চা-পাতার কম দামে হতাশ চাষিরা
তেঁতুলিয়া থেকে ফিরে: বাংলাদেশের তৃতীয় চা-অঞ্চল হিসেবে পরিচিত পঞ্চগড়। উত্তরাঞ্চলের প্রান্তিক এ জেলার চারপাশ এখন সবুজ চা বাগানে পরিপূর্ণ। সিলেট কিংবা চট্টগ্রামে উঁচু-নিচু ভূমিতে চা বাগান দেখা গেলেও এখানকার সব বাগানই সমতলে। অথচ একটা সময় সমতল ভূমি পতিত গো-চারণভূমি হিসেবে ব্যবহার হত।
বর্তমানে অর্থকরী ফসল সবুজ চায়ের আবাদ প্রভাব ফেলেছে চা-শিল্পে। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় পঞ্চগড়ের চা। দেশের বাজারসহ আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রবেশ করেছে এই জেলার চা। এতে চা চাষে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে ব্যবসায়ীদের।
কিন্তু ন্যায্য দাম না পাওয়ায় হতাশ প্রান্তিক চাষিরা। বাগান পরিচর্যায় দেখা দিয়েছে অনীহা। এদিকে বছর বছর কাঁচা চা পাতার দাম কমতে থাকায় চাষিদের অর্থনৈতিকভাবে লোকসান গুণতে হচ্ছে। আর এমনটা চলতে থাকলে মুখ থুবড়ে পড়বে সমতলের চা-শিল্প।
অথচ চা-শিল্পের বাজারে পঞ্চগড়ের প্রবেশের ধরনটা কিছুটা ভিন্ন। ১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে সীমান্তের কোলঘেঁষা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয় চা চাষ। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি এখানকার মানুষদের। মাত্র চার বছর পর তেঁতুলিয়ার সাফল্যকে পুঁজি করে জেলার বিস্তীর্ণ সমতল ভূমিতে বাণিজ্যিকভাবে বিস্তার লাভ করে চা-বাগান। এখানকার উৎপাদিত চা দেশের বিভিন্ন-প্রান্ত ছাড়াও পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানিও হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে এক নতুন মাইল।
তবে মুখে এখন হাসি নেই অর্থনীতির চাকা সচল রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় থাকা এসব চা চাষিদের। চা পাতা বিক্রি করে নগদ অর্থ পাওয়ার আশা সাধারণ চাষিরা কৃষি জমি, বাঁশ ঝাঁর, বনজ ও ফলদ বাগান উজাড় করে চা বাগান করেছিলো। তখন বাগানের কাঁচা চা পাতা কারখানার মালিকদের কাছে ২৫ থেকে ৩৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতেন চাষিরা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে নানা অজুহাতে চা পাতার দাম কমিয়েছে কারখানার মালিকরা। এ নিয়ে চাষিদের আন্দোলনের একপর্যায়ে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে চা পাতা ক্রয়ের নির্ধারিত মূল্য প্রতি কেজি ২৪.৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি চা কারখানার মালিক, চা বাগান মালিক ও জেলা প্রশাসনসহ সুধীজনের সমন্বয়ে আলোচনা সভায় সেই দামও কমিয়ে ১৬.৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় চা পাতার মান ভাল না হলে ১০% হারে কর্তন করে চাষিদের মূল্য পরিশোধ করার। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের কোনো তোয়াক্কা করছেন না কারখানার মালিকেরা। এমনটাই অভিযোগ সাধারণ চা চাষিদের।
দর্জিপাড়া গ্রামের চা বাগান মালিক মেহেদি হাসান মামুন বার্তা২৪.কমকে বলেন, চা কারখানার মালিকদের একতরফা সিদ্ধান্তে আমরা চাষিরা ক্ষতির মধ্যে রয়েছি। বর্তমানে কাঁচা পাতা যে মূল্যে বিক্রি করতে হচ্ছে, তা দিয়ে বাগানের সার-কীটনাশক ও পাতা তোলার শ্রমিকের খরচও হয় না। বাগান পরিচর্যা করাও সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ভারতের শিলিগুড়ি, 'দার্জিলিংয়ের চা আর আমাদের চায়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। স্বাদে মানে পঞ্চগড় তেঁতুলিয়ার চা ভালো হলেও সিন্ডিকেটের কারণে আমরা চাষিরা এর ন্যায্য দাম পাচ্ছি না।'
আরেক চা বাগান মালিক আতাউর রহমান বলেন, সব কিছুর দাম বাড়ে কিন্তু চা পাতার দাম বাড়ছে না। চা কারখানার মালিকেরা তাদের সুবিধা মত দাম কমিয়ে যাচ্ছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ ভাউচারে কর্তনের হিসাব, প্রতি কেজির মূল্য উল্লেখ করে না। ন্যায্য দাম চাইলে কারখানার মালিকরা চা পাতা কিনতে অপারগতা প্রকাশ করে। বর্তমানে ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে কারখানার মালিকরা কাঁচা চা পাতা কিনছেন বলেও বার্তা২৪.কমকে তিনি জানান।
বাংলাদেশ চা বোর্ড, পঞ্চগড়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. মোহাম্মদ শামীম আল-মামুন বার্তা২৪.কমকে বলেন, চা বোর্ডের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কারখানার মালিক ও বাগান মালিকদের নিয়ে একাধিকবার আলোচনা করা হয়েছে। চা পাতার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বেশি কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। কিন্তু কারখানার মালিকেরা নানান অজুহাতে সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করছে না।