চট্টগ্রামের চেরাগি মোড়

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

চেরাগি মোড়ের নিঃসঙ্গ সড়কদ্বীপ, ছবি: বার্তা২৪ কম/ ছবি: বার্তা২৪

চেরাগি মোড়ের নিঃসঙ্গ সড়কদ্বীপ, ছবি: বার্তা২৪ কম/ ছবি: বার্তা২৪

প্রতিটি শহরের এক বা একাধিক আইকনিক স্পট থাকে। যে স্পট বা এলাকা দিয়ে শহরটিকে চেনা যায়। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অন্যতম প্রতীক হলো চেরাগি মোড়।

'চেরাগ' শব্দটি চট্টগ্রামের ইতিহাস ও নামকরণের সঙ্গে জড়িত। এলাকাটিরও রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও অবদান। ইতিহাস-পূর্ব ও ইতিহাসকালের অনেকগুলো অধ্যায় মিশে আছে চেরাগি মোড়ের ধুলো, বালি ও অস্তিত্বে।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম নগরীর তিনটি মূল সড়ক এসে মিশেছে এখানে। পশ্চিম প্রান্তের ডিসি হিল, বৌদ্ধ মন্দির, নন্দনকানন, লাভলেইন থেকে এসেছে একটি পথ। পূর্ব দিক দিয়ে আন্দরকিল্লা, লালদিঘী, রহমতগঞ্জ, চন্দনপুরা এলাকা ছুঁয়ে এসেছে আরেকটি পথ। উত্তর দিকের জামাল খান রোড হয়ে চকবাজার, আসকার দিঘী, কাজির দেউড়ি, লাল খান বাজার এলাকার যোগাযোগ সূত্র চেরাগি মোড়।

নগরীর নাভীমূল হয়ে পুরনো আর নতুন চট্টগ্রামের সেতুবন্ধ চেরাগি মোড়। তিন দিকে প্রসারিত তিনটি সড়কের ত্রিভুজে যেন নগরকে আগলে রেখেছে মোড়টি। পেছনে, দক্ষিণ দিকে পাহাড় শ্রেণি অনাদি কাল থেকে এলাকাটিকে দিয়েছে সুস্থির ও অবিচল উপস্থিতি।

বিজ্ঞাপন

একদার অল্প-স্বল্প পাহাড়ি ভূমিতলের চট্টগ্রাম দিনে দিনে অনেকটাই বদলে যাওয়ায় চেরাগির আশেপাশের ল্যান্ডস্কেপও আগের মতো নেই। অসংখ্য বহুতল ভবন আড়াল করেছে এলাকাটির ঢেউ খেলানো ভূমিরূপ আর অরণ্যময় নৈসর্গিক প্রকৃতি। সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে সাংস্কৃতিক পাটাতনও।

ঢাকায় যেমন শাহবাগ একদা সাহিত্যঘেঁষা চরিত্র নিয়ে বিরাজমান ছিল, চট্টগ্রামে চেরাগি মোড় ছিল তেমনি। কবি, শিল্পী, কবি-যশঃপ্রার্থীর ভিড়ে বাণিজ্যিক নগরীর লোলুপ থাবার বাইরে একখণ্ড আলাদা সবুজ দ্বীপের মতো। চেরাগি মোড় ছিল স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল, এখনো রয়ে গেছে সে ঐতিহ্যের খানিকটা ছাপ ও প্রভাব।

কবিতা, লিটলম্যাগ, আবৃতি ছিল যে এলাকা নৈমিত্তিক উপজীব্য, সেখানেও এখন পালাবদলের মাতাল হাওয়া। বিশ্বায়নের শতস্রোত বয়ে যাচ্ছে এখানেও। এতিহ্য ও আধুনিকায়নের দ্বৈরথে চেরাগি মোড়ও আকীর্ণ।

ক্রমেই বৈশ্যবাদের হানায় কমার্শিয়াল ক্যানভাসে ঢেকে যাচ্ছে ঐতিহাসিক চেরাগি মোড়। হয়ত তারই মধ্যে সুপ্তভাবে বইছে শিল্প ও সাহিত্যের স্রোত। প্রধান থেকে মার্জিনের বাইরে চলে যাচ্ছে শৈল্পিক সুষমা।

তথাপি চেরাগি মোড় নামক এলাকাটির নামোচ্চারিত হলেই মননে ও চোখে ভেসে আসে সাহিত্য ও শিল্পের দ্যোতনা। চট্টগ্রামের কালচারাল ইমেজের এক ও অদ্বিতীয় প্রতিভূ হয়ে এখনো রয়েছে চেরাগি মোড়। শেষ সেনাপতির মতো শত বিরূপতার বিরুদ্ধে নন্দনের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে শিল্পসুলভ পৌরুষ্যে।

প্রায়ই চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্রের প্রধান পথগুলো মাড়িয়ে চেরাগি মোড় স্পর্শ করে আসা-যাওয়ার সময় দুদণ্ড দাঁড়াই। তাকিয়ে দেখি ভিড়াক্রান্ত চেরাগি মোড়ের নিঃসঙ্গ সড়কদ্বীপটিকে। একটি-দুটি ঝাউ গাছ, কিছু শ্যামলিক পত্রালি এখনো টিকে আছে নগরায়নের ধাবমান দানবের করাল গ্রাস থেকে বেঁচে। কলকাকলি করছে কিছু অচেনা পাখি। প্রদীপের আলোয় আলোয় এখনো সেখানকার মাজার থেকে ছড়াতে দেখি নান্দনিক রৌশনাই।

ঢাকার শাহবাগের মতোই চট্টগ্রামের চেরাগি মোড়ে অসংখ্য ফুলের দোকান গড়ে উঠেছে। বাহারি ফুলের বর্ণিল শোভা আর মনমাতানো সুভাষে আমোদিত হয়ে আছে চারপাশ। ফুটপাত লাগোয়া এভিনিউ জুড়ে আড্ডা-আলাপরত কিছু উচ্ছ্বল তরুণ-তরুণী। অবিরাম বদলে যাওয়া নগর বিন্যাস ও কাঠামোর বাইরে চট্টগ্রামের শিল্প-সাহিত্যের স্থিরচিত্র হয়ে রয়েছে চেরাগি মোড়।

চট্টগ্রামের গভীর বুকে কাল-কালান্তরের চেরাগি মোড় জেগে আছে নিজস্ব বিশিষ্টতা ও শাশ্বত সত্ত্বায়। চেরাগের আলো আর পুষ্পের সৌরভ আমোদিত আলিঙ্গনে ধরে রেখেছে নগর ও মানুষের স্মৃতি, অতীত, ইতিহাস ও নস্টালজিয়া।