‘রাসা ক্যামিকেলে’ সর্বস্বান্ত দুইশ সংখ্যালঘু পরিবার

  • কাজল সরকার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, হবিগঞ্জ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কারখানার বর্জ্য যাচ্ছে ফসলি জমিতে/ছবি: বার্তা২৪.কম

কারখানার বর্জ্য যাচ্ছে ফসলি জমিতে/ছবি: বার্তা২৪.কম

হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার রশীদপুর এলাকাবাসীর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘রাসা ক্যামিকেল লি.’। কোম্পানিটির দূষিত বর্জ্যে এখন বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে শতাধিক একর ফসলি জমি। নদী ও জলাশয়ের মাছের সঙ্গে মরছে কষ্টার্জিত টাকায় পুকুরে চাষ করা মাছও। এমনকি রেহাই পাচ্ছে না গৃহপালিত পশু-পাখিও। এতে সর্বস্বান্ত হয়েছে প্রায় দুই শতাধিক সংখ্যালঘু কৃষক পরিবার।

এদিকে, বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করলেও টনক নড়ছে না সমাজপতিদের। বিচার চেয়ে উল্টো হুমকি-ধামকি পেতে হচ্ছে অসহায় সংখ্যালঘু পরিবারগুলোকে। এমনকি স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের মাধ্যমে পরিবারগুলোকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করার হুমকি দেয়ার অভিযোগও রয়েছে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়- প্রায় ৩ বছর আগে জেলার বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের বড়গাঁও গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘রাসা ক্যামিকেল লি.’ নামক একটি শিল্প-প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কাই করছে না। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ ক্যামিকেলের কারখানা। সেখানে চারটি চুল্লির মাধ্যমে উৎপাদন করা হচ্ছে এক ধরনের আঠা।

রাসা ক্যামিকেল লি./ছবি: বার্তা২৪.কম

স্থানীয়দের অভিযোগ- প্রতিষ্ঠানটির চারটি চুল্লি দিয়ে প্রতিনিয়ত নির্গত হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক বিষাক্ত কালো ধোঁয়া। মাঝে মধ্যে এসব চুল্লিতে বিস্ফোরণের মতো বিকট শব্দ তৈরি হয়। পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ে আকাশমুখি আগুনের বিশাল কুণ্ডলী। এতে ভয়-আতঙ্কে দিন কাটে শিশুদের। একই সঙ্গে গ্রীষ্মকালে কারখানার চারপাশের তাপমাত্রা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। ফলে চরম অস্বাস্থ্যকর-অস্বস্তিকর পরিবেশে দিন যাপন করতে হয় এলাকাবাসীর।

বিজ্ঞাপন

শুধু তাই নয়, ওই কারখানাটিতে নেই কোনো পরিবেশবান্ধব ‘এফ্লয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ (ইটিপি)। এ কারণে কারখানাটি থেকে উৎপাদিত তরল বর্জ্য ও দুষিত পানি অপরিশোধিত না করেই ছেড়ে দেয়া হচ্ছে নালায়। যা সরাসরি গিয়ে পড়ছে কৃষি জমিতে। এভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন খাল-বিল ও নদী-নালায়। পাশাপাশি এই বিষাক্ত পানি এলাকার বিভিন্ন পুকুরে গিয়ে পড়ায় মারা যাচ্ছে চাষ করা মাছও।

ভুক্তভোগী কৃষকদের অভিযোগ- সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বড়গাঁও গ্রামবাসী। গ্রামের আশপাশের অন্তত শতাধিক একর ফসলি জমি গত দুই বছর ধরে অনাবাদী পড়ে রয়েছে। চাষাবাদ না করতে পেরে মানবেতর জীবন কাটছে বড়গাঁও গ্রামের অন্তত দুইশ’ সংখ্যালঘু পরিবারের। বন্ধ হয়ে পড়ছে ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়াও। বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল কৃষি জমি হারিয়ে পথে বসার উপক্রম পরিবারগুলোর।

ভুক্তভোগী রাজু দেব বলেন- ‘কোম্পানিটির দুষিত বর্জ্যে জমির মাটি কালো বর্ণ ধারণ করেছে। বিনষ্ট হয়েছে জমির উর্বরতা শক্তি। যে কারণে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে ফলন।’

কারখানার বর্জ্যে জমি বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে/ছবি: বার্তা২৪.কম

তিনি বলেন- আগে যে জমিতে একর প্রতি ২০/২৫ মন ধানের ফলন হতো, এখন সেখানে হচ্ছে ২/৩ মন। আবার কোনো কোনো জমিতে ধানের চারাই গজাচ্ছে না। প্রায় দুই বছর ধরে এ অবস্থা চললেও বিষয়টি সমাধানে এগিয়ে আসছেন না কেউই। উল্টো বিচার চাওয়ায় এলাকার কিছু প্রভাবশালী আমাদেরকে এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেন।

ধিরেন্দ্র দেব নামে এক কৃষক বলেন- শুধু ফসলি জমি নয়, বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, গৃহপালিত হাঁস-মোরগ, গরু-ছাগল, খাল-বিল ও পুকুরের মাছ মরে যাচ্ছে। চাষাবাদ করতে জমিতে নামলে কোম্পানির পানির সাথে ভেসে আসা বর্জ্যে হাত-পা কেটে যায় আমাদের।

রাসায়নিক বর্জ্যে জমির মাটি কালো রং ধারণ করেছে/ছবি: বার্তা২৪.কম

জানতে চাইলে ‘রাসা ক্যামিকেল লি.’-এর ম্যানেজার সোহাগ মিয়া বলেন- এটি একটি ছোট কোম্পানি। এখানে শুধু সোডা ও বালি দিয়ে একপ্রকার ‘গাম’ তৈরি করা হয়। কিন্তু বাজারে এর চাহিদা না থাকায় কোম্পানিটি লোকসানের মুখে পড়েছে। তাই ‘ইটিপি’ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি দাবি করেন- নির্গত তরল বর্জ্যে কোনো দুষিত পদার্থ নেই। তাই কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। এছাড়া কোম্পানির আশপাশের সকল জমিই আমাদের। তারপরও আমরা বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করব।

এ ব্যাপারে বাহুবল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ খলিলুর রহমান বলেন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমি উভয়পক্ষকে নিয়ে আমার কার্যালয়ে বসেছিলাম। কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা শিগগিরই বিষয়টি সমাধান করবে।