গ্রামবাসীর হাত ধরে স্বপ্নের ভাসমান সেতু

  • রেজাউল করিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ফরিদপুর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গ্রামবাসীর হাত ধরে স্বপ্নের ভাসমান সেতু/ছবি: বার্তা২৪.কম

গ্রামবাসীর হাত ধরে স্বপ্নের ভাসমান সেতু/ছবি: বার্তা২৪.কম

ফরিদপুরের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন মধুমতী নদীর বাওরের ওপারের কয়েকটি গ্রাম। এসব গ্রামে বসবাস করেন ১২ হাজার মানুষ। মূল ভূখণ্ডে আসতে তাদের মধুমতীর বাওর পাড়ি দিতে হয়, নয়তো বেশি ঘুরতে হয় প্রায় ১৮ কিলোমিটার পথ।

বছরের পর বছর প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধরনা দিয়ে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজ উদ্যোগেই আলফাডাঙ্গার টিটা খেয়াঘাট এলাকায় মধুমতীর বাওরের ওপর ভাসমান সেতু নির্মাণ করছে এলাকাবাসী।  ‘স্বপ্নের সেতু’র নির্মাণ কাজ গত বছরের ২২ নভেম্বর থেকে শুরু হয়। 

বিজ্ঞাপন

সরজমিনে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার টগরবন্দ ইউনিয়নের টিটা খেয়াঘাটের পশ্চিম পাড়ে দেখা যায়, চলছে প্লাস্টিকের ব্যারেল এবং স্টিলের সিট, অ্যাঙ্গেল ও রেলিং দিয়ে ভাসমান সেতু নির্মাণের কাজ।

১২ ফুট প্রস্থ এবং ৮৫২ ফুট দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট এ সেতুটির নির্মাণ কাজ করছে যশোরে মনিরামপুর সড়কে অবস্থিত রাজগঞ্জ বাজারের ‘বিশ্বাস ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এরইমধ্যে সেতুটির ৬০ ভাগ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ‘বিশ্বাস ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’ এর আগেও যশোরে এ জাতীয় দুটি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছে।

বিজ্ঞাপন
চলছে প্লাস্টিকের ব্যারেল এবং স্টিলের সিট দিয়ে ভাসমান সেতু নির্মাণের কাজ/ছবি: বার্তা২৪.কম

২৫০ লিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন প্লাস্টিকের ৮৫২টি ব্যারেল এবং ৬০ টন স্টিল দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে এ সেতুটি। এ সেতুটি দিয়ে ৩ টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ছোট আকারের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। ২১টি ব্যারেল ও স্টিল দিয়ে ৪০টি পন্টুন তৈরি করে স্টিলের মোটা রড দিয়ে সংযুক্ত করে ভাসমান সেতুটির নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে।

‘বিশ্বাস ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’ এর মালিক মো. রবিউল ইসলাম বার্তা২৪.কম-কে জানান, এর আগে তারা যশোরে যথাক্রমে ১০০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থ এবং ৭৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট প্রস্থের দুটি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছেন। তবে এ সেতুটি আরও মজবুত করে করছেন। ওই দুটি সেতুর চেয়ে এ সেতুটিতে বেশি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যারেল ব্যবহার করা হয়েছে। জাহাজে যে রঙ দেওয়া হয়, তা সেতুতে ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে সহজে মরীচিকা না পড়ে।

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, আগামী ২০ বছর নির্বিঘ্নে সেতুটি দিয়ে লোকজনসহ ছোট ছোট যানবাহন চলাচল করতে পারবে।

সেতুর মাঝামাঝি অংশ ১২ ফুট চওড়া ও ৬ ফুট উঁচু/ছবি: বার্তা২৪.কম

এ সেতুটির নকশা করেছেন টিটা এলাকার বাসিন্দা মুকুল খান। তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। তিনি জানান, সেতুটি নির্মাণের আগে তিনিসহ এলাকার কয়েকজন ওই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আগে নির্মিত দুটি ভাসমান সেতু পরিদর্শন করে এসেছেন। এ সেতুটি আগের দুটি সেতুর তুলনায় আকর্ষণীয় ও পাকাপোক্ত করে নির্মাণ করা হচ্ছে। ভাসমান থাকলেও সেতুর মাঝামাঝি অংশ ১২ ফুট চওড়া ও ৬ ফুট উঁচু করে নির্মাণ করা হচ্ছে যাতে এ বাওরে নৌযান চলাচলে কোনো সমস্যা না হয়।

টগরবন্ধ ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, এ ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডে ছয়টি গ্রাম এ বাওরের কারণে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানে চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়াও তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব গ্রামে। এখানে একটি পোষ্ট অফিস ও একটি কমিউনিটি ক্লিনিকও রয়েছে।

এই এলাকার বাসিন্দাদের আলফাডাঙ্গা উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন জায়গায় যেতে এবং মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে এ বাওড় পেরিয়ে মূল ভূখণ্ডে আসতে হয়।

নিজেদের উদোগেই  সেতু নির্মাণের কাজ হাতে নেয় এলাকাবাসী/ছবি: বার্তা২৪.কম

কথা হয় ওই এলাকার বাসিন্দা সবুরন বেগমের (৫৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, খেয়া পার হতে অনেক সমস্যা। ওঠা নামা করতে হয় কষ্টে। তাছাড়া, খেয়ার জন্য অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। আমরা খুব খুশি। আমাদের আর কষ্ট করতে হবে না।

খুলনা সোনালী জুট মিলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী সিদ্দিক মোল্লা বলেন, একটি সেতুর জন্য রাজনৈতিক নেতা, সাংসদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে বহু কান্নাকাটি করেছি। কিন্তু দেই-দিচ্ছি করে তারা আমাদের হতাশ করেছেন। তাই নিজেরাই নিজেদের সেতু বানাচ্ছি। এ সেতু আমাদের টাকায়, আমাদের শ্রমে নির্মিত। এটাই আমাদের গর্ব।

স্বপ্নের এ সেতু নির্মাণ কাজের মূল তদারকি করছেন টগরবন্ধ ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম জাহিদুল হাসান। তিনি বলেন, এলাকাবাসীদের নিয়ে নিজেদের অর্থে এ ভাসমান সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিই। এলাকার ৬০ জন ব্যক্তির কাছ থেকে ৬০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে আমরা কাজে হাত দিই। আগামী ৩১ মার্চ আমাদের এ স্বপ্নের সেতুটির উদ্বোধন করা সম্ভব হবে।