চোরাই গ্যাসের সংযোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বাড়িওয়ালারা
দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম সাভারের আশুলিয়া। এখানে শিল্পের চাকা ঘুরাতে দেশের প্রায় সব জেলা থেকেই ছুটে আসে মানুষ। এই শিল্পাঞ্চল অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। আর এই প্রয়োজনীয়তাকে পুঁজি করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসায়ীরা। তার মধ্যে অন্যতম গ্যাস চোরাকারবারিরা। তবে গত ১ বছরে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সফলতার মুখ দেখেছে সাভার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।
দেশের প্রধান খনিজ সম্পদ প্রাকৃতিক গ্যাস। আর এই অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণে শুধু সাভার-আশুলিয়া এলাকা থেকে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে চালিয়ে যাচ্ছিলো তাদের চোরাই গ্যাস ব্যবসা। গ্যাস চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হলেও জামিনে এসে আবারও তারা মেতে ওঠে গ্যাস চুরির উল্লাসে। একেকটি পয়েন্টে ৬ থেকে ৭টি করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান পরিচালনা করা হলেও আবারও রাতের আধারে একই ব্যক্তির ছত্রছায়ায় দেওয়া হয় অবৈধ সংযোগ। আর প্রতিবার অবৈধ সংযোগ প্রদানে বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা।
বার্তা২৪.কমের অনুসন্ধান বলছে, তিতাসের অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান যত বেশি তত বেশি লাভবান গ্যাস চোরাকারবারিরা। একটা সময় গ্যাস চোরাকারবারিরা নিজেই কৌশলে নিজের দেওয়া অবৈধ গ্যাস সংযোগ তিতাসের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করতো। এতে করে প্রতিবার চোরাই সংযোগ প্রদানে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া যেতো মোটা অঙ্কের টাকা। কিন্তু গত ১ বছরে সাভার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ঘন ঘন অভিযান পরিচালনা করেছে । শুধু অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান ও নিয়মিত মামলায় সীমাবদ্ধ ছিল তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। তিতাস গ্যাসের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি স্থায়ী কোন পদক্ষেপ। তবে চলতি বছরের শুরু থেকে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও জরিমানা করায় সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে সাভার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।
যেখানে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের সাথে পাল্লা দিয়ে পরদিনই সংযোগ প্রদান করেছে গ্যাস চোরাকারবারিরা। সেখানে অভিযানের ১ মাস পরেও সাভার-আশুলিয়ার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এলাকাগুলো ঘুরে জ্বলতে দেখা যায়নি গ্যাসের চুলা। তবে এতে করে ক্ষতি ও দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক। তারা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিলসহ একত্রে মৌখিক চুক্তি করে বাড়ি ভাড়া নিয়ে এখন কিনছেন এলপি গ্যাস। এতে করে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন সাধারণ শ্রমিকরা।
ভাড়াটিয়া পোশাক শ্রমিক সুমনা বার্তা২৪.কম-কে বলেন, গ্যাস না থাকলে লাকড়ি বা কাঠের খড়ি জ্বালিয়ে রান্না করতে হয়। অফিসে কাজের চাপ বেশি হলে রান্নার সময় কম থাকে। তখন ডিম ভাজতেও লাকড়ি দিয়ে চুলা জ্বালাতে হয়। রান্না করতেই সময় চলে যায় খাওয়ার সময় আর থাকে না। তাই ঝুঁকি থাকলেও বাধ্য হয়ে গ্যাস সিলিন্ডার কিনে ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু গ্যাস সিলিন্ডারের দাম অনুযায়ী বাসা ভাড়া কম নিচ্ছে না বাড়িওয়ালা।
মীনা নামে আরেক পোশাক শ্রমিক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আমরা তো আর জানি না কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ গ্যাস সংযোগ। বৈধ গ্যাস সংযোগ যুক্ত বাসা চিহ্নিতকরণের ব্যবস্থা যদি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ করতেন তাহলে সাধারণ শ্রমিকরা উপকৃত হতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাড়ির মালিক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আমরা তো টাকার বিনিময়েই গ্যাস সংযোগ নেই। বৈধ গ্যাস সংযোগের ব্যবস্থা না থাকায় ভাড়াটিয়াদের কথা চিন্তা করে বাধ্য হয়ে এসব সংযোগ নিতে হয়। তাছাড়া ভাড়াটিয়ারা গ্যাস সংযোগ না থাকলে বাসা ভাড়া নিতে চান না। তবে বার বার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় এবার আর সংযোগ নিচ্ছি না। কারণ সংযোগ নিলেই লোকসান। তাই অবৈধ সংযোগ ছাড়াই বাড়ি ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
অনুসন্ধানী তথ্যমতে, গত ১ বছরে সাভার ও আশুলিয়ার ১৯৩টি পয়েন্টে ৫৬টি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান পরিচালনা করে সাভার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। এসময় প্রায় ৮ কোটি টাকা মূল্যমানের ১০৭ কিলোমিটার নিম্নমানের পাইপ জব্দ ও ১ লাখ ৫ হাজার বার্নার জব্দ করা হয়। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রাহক ও সংযোগ দাতাকে ৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি ২ জন গ্যাস চোরাকারবারিকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে সাভার আঞ্চলিক তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আবু সাদাৎ মো. সায়েম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আমরা শুধু অবৈধভাবে নেওয়া সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে জড়িতদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করতে পারি। এছাড়া আমরা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি।
তিনি আরও বলেন, নিয়মিত সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করায় বিচ্ছিন্নের পর পয়েন্টগুলোতে আর পুনঃসংযোগ হচ্ছে না। যেখানেই অবৈধ সংযোগের সন্ধান পাওয়া যাবে সেখানেই সংযোগ বিচ্ছিন্নের বিশেষ অভিযানের পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হবে।