়ে বয়ে আসছে দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে। আকাশ পরিষ্কার থাকায় রাতের ভূপৃষ্ঠও দ্রুত তাপ বিকিরণ করে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। ফলে সমগ্র উপমহাদেশেই পড়ছে শীতের ভয়াবহ প্রভাব।’
চলতি মৌসুমে হিমালয়ান অতি-শীতার্ত আবহাওয়ার জেরে দশ বছর পর বরফ পড়েছে বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা দার্জিলিং এবং পাশের পার্বত্য শহর কালিম্পঙে। বরফের বিঘ্নের কারণে সিকিমের পাকইয়ং বিমানবন্দর বন্ধ রয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু স্থানের তাপমাত্রা নেমে গেছে হিমাঙ্কের নিচে। দার্জিলিং-কালিম্পঙে তুষার-বরফের তীব্র ঝাপ্টা এসে লাগছে নিকটবর্তী উত্তরবঙ্গে। উত্তরবঙ্গের জনপদগুলোতে হু হু করে নামছে তাপমাত্রা। তেঁতুলিয়ায় রেকর্ড-ভাঙা শীতের কারণ এটাই।
আবহাওয়া বিষয়ক পরিসংখ্যানের হিসাবে গত পাঁচ বছরের মধ্যে গেল ডিসেম্বরে ছিল অতীতের রেকর্ড-ভাঙা শীত। জানুয়ারিতে আরো বাড়বে সে শীতের তীব্রতা। একাধিক শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কাও করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞগণ।
আবহাওয়া সংবাদের নিরিখে দেখা যাচ্ছে, উপমহাদেশের সর্বত্রই শীতের দাপট পরিলক্ষিত হচ্ছে। উত্তর-পূ্র্ব দার্জিলিঙের মতোই পশ্চিমের কাশ্মরীরেও অনেক বছর পর বরফ পড়েছে। সেখানকার তাপমাত্রা এখন হিমাঙ্কের প্রায় ৭ ডিগ্রি নিচে অবস্থান করছে। ভারতের রাজধানী দিল্লির তাপমাত্রা নেমে গেছে ২.৬ ডিগ্রিতে। বুধবার (২ জানুয়ারি) দিন শেষে বৃহস্পতিবারের (৩ জানুয়ারি) সূচনার সময় ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ১১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ঢাকার তাপমাত্রাও ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে গিয়েছিল।
আবহাওয়ার তত্ত্ব মতে, ১০ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা নেমে গেলে তাকে শৈত্য প্রবাহ বলা হয়। জানুয়ারি মাসে দেশে বেশ কয়েকটি শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, ‘বৈশ্বিক আবহাওয়া ক্রমেই চরম ভাবাপন্ন হচ্ছে। গরম যেমন সুতীব্র হচ্ছে, শীতও চরম আকার ধারণ করছে। এসবই ঘটছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞানের প্রফেসর ড. আবুল কাসেম বার্তা২৪কে জানান, ‘পৃথিবীর অধিকাংশ পর্বত শৃঙ্গ অগ্নিগিরির লাভাস্রোতে তৈরি হলেও হিমালয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। সেখানে দুটি প্লেটের মুখোমুখি টক্কর থেকে শৃঙ্গের সৃষ্টি। ফলে সেখানে হিমবাহ রয়েছে। আরো আছে শীতের প্রকোপ। বাংলাদেশসহ দক্ষিন এশিয়া হিমালয়ান রেঞ্জের প্রভাব বলয়ের অধীন। যদিও হিমালয় সুদূর উত্তরের সাইবেরিয়ান হিমপ্রবাহ আটকে দিচ্ছে, তথাপি শীতের ঝাপ্টা পুরো থামানো সম্ভব হয় না।’
বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, উষ্ণায়নের ফলে প্রতি বছরই হিমালয়ের বরফ স্তর গলে যাচ্ছে। সেখানে তৈরি হচ্ছে নানা ফাটল ও গর্ত। ফলে হিমপ্রবাহ ও শৈত্যবায়ু দক্ষিণের উপমহাদেশকে অনেকটাই বেশি আক্রান্ত করছে। যে কারণে প্রতি বছরই অস্বাভাবিক তীব্রতায় শীত এনে হানা দিচ্ছে বাংলাদেশসহ সমগ্র উপমহাদেশে।
শীতের সহনীয় আমেজের যে চিরায়ত চিত্র এ যাবতকাল বাংলাদেশ দেখে এসেছে, দিনে দিনে তা বদলে যাচ্ছে। তীব্র শৈত্যপ্রবাহের ভেজা কুয়াশা মেশানো শীত আচ্ছন্ন করছে দেশ। প্রতি বছরই বাড়ছে শীতের তীব্রতা। প্রতি বছরই সর্বনিম্ন শীতের রেকর্ড ভাঙছে একটু একটু করে। শীতের দাপট হামলে পড়ছে জীবন-যাপন, কৃষি-কর্ম, সংস্কৃতি ও জীবনাচরণে। বাড়ছে শীতকালীন রোগ-ব্যাধি। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষাবাদ। এ ধারা অব্যহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের শীত কুয়াশার হাল্কা প্রলেপ ছাড়িয়ে মাঝারি তুষার ও ভারি বরফের সঙ্গী হয়ে আসতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।