১০ বীরাঙ্গনা পেলেন মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নওগাঁ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পালপাড়া গ্রামের বীরাঙ্গনারা/ ছবি:  সংগৃহীত

পালপাড়া গ্রামের বীরাঙ্গনারা/ ছবি: সংগৃহীত

নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে বানী রানী পাল, ক্ষান্ত রানী পাল, রেনু বালা ও সুষমা সূত্রধর রোগে আক্রান্ত হয়ে অভাব-অনটনের সংসারে উন্নত চিকিৎসার অভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।

আর বয়সের ভারে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কোনমতে বেঁচে আছেন মায়া রানী সূত্রধর, রাশমনি সূত্রধর, সন্ধ্যা রানী পাল, কালীদাসী পাল, সন্ধ্যা রানী ও গীতা রানী পাল। একাত্তরের সেই যন্ত্রণা ও সামাজিক বঞ্চনার পাশাপাশি অনেকটা দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন আর অসুস্থতার মধ্যেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালের সম্ভ্রম হারানো রণাঙ্গনের এই ১০ নারী যোদ্ধা স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর সম্প্রতি বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা সমমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সমান সকল সুযোগ-সুবিধা পেতে যাচ্ছেন স্বামী, সন্তান ও সম্ভ্রম হারানো এই বীরাঙ্গনারা। তবে এই ১০ বীরাঙ্গনার ৪ জনই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আর বয়সের ভারে নুয়ে পড়ে বেঁচে আছেন ৬ বীরাঙ্গনা। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি গেজেটের মাধ্যমে তাদের নাম প্রকাশ করে।

রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর তীরে ছায়ায় ঘেরা শান্ত আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাক-হানাদার বাহিনীর স্থানীয় দোসর রাজাকার ও আলবদরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নির্যাতন চালায় এই পালপাড়া গ্রামের সনাতন ধর্মের মানুষদের ওপর।

বিজ্ঞাপন

তারা গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সংখ্যালঘু পরিবারের কিশোর, যুবক, মাঝ বয়সী, ও বিভিন্ন বয়সী নারীদের ধরে ওই গ্রামের সুরেস্বর পালের বাড়ির বারান্দায় একত্রিত করে। সেখানে ব্রাশ ফায়ার করে গবীন্দ চরণ পাল, সুরেশ্বর পাল, বিক্ষয় সূত্রধর, নিবারন পালসহ ৫২ জন মুক্তিকামীকে নির্বিচারে হত্যা করে।

এ সময় পাক হানাদার বাহিনী গণহত্যা, লুটপাট ও নারী নির্যাতনের মতো ধ্বংসলীলা থেকে বিশেষ করে নারীরা স্বামী সন্তানদেরকে প্রাণে বাঁচানোর আকুতি করলেও পাক-জান্তাদের মন তা গলাতে পারেনি। উল্টো পাক-জান্তারা সুযোগ বুঝে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে নওগাঁ জেলা শহরের উদ্দেশে চলে যায়। ৫২ শহীদের তাজা রক্তে সে দিন নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর পানি লাল হয়ে ভেসে যায়।

চোখের জল ফেলতে ফেলতে বীরাঙ্গনা কালী দাসী পাল (৭৫) বলেন, স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় গেটের দরজা ভেঙ্গে আমার স্বামীকে টেনে হিঁচড়ে পাঞ্জাবীরা রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে যোগেন্দ্রনাথের বারান্দায় ফেলে রাখে। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়ে আমার কথা না শুনে চোখের সামনে আমার স্বামীসহ ৫২ জনকে হত্যা করে উল্টো আমার উপরও তারা নানা কায়দায় নির্যাতন চালায়। আমার এক ছেলে আছে। অভাবের সংসারে সে দিনমজুরের কাজ করে। আমিও পেটের তাগিদে কখনও ধান কুড়িয়ে, বয়লারের চাতালে কাজ করে, কিংবা অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে দু’মুঠো ডাল ভাত খেয়ে কোনো মতো বেঁচে আছি। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকতে আর মনে হয় স্বীকৃতি পাবো না। তবে অবশেষে এই স্বীকৃতি পেয়ে আমি অনেক খুশি। সরকারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

বীরাঙ্গনা সন্ধ্যা রাণী পাল (৭০) বলেন, ওই দিন ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে পাশের বাড়ির এক বড় মাটির ডাবরের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করি। বাচ্চার কান্না পাঞ্জাবীরা শুনতে পেয়ে আমাকে সেখান থেকে বের হওয়ার কথা বলে। তখন আমি পালিয়ে মাঠে যাওয়ার চেষ্টা করি। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক-বাহিনীরা এই গ্রামের মেয়েদের সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছে। আমাদের বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক ধন্যবাদ।

রাণীনগর উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অ্যাড. ইসমাইল হোসেন বলেন, অনেক চেষ্টার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার অবশেষে আতাইকুলা গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনাকে স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে নাম গেজেটভুক্ত করেছেন। এই স্বীকৃতি প্রাপ্তির সকল প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করা হয়েছে। বরাদ্দ এলেই আগামী বিজয় দিবসে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হবে বলে আমি আশা করছি।

নওগাঁ-৬ (আত্রাই-রাণীনগর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ইসরাফিল আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। অবশেষে আমাদের সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আতাইকুলা পাল পাড়া গ্রামের এই বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেয়েছে। এটি আমাদের অনেক বড় একটি সফলতা। আমার খুবই ভালো লাগছে।