ফসলি জমির উর্বর মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়
সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হবিগঞ্জে প্রতিনিয়ত ফসলি জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি পাচার হচ্ছে ইট ভাটাগুলোতে। এতে কৃষি জমিগুলো উর্বরতা কমায় ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করতে হচ্ছে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। তবু পাওয়া যাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত ফলন। জমির মালিকরা বলছেন, ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে মাটি। ভাটা মালিকদের দাবি কৃষক বিক্রি করছে তাই কিনছেন তারা।
জানা যায়, হবিগঞ্জে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে অন্তত শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। এসব ভাটায় ইট তৈরি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলি জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি। জেলা সদর, চুনারুঘাট ও বাহুবল উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন খননযন্ত্র দিয়ে শতশত গাড়ি মাটি নেয়া হচ্ছে ইটভাটায়। বিভিন্ন সময় প্রশাসনের অভিযানে জেল-জরিমানা করা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ফসলি জমি থেকে মাটি বিক্রি।
কৃষকদের দাবি- ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে মাটি বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। এছাড়া নিচু জমি নয়, যেসব জমিতে পানি উঠছে না বা চাষাবাদের অনুপযোগী সেগুলোতে চাষাবাদের উপযোগী করে তুলতে তারা বিক্রি করছেন মাটি।
এ ব্যাপারে কৃষক আব্দুল আওয়াল বলেন- ‘এক কের (২৭/৩২ শতক) জমিতে ধান চাষ করলে ৮/১০ হাজার টাকা ধান পাওয়া যায়। আর ওই জমির মাটি বিক্রি করলে পাওয়া যায় ২৫/৩০ হাজার টাকা। তাই সংসার চালাতে চাষাবাদ না করে মাটি বিক্রি করতে হচ্ছে।’
সদর উপজেলার যাদবপুর গ্রামের শিক্ষক অনিল মাস্টার বলেন- ‘আমার অনেকগুলো জমি উঁচু হয়ে গেছে। সেই জমিগুলোতে পানি উঠে না। তাই জমি নিচু করে চাষাবাদের উপযোগী করে তুলতে ইট ভাটায় মাটি বিক্রি করতে হচ্ছে।’
মোহাম্মদ সাজিদুল মিয়া নামে এক কৃষক বলেন- ‘আমার জমির চারপাশের মালিকরা মাটি বিক্রি করায় আমার জমি অনেক উঁচু হয়ে গেছে। ফলে আমার জমিতে এখন আর পানি উঠে না। তাই বাধ্য হয়ে মাটি বিক্রি করতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন- ‘এছাড়া বর্তমানে ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায় না। তাই অনেক জমি পতিত রয়েছে। সেগুলো থেকে কিছু মাটি বিক্রি করতে হচ্ছে।’
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইট ভাটার মালিক বলেন- ‘অনেক কৃষক জমির মাটি বিক্রি করতে আমাদের কাছে আসেন। তাই আমরা কিনি। কোনো জমির মালিক বলতে পারবে না যে আমরা জোর করে মাটি নিচ্ছি।’
‘ফসলি জমি থেকে মাটি ক্রয়-বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তাহলে আপনার কেনো আইন অমান্য করছেন’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- ‘প্রতি বছর সরকারকে প্রচুর পরিমাণ ট্যাক্স দিয়ে আমরা ব্যবসা করি। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসনকেও টাকা পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়।’
বাহুবল উপজেলা ব্রিকস ফিল্ড মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহীন মিয়া বলেন- ‘অনেক কৃষক আমাদের কাছে এসে বলেন আমার জমিটা উঁচু হয়ে গেছে। আপনারা আমাদের মাটি কিনে আমাদের জমিটা বাঁচান। তাদের অনুরোধে অনেক সময় ভাটা মালিকরা ফসলি জমি থেকে মাটি কিনেন। না হলে কোনো ভাটা মালিক ফসলি জমি থেকে মাটি কেনেন না।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর হবিগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন- ‘ফসলি জমি থেকে প্রতিনিয়ত মাটি বিক্রির কারণে দিন দিন উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ফলে দেখা দিতে পারে খাদ্য সংকট। পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশও। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’
হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক তমিজ উদ্দিন খাঁন বলেন- ‘ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি অত্যন্ত উর্বর। এই উর্বর মাটি বিক্রির কারণে অধিক হারে কমে গেছে উৎপাদন। ফলে অর্জিত হচ্ছে না লক্ষ্যমাত্রা।’
তিনি বলেন- ‘উপরের যে উর্বর মাটি বিক্রি হচ্ছে, সেই মাটি পুনরায় তৈরি হতে সময় লাগে ৩/৪ বছর। কিন্তু অনেক কৃষক না জেনে মাটি বিক্রি করছেন আবার অনেকে জেনেও বিক্রি করছেন। এ ব্যাপারে আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন- ‘প্রতিনিয়ত মাটি বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। যখন যেখানে খবর আসে ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে সেখানেই অভিযান চালানো হয়।’