আমন সরবরাহে উপেক্ষিতই থাকছে কৃষক

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নাটোর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সরাসরি ধান বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকরা

সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সরাসরি ধান বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকরা

সিন্ডিকেট ভেঙে কৃষককে ধানের নায্যমূল্য দিতে সরকার স্থানীয় পর্যায়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক তৎপরতায় ধান সংগ্রহের ব্যবস্থা চালু করলেও এর সুফল পাচ্ছেন না প্রান্তিক চাষিরা।

ইউনিয়ন পর্যায় থেকে লটারির মাধ্যমে আমন ধান সংগ্রহ কার্যক্রম চালু হওয়ায় কিছুটা আশান্বিত হয়েছিলেন কৃষকরা। লটারির মাধ্যমে যোগ্য কৃষক নির্বাচনের পর প্রথম দিকে নাটোর জেলার ৬টি গুদামে নির্ধারিত কৃষকরা ধান সরবরাহ করতে পারলেও ধীরে ধীরে সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সিন্ডকেটের কাছেই। আমন ধান সংগ্রহ মৌসুমের শেষ ভাগে জেলার প্রতিটি উপজেলায় আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে গুদাম সিন্ডিকেট।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় প্রতি কেজি ২৬ টাকা দরে ৮৫৯৬ মেট্রিক টন আমন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে খাদ্য বিভাগ। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ সংগ্রহ অভিযান অব্যাহত থাকবে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ধান সংগ্রহ হবে নাটোর সদর উপজেলায় ১৩২৮ মেট্রিক টন, নলডাঙ্গা উপজেলায় ৩৯৩ মেট্রিক টন, বাগাতিপাড়ায় ৫০৪ মেট্রিক টন, বড়াইগ্রামে ১৮১৬ মেট্রিক টন, গুরুদাসপুরে ৬৮২ মেট্রিক টন।

প্রান্তিক কৃষকদের অভিযোগ শক্তিশালী এ সিন্ডিকেট চিরাচরিত উপায়ে কৃষকদের থেকে ধান সরবরাহের কার্ড নিয়ে নিজেরাই গুদামে ধান সরবরাহ করছে। কে প্রকৃত কৃষক আর কে সিন্ডিকেট সদস্য তা জেনেও উপজেলা খাদ্য বিভাগ ও গুদাম কর্মকর্তারা কৃষকের অনুকূলে কাজ করছেন না। লটারিতে নির্বাচিত হয়েও নিরুপায় কৃষকরা সিন্ডিকেট সদস্যদের কার্ড দিতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রকৃত কৃষকের কার্ড নিয়ে মানহীন আর্দ্র ধান গুদামে দিচ্ছেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় রাজনীতির সাথে যু্ক্ত হওয়ায় ভয়ে মুখ খোলেন না কৃষকরা।

সম্প্রতি জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলায় কৃষকদের কার্ড নিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা আর্দ্রতাযুক্ত ধান গুদামে সরবরাহ করলে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় উপজেলা প্রশাসন। অভিযোগ ওঠে উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট খাদ্য গুদাম পরিদর্শকসহ গুদাম কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় একজন কর্মকর্তাসহ চার কর্মচারীকে বরখাস্ত করে দায় সেরেছে উপজেলা প্রশাসন। সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের সহায়তাকারী খাদ্য ও গুদাম কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তেই আছেন এখনও।

আমন ধানের সংগ্রহ সিন্ডকেটের এমন চিত্র জেলার বাকি ৬টি উপজেলাতেও। নাটোর শহর কেন্দ্রিক ধানের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট মনোনীত অকৃষকরাই কৃষকের কার্ড নিয়ে সরকারের কাছে নিজেদের ধান বিক্রি করছেন। এসব ধানের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিস্তর। প্রকৃত কৃষকরা মৌসুমে উৎপাদিত আমন ধান বিক্রি করলেও অকৃষকরা বিগত মৌসুমের পুরাতন ধান সরবরাহ করছেন। দীর্ঘ সময় এসব ধান নিজস্ব উপায়ে সংরক্ষণের কারণে আর্দ্রতা, নষ্ট ধানের দানাসহ সরকারি গুদামের ধানে নানা সমস্যা থেকে যাচ্ছে।

কৃষকদের অভিযোগ প্রকৃত কৃষকদের ধান সরবরাহ থেকে বিরত রাখতে নানা হয়রানি করছেন খোদ খাদ্য ও গুদাম কর্মকর্তারা। কৃষকরা গুদামে ধান দিতে এলে ধানের আর্দ্রতা পরীক্ষার নামে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদপুষ্ট ও খাদ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে কৃষকদের কৃষি কার্ড কিনে নিয়ে ব্যবসায়ীদের ট্রলিবোঝাই নিম্নমানের ধান আর্দ্রতা পরীক্ষা ছাড়াই নেওয়া হচ্ছে।

কৃষকরা এ নিয়ে উপজেলা পর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করে কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না। গত সপ্তাহে বাগাতিপাড়া এলএসডিতে দুজন ব্যক্তির নামে ১৮৫ বস্তা ধান ক্রয় দেখিয়েছে গুদাম কর্তৃপক্ষ। তবে ক্রয়ের অনুকূলে প্রকৃত কৃষকের কার্ড দেখাতে পারেননি উপজেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা।

জামনগর ইউনিয়নের কৃষক খয়রুদ্দিনের ছেলে ইউসুফ আলী বলেন, লটারিতে নির্বাচিত হওয়ার পর বাড়ি থেকে ধানের নমুনা এনে গুদামে আর্দ্রতা পরীক্ষা করান তিনি। ইতিবাচক হওয়ায় ২০ মণ ধান বাড়ি থেকে গুদামে আনলে কর্মকর্তারা আর্দ্রতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পরে ধান নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই।

বড়াইগ্রামের জালশুকা গ্রামের কৃষক আবদুল কুদ্দুস বলেন, লটারিতে নির্বাচিত হয়েও ধান দিতে গেলে মনে হয় গুদাম কর্তৃপক্ষের কাছে বড় ধরনের অপরাধ করে ফেলেছি। প্রকৃত কৃষকের আর সিন্ডিকেট সদস্যদের সাথে তারা দুই রকম আচরণ করে।

বাগাতিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াংকা দেবী পাল জানান, নানা অনিয়মের ব্যাপারে কৃষকের অভিযোগ পেয়ে সম্প্রতি খাদ্য গুদাম পরিদর্শন করি। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে একজন উপ-খাদ্য পরিদর্শক ও তিনজন প্রহরীসহ চারজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করা হয়েছে।

জাতীয় কৃষক সমিতির জেলা সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম বলেন, সরকার কৃষকদের জন্য নায্যমূল্যের ব্যবস্থা করলেও খাদ্যবিভাগের লোকজন তা বাস্তবায়ন করতে দিচ্ছে না। বঞ্চিত কৃষক বঞ্চিতই থাকছেন। এমনটা অব্যাহত থাকলে কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব নয়। ধান সংগ্রহে আরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

বাগাতিপাড়া উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক রেজাউল করিম বলেন, নীতিমালা মেনে ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে। কৃষক ছাড়া অন্য কারো ধান নেওয়া হচ্ছে না। আর্দ্রতা কম বেশি ওঠানামা করায় তা একাধিকবার পরীক্ষা করা হতে পারে। তবে এ নিয়ে কৃষককে হয়রানি করা হচ্ছে না।

ধান সংগ্রহে সিন্ডিকেট ও কৃষকদের হয়রানির ব্যাপারে বক্তব্য জানতে জেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ বলেন, স্বচ্ছভাবে প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কৃষকরা যেন হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে নজরদারি আরো বাড়াতে বলা হয়েছে।