রাজাকারের নামেই বহাল টেনিস কমপ্লেক্স
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে রাজশাহীতে রাজাকার জাফর ইমামের নামে এখনো বহাল রয়েছে আন্তর্জাতিক টেনিস কমপ্লেক্স। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধারা।
তারা বলছেন, স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অন্যতম হোতা জাফর ইমামের নামে এ ধরনের স্থাপনা রাখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবমাননার শামিল। দ্রুত কমপ্লেক্সটির নাম পরিবর্তন করার জোর দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
জানা যায়, দেশের সকল স্থাপনা থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম মুছে ফেলতে ২০১২ সালে একটি রিট করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুন। পরে ২০১৬ সালে এ বিষয়ে একমত পোষণ করে একটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে হাইকোর্টের ওই নির্দেশনা সত্ত্বেও রাজশাহীর আন্তর্জাতিক এই টেনিস কমপ্লেক্সটির নাম পরিবর্তনে কোনো উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে কমপ্লেক্সটির নাম পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছেন রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধারা। সবশেষ গত ১৪ মার্চ এ নিয়ে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার মো. নূর-উর-রহমানের সঙ্গে দেখা করেন জেলা ও মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড।
তারা মৌখিকভাবে বিভাগীয় কমিশনারকে তাদের দাবির বিষয়টি অবগত করেন। টেনিস কমপ্লেক্সটির নাম পরিবর্তন করে বীর মুক্তিযোদ্ধা নামে করার দাবিতে আগামী ২৭ মার্চ স্মারকলিপি দেবেন মুক্তিযোদ্ধারা।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, রাজশাহীর বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল জাফর ইমামের। তিনি তৎকালীন সন্ত্রাসী সংগঠন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ) রাজশাহী শাখার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের সময় হিটলিস্টের শীর্ষেই ছিল তার নাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই রাজশাহী টেনিস কমপ্লেক্সটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। ২০০৪ সালে মারা যান ক্রীড়া সংগঠক জাফর ইমাম। এরপর ২০০৫ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তার নামে টেনিস কমপ্লেক্সটির নামকরণ হয়।
এরপর তা বাতিল করে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বা বুদ্ধিজীবীর নামে এ কমপ্লেক্সটি নামকরণের দাবিতে কয়েকবার আন্দোলনে নামেন মুক্তিযোদ্ধারা। তবে অজানা কারণে কখনোই সফল হতে পারেননি তারা।
রাজশাহী মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল মান্নান জানান, জাফর ইমাম বরাবরই খোলস বদল করে চলেছেন। ১৯৬৮ সালের দিকে তিনি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে ক্রীড়া কর্মকর্তা পদে যোগ দেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার চাকরি চলে যায়।
পরে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকেন। ১৯৭৩ সালের দিকে আবারো তিনি চাকরি ফিরে পান। ওই সময় কতিপয় ছাত্রলীগ নেতা অজ্ঞাত কারণে তাকে সমর্থন করে শিক্ষাবোর্ডে গার্ড দিয়ে অফিস করতে নিয়ে আসতেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়।
নগরীর রাজপাড়া থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার শুকুর আলী জানান, আইয়ুব-মোনায়েম খানের মুসলিম লীগের সন্ত্রাসী সংগঠন এনএসএফ-এর রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এই জাফর ইমাম। মুক্তিযুদ্ধের আগে তার হামলার শিকার হয়েছেন রাজশাহীর শীর্ষ ছাত্রনেতারা।
তার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ৬৯'এর গণআন্দোলনে ছাত্র-জনতা জাফর ইমামের রাজশাহীর কাজীহাটার বাড়িতে হামলা চালায়। তখন পালিয়ে রক্ষা পান তিনি। পরে আশ্রয় নেন তার স্ত্রী ডা. জোবায়দার কাদিরগঞ্জের বাড়িতে। সেখানে প্রতি সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনাদের আড্ডা বসত।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিকামী বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রনেতাদের তালিকা হানাদারদের হাতে তুলে দিতেন এই জাফর। তার তালিকা দেখেই চলত গণহত্যা। রাজশাহীতে ঐতিহাসিক বাবলাবন গণহত্যাও তার পরিকল্পনাতেই হয়েছে বলে মনে করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার মো. নূর-উর রহমান বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে এসেছিলেন। তারা লিখিতভাবে তাদের দাবির কথা জানাবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে নাম পরিবর্তনের পক্ষে। তবে সরকারি যেসকল নিয়ম রয়েছে, তা অনুসরণ করেই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।