যৌনকর্মীর জানাজা: আনন্দে ভাসছে পল্লির বাসিন্দারা
রাজবাড়ির দৌলতদিয়ায় তিন জন যৌনকর্মীর ধর্মীয় রীতি মেনে দাফন ও জানাজার ঘটনা সারাদেশে বেশ আলোড়ন তুলেছে। দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে যৌনকর্মীর জানাজার ঘটনা তাদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী ও সমাজের শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষরা।
সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে এতদিন যাদের মৃত্যুর পর নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো, তাদের মৃত্যুর পর মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ধমীর্য় রীতি অনুসারে দাফন সম্পন্ন হবে এমনটা ভাবতেও পারেননি এই পল্লির কর্মীরা। তাই অনেকটা আনন্দে ভাসছেন তারা।
বিশেষ করে তারা যে ‘সমাজের আলাদা’ এটা বোঝানোর জন্য পল্লির বাইরে যেতে হতো খালি পায়ে। সেই মানুষগুলোর শেষ বিদায়টা হবে ধর্মীয় নিয়ম-নীতি মেনে সেটা তারা স্বপ্নেও কখনো দেখার চেষ্টা করেননি। কিন্তু আজ সময় বদলেছে। বদলেছে সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এখন তাদের খালি পায়ে বাইরে যেতে হয় না। মৃত্যুর পরও তাদের জানাজা হয় ধর্মীয় রীতি অনুসারে। আর তাদের জানাজায়ও শরিক হয় সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাধারণ মানুষ। যৌনকর্মীর জানাজায় সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিই প্রমাণ করে সব বাধা পেরিয়ে ভেঙে যাচ্ছে যুগের পর যুগ প্রচলিত এ প্রথা। আলো ফুটছে ঘুণেধরা অবক্ষয় এই মানব সমাজে।
দীর্ঘ দিনের প্রথা ভেঙে ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম দৌলতদিয়া যৌনপল্লির যৌনকর্মী হামিদা বেগমকে ধর্মীয় রীতি অনুসারে শেষ বিদায় জানানোর মাধ্যমেই শুভ সূচনা হয় আলোর জগতের।
অন্ধকার জগতের এই প্রথা ভাঙতে সক্ষম হয়েছেন গোয়ালন্দ ঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ আশিকুর রহমান। প্রথম কাজটি সম্পন্ন করার পরই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রসংশায় ভাসছেন তিনি। একজন যৌনকর্মীর মরদেহের খাটিয়া নিজের কাঁধে বহন করে যখন হাঁটছিলেন কবরের দিকে তখন সহস্রাধিক যৌনকর্মী ও উপস্থিত সবার চোখেই ছিল আনন্দের অশ্রু। অন্যদিকে দৌলতদিয়া রেলস্টেশন মসজিদের যে ইমাম প্রথম জানাজা পড়িয়েছেন সেই ইমাম গোলাম মোস্তফা সমালোচনা ও সামাজিক চাপে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি আর কোন যৌনকর্মীর জানাজা পড়াবেন না।
তবে আশার কথা হলো চলতি মাসের ২ ফেব্রুয়ারি হামিদা ২০ ফেব্রুয়ারি রিনা বেগম ও ২২ ফেব্রুয়ারি পারভীন বেগমের শেষ বিদায়টা হয়েছে ধর্মীয় রীতি অনুসারে। স্থানীয় ইমামদের আপত্তির পরও কোন ধরণের বাঁধা ছাড়াই তিনজন যৌনকর্মীর জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হওয়ায় এখন আনন্দে ভাসছে যৌনপল্লির প্রায় ১২০০ কর্মী।
কথা হয় দৌলতদিয়া পতিতাপল্লির একাধিক যৌনকর্মীর সাথে। তারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, সামাজিকভাবে আমাদের এই পেশাটাকে খারাপ চোখে দেখা হয়। আমরা যারা এই পেশায় আছি তারা অনেকেই সমাজ থেকে প্রতারিত হয়ে এখানে পেটের দায়ে আছি। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন- আমাদের কাছে যারা আনন্দ-ফূর্তি করতে আসে তারা তো জেনেশুনেই আসে। তারা জানে এটা ধর্মীয় অনুশাসনে অবৈধ। সমাজ কী তাদের একজনকেও চিহিৃত করে মৃত্যুর পর নদীতে ভাসিয়ে দিতে পেরেছে?
আমাদের চাওয়া গোয়ালন্দের ওসি স্যার যে মহতী উদ্যোগ নিয়েছেন সেটা যেন কোন সামাজিক চাপের কাছে বন্ধ না হয়ে যায়। মৃত্যুর পর যেন আমাদেরকে মানুষ হিসাবে পৃথিবী থেকে চির বিদায় দেওয়া হয়। আমরা ভীষণ আনন্দিত। এ ধারা যেন অব্যাহত থাকে।
প্রথম যৌনকর্মীর জানাজা পড়ানো দৌলতদিয়া রেলস্টেশন মসজিদের ইমাম গোলাম মোস্তফা বার্তা২৪.কমকে বলেন, হামিদা বেগমের জানাজা পড়ানোর পর আমি সামাজিকভাবে চরম চাপে রয়েছি। গ্রামের লোক, সমাজের লোক সবাই আমাকে বলছে আমি কেন পড়াতে গেলাম। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামীতে আমি আর কোন যৌনকর্মীর জানাজা পড়াব না। তবে তারা পারলে অন্য কোন ইমাম দিয়ে জানাজা পড়ালে পড়াতে পারে।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় মৃত যৌনকর্মীর জানাজা পড়ানো গোয়ালন্দ থানা মসজিদের ইমাম আবু বক্কর সিদ্দিকী এ ব্যাপারে কোন কথা বলতে রাজি হননি।
জানাজাপ্রাপ্ত যৌনকর্মীদের জন্য কবর খোঁড়া ব্যক্তি বাবর আলী ও নুর ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ওসি স্যারের নির্দেশে আমরা কবর খুঁড়তে এসেছি। তিনটি কবরই আমরা খুঁড়েছি। আমাদের সামাজিকভাবে কোন চাপ নেই।
মানবাধিকার কর্মী সাঈদ ইমাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, একজন মানুষ হিসাবে তার শেষ বিদায়টা অবশ্যই তার ধর্মীয় রীতি অনুসারে হওয়া উচিত। এতদিন তাদের সাথে যেটা করা হয়েছে তা রীতিমত মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। তবে আশার কথা হলো দেরিতে হলেও মানবতার শুভ সূচনা হয়েছে। এটা যাতে অব্যাহত থাকে সেদিকটা আমাদের সবাইকে নজর রাখতে হবে।
প্রথা ভাঙার নায়ক গোয়ালন্দ ঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ আশিকুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, মানুষ হিসাবেই মানবিক দিকটি বিবেচনা করে আমি কাজটি করার ইচ্ছাপোষণ করি। প্রথম জানাজাটি সম্পন্ন করার পর আমি আরো বেশি আশাবাদী হয়ে উঠি। যেহেতু প্রথাটি দীর্ঘদিনের। তাই এটি ভাঙতেও একটু সময় লাগবে। কারণ এর আগে কখনো ধর্মীয় রীতিতে যৌনকর্মীদের জানাজা সম্পন্ন হয়নি। এটা নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে কিছুটা বিরূপ মনোভাব রয়েছে। তবে সময়ের সাথে সাথে একদিন এটাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশা করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
এই কাজের জন্য তিনি বাংলাদেশ পুলিশ ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান ও জেলা পুলিশ সুপার মো: মিজানুর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশে যৌনপেশা বৈধ হলেও যৌনকর্মীরা ঊপেক্ষিত। সমাজে তাদের কোন সামাজিক স্বীকৃতি নেই। এমনকি মৃত্যুর পর তাদেরকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হত। দেশের নাগরিক হিসেবে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত।