ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে শাহজীবাজার রাবার বাগান
ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার শাহজীবাজার রাবার বাগান। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লোকসানে একদিকে যেমন বকেয়া পড়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা। অন্যদিকে কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকার হওয়ার পথে বাগানে কর্মরত সাড়ে ৩০০ মানুষ। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে লোকসান কমাতে ও বাগান ঠিকিয়ে রাখতে কাজ চলছে।
বাগান সূত্রে জানা যায়, ২ হাজার ১০৪ একর জায়গা নিয়ে ৮০ দশকে প্রতিষ্ঠা হয় শাহজীবাজার রাবার বাগান। এক সময় বাগানটি লাভজনক থাকলেও ২০১৩ সাল থেকে লোকসানে চলে যায়। দীর্ঘ ১০ বছর আগে গাছের জীবনচক্র শেষ হওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারের রাবারের দাম কমে যাওয়া ও সঠিক পরিচর্চার অভাবে এখন ধ্বংসের প্রহর গুণছে বাগানটি। অথচ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। প্রতি বছরই এখন কয়েক কোটি টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে বাগানটিকে।
তথ্যমতে, ২০১৩ সাল থেকে লোকসান শুরু হয়। এরপর থেকেই বাড়তে থাকে লোকসানের পরিমাণ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ১৪-১৫ অর্থবছরে ৪ কোটি ৭০ লাখ, ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে ৪ কোটি ২৬ লাখ, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৪ কোটি, ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে ৩ কোটি ৬৪ লাখ এবং বিগত ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ ৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা লোকসান গুণতে হয়েছে। এ বছর লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছে বাগান কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, লোকসানের জন্য কর্তৃপক্ষ গাছের জীবনচক্র শেষ হয়ে যাওয়া ও আন্তর্জাতিক বাজারের রাবারের দাম কমে যাওয়াকে দায়ী করলেও পরিচর্যার অভাব থাকার বিষয়টি স্বীকার করতে রাজি নয়। কর্তৃপক্ষ বলছে- গেলো ৭ বছরে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা বেড়েছে দ্বিগুণ। অথচ সেই তুলনায় রাবারের দাম বৃদ্ধি পাওয়াতো দূরের কথা উল্টো কয়েকগুণ কমে এসেছে। ২০০০ সালে প্রতি কেজি রাবারের দাম ছিল সাড়ে ৩০০ টাকা। অথচ বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি রাবারের দাম মাত্র ১৩০/১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে, রাবার গাছের জীবনচক্র ৩০ বছর হলেও বর্তমানে গাছের বয়স চলছে ৪০ বছর। ১০ বছর আগেই গাছগুলোর জীবনচক্র শেষ হয়ে যাওয়ায় কমে গেছে কষ উৎপাদন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন গাছ লাগালেও অন্তত ১৫/২০ বছর সম্পূর্ণভাবে উৎপাদন বন্ধ থাকবে বাগানটি। আর যে পরিমাণ লোকসানের আসবে তা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে অন্তত ৩০/৩৫ বছর। তাদের দাবি- দ্রুত গতিতে কাজ করলেও সম্পূর্ণ বাগানটি পরিষ্কার করতেই সময় লাগবে অন্তত ৪/৫ বছর। এরপর পুরোপুরিভাবে উৎপাদনে যেতে সময় লাগবে আরও ১২/১৫ বছর। এই সময় শ্রমিকসহ বিভিন্নভাবে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে তা পুষিয়ে উঠতে ৩০/৩৫ বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে আগামী ৩৫/৪০ বছরের আগে লাভের মূখ দেখবে না শাহজীবাজার রাবার বাগান।
এ ব্যাপারে বাগানের কর্মচারি মো. আব্দুর রউফ বলেন, ‘আমার প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা বকেয়া পড়েছে। এগুলো ফেলে আমাদের অনেক উপকার হতো। এককালীন টাকাটা ফেলে ছেলে-মেয়ের বিয়েসহ বাড়ি-ঘর নির্মাণে হাত দিতে পারতাম।’
ফয়জুল মিয়া বলেন, ‘প্রায় দেড় লাখ টাকার উপরে বেতন পাওয়া রয়েছে। দেবে দেবে বলেও দিচ্ছে না। ফলে খারাপভাবে আমাদের দিন কাটছে। ছেলে মেয়ে নিয়ে খুব কষ্ট করে দিন কাটাতে হচ্ছে।’
শাওয়ন নামে অপর এক কর্মচারি দাবি করেন- ‘গাছগুলো বয়স্ক হয়ে যাওয়ায় সেগুলোতে পোকায় ধরেছে। ফলে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় গাছের গুড়া চোখে পড়ে।’
শাহজীবাজার রাবার বাগান কর্মচারি ইউনিয়ন সমিতির সভাপতি মো. আল আমীন বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বকেয়া পড়েছে প্রায় ৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। একেক জন কর্মচারির বকেয়ার পরিমাণ দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। এসব দ্রুত পরিশোধসহ আবাসিক ব্যবস্থা, বাগানে মেডিক্যাল টিম রাখা ও নিরাপত্তা জোরদারসহ সকল সমস্যা সমাধান করা প্রয়োজন। এছাড়া বাগান যেন আরো বেশি উৎপাদনের দিকে যায় এর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।’
তবে শীঘ্রই সব সমস্যা সমাধানের আশ্বাস প্রদান করেন বাগান ব্যবস্থাপক কে এম মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধ করতে ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেছি। দ্রুত সকল বকেয়া পরিশোধ করা হবে। এছাড়া বাগানটিকে পুনর্বাসন করার জন্য নতুন ছাড়া উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলছে’।