কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৬)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

অই তো যায়, টু আ পেনি

[পূর্ব প্রকাশের পর] আমাদের পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, আমরা উদ্বিগ্ন পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে চিঠি পেতে শুরু করি। তার সব ক’টার সুরই এক। “তোমরা নিশ্চয়ই দেশ ছাড়তে পেরে খুব খুশি! তা তোমাদেরকে কবে নাগাদ আমরা আমেরিকায় আশা করতে পারি?”

কিন্তু আমাদের কারুরই আমেরিকার দিকে যাত্রা করার বাসনা ছিল না। আমরা এমনিতেই পূর্ব পাকিস্তান ছাড়তে চাইনি, আর আমাদের মধ্যে যাদের পুনঃপ্রবেশের ভিসা ছিল না, তারা আর কোনোদিন ফিরতে না পারার আতঙ্কে ছিল। আমরা জানি প্রভুই আমাদেরকে বাইরে নিয়ে এসেছেন, যদিও আমরা বুঝিনি এর পেছনে তাঁর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আমরা শুধু এটুকু জানি, আমরা সবাই ফিরতে চাই, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

যুদ্ধবিদীর্ণ দেশটিতে আমরা আমাদের বাড়িঘর, জিনিসপত্র, বন্ধুবান্ধব এবং আমাদের হৃদয়খানি ফেলে এসেছিলাম।

আমরা মেয়েরা যখন কেনাকাটায় আর বাচ্চাদের ফুর্তিতে রাখার প্রচেষ্টায় আনন্দেই ছিলাম, পুরুষেরা তখন আমাদেরকে ব্যাংককের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত ছিল। পরিস্থিতির জটিলতা ছিল বহুমাত্রিক। তিনটি পরিবারের কিশোরবয়সী বাচ্চারা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের মারিতে। আমরা ব্যাংককে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই, আমাদের দলের যারা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল তাদের কাছ থেকে এরকম চিঠি পেতে শুরু করি যে, কিছু বাচ্চা খুবই আতঙ্কিত হয়ে আছে এবং তারা তাদের বাবামাকে পাশে চাইছিল। যাদের কোনো বাচ্চা ছিল না সেখানে, তাঁরা একগাদা পয়সা খরচ করে সেখানে গিয়ে বেকার বসে থেকে, পূর্ব পাকিস্তানে ফেরার অনুমতি পাবার প্রত্যাশায় দিন গোনার সম্ভাবনায় খুব একটা প্রীত ছিলেন না।

যদিও আমাদের পাকিস্তানে ফিরে যাবার একমাত্র সম্ভাবনা, যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী দেশত্যাগীদের একসঙ্গে দলবেঁধে থাকার মধ্যেই নিহিত ছিল। আমাদের যুক্তি ছিল, যেহেতু তারা আমাদের দেশ ছাড়ার জন্য উৎসাহিত করেছিল, সেহেতু নিশ্চয়ই তারাই আমাদেরকে আবার ফিরিয়ে নিতে সাহায্য করবে। তবে এটা তত সহজ ছিল না। আমেরিকার সরকার যতটা করার করছিল, কিন্তু পাকিস্তান সরকার আমাদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না। আমরা তাদের সেই মিথ্যে বুদ্বুদখানি ফাটিয়ে দিয়েছিলাম, “পূর্ব পাকিস্তানে সব স্বাভাবিক রয়েছে।”  যদি সব স্বাভাবিকই থাকত, তাহলে মার্কিন সরকার কেন সবাইকে বিশেষভাবে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিল?

এই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয় এই তথ্যটুকুও যে, আমাদের অর্ধেকেরও বেশির ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। এমনকি স্বাভাবিক অবস্থাতেও আমাদের ফিরতে অসুবিধা হবার কথা।

শহরে আমাদের ঘোরাঘুরির সময় আমরা প্রায়ই পাকিস্তান দূতাবাসের পাশ দিয়ে যেতাম। প্রতিবারই তার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মেল বিল্‌স প্রাণভরে একবার বলে উঠতেন, “জয় বাংলা”। তাঁর স্ত্রী মার্গি, এটা শত্রুর কানে গিয়ে পৌঁছানর ভয়ে এবং তা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে ভেবে তার স্বামীকে তা বলা থেকে বিরত রাখতে চাইছিল।

“ঠিক আছে,” তিনি রাজি হন। “আমি চুপ থাকব, ভেতরে কিন্তু ঠিকই এটা উচ্চারণ করব।”

জে ওয়াল্‌শ ও মেল বিল্‌স মার্কিন দূতাবাস আর পাকিস্তান দূতাবাসের মধ্যে ছোটাছুটি করছিলেন কেবল। পরেরটাতে প্রভু আমাদের পক্ষে ছিলেন। যার দায়িত্ব ছিল এই অনুমতিপত্র প্রস্তুতের, তিনি ঢাকার মানুষ ছিলেন বলে। জে একটু হালকা বোধ করায় তাঁর সঙ্গে বাংলায় কথাবার্তা শুরু করেন। বাঙালি অফিসারের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং তিনি গলা নিচু করে গোপনে তাঁর কাছে দেশের অবস্থা জানতে চান। এরপর থেকে তিনি তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন আমাদের সাহায্য করতে, যদিও তাঁর শ্রেষ্ঠটাও আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল না। চূড়ান্ত অনুমোদন আসবে ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তর থেকে।

আমেরিকান পর্যটকেরা থাইল্যান্ডে মাত্র পনেরোদিন থাকতে পারত। তারপর তাদেরকে দেশ ছেড়ে আবার নতুনভাবে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হতো। আমাদের পনেরোদিন অতিবাহিত হবার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিই আমরা পেনাং দ্বীপে একটা ছোটখাটো ছুটি কাটাব। আমরা যখন বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য বাসে উঠছিলাম তখন সেখানকার এক কর্মচারী জে-কে বার্তা পাঠান। এই বার্তা আমাদের আনন্দময় ভ্রমণের অনুকূল ছিল না। মার্কিন সরকার এইমাত্র তাদের ইসলামাবাদের পাল্টাপক্ষের কাছ থেকে একটা টেলেক্স পেয়েছেন এই নির্দেশসহ যে, আমরা যেন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবেশের চেষ্টাও না করি। সেই অংশ থেকেও মিশনারিদের বার করে দেওয়া হচ্ছিল।

তখন প্রভু ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না আমাদের। আমাদেরকে অ্যাসেম্বলি অভ গড মিশনারিদের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হলো, যারা বলতেন, “যখন তোমাদের মনে হয় যে, প্রভু ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার নেই, তার অর্থ হচ্ছে খাবার ছাড়া আর কিছু খাওয়ার নেই তোমাদের।”

আমরা ঈশ্বরের কাছেই গিয়েছিলাম। আমাদের ব্যক্তিগত এবং দলীয় প্রর্থনাগুলোতে আগের মতো আর বলছিলাম না, “প্রভু আমাদেরকে ফিরিয়ে আনুন,” বরং অনুরোধ করছিলাম, “প্রভু আমাদেরকে বলে দিন আপনি কী চান, আমরা তা-ই করব।”

জে যাদের সঙ্গে ছিলেন তারা আমাদের যাওয়ার কয়েকদিন আগে ব্যাংকক ফিরে গেল। তিনি সবে ফিরেছেন, অমনি পাকিস্তানি দূতাবাস তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে বার্তাটা দেখালেন, “এই মানুষগুলোকে পাকিস্তানে ঢোকার ব্যাপারে যা করার করুন।”

জে গোটা ব্যাপারটা দ্রুতই আন্দাজ করে ফেললেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের মনে আসলে একটা সাধারণ ভ্রমণ অনুমতির বিষয়টাই ছিল, যার মাধ্যমে বাবা-মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদেরকে তুলে নিয়ে আবার বেরিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু তিনি কর্মকর্তাকে দিয়ে এর এমন এক ব্যাখ্যা করালেন, যার অর্থ দাঁড়ায়, “এদের সবাইকে চার বছরের জন্য বহুপ্রবেশ ভিসা দেওয়া হোক।”

আবারও ঈশ্বর আমাদের এই বিশ্বাসের প্রতিদান দিলেন তাঁর উপহারের ঝুলি খুলে। আমাদের প্রত্যেককে, যাদের স্রেফ একটি ভিসাই দরকার ছিল, এমনকি যাদের ভিসার মেয়াদ ফুরোয়ওনি, তাদেরকে সুদ্ধ সব ভিসার সেরা ভিসাটি দেওয়া হলো। সেই চার বছরের বহুপ্রবেশ ভিসাটির অর্থ হলো, আমরা ভিসা নবায়ন না করেই আগামী চার বছর যতবার ইচ্ছা আসাযাওয়া করতে পারব। আমাদের কোনো কোনো নবাগত মিশনারি জীবনেও এটা পাননি, কেননা পাকিস্তানে আসার আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁরা এটা নিয়ে আসতে পারেননি।

জে আমাদেরকে পেনাংয়ে ফোন করে সুখবরটা দেন এবং আমরা এই পুরস্কার গ্রহণের উদ্দেশ্যে ফিরতি বিমান ধরি সঙ্গে সঙ্গেই। মে মাসের ১৭ তারিখ জে আমাকে, লিনকে আর বেকিকে নিয়ে যান আমাদের পাসপোর্টে ভিসার সিল মারাতে। ফেরার পথে আমেরিকান দূতাবাসে দাঁড়ালে তখনকার কর্তব্য কর্মকর্তা জে-র দিকে তাকিয়ে বলেন, “এই লোক একেবারে চাঁদের দিকে তির ছোড়েন, তাই না?” তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলেন, “আপনার মনে হয় ওপরে কেউ আছেন আপনার হয়ে কাজ করার জন্য।”

আমাদের ভিসা ও টিকিটের জন্য অপেক্ষা করার সপ্তাহগুলোতে আমরা পত্রিকার খবর গিলছিলাম এবং যে-কেউ পাকিস্তানের ওপর কোনো খবর পড়তে থাকলে অভদ্রের মতো তার কাঁধের ওপর হুমড়ি খেযে পড়ছিলাম। নিউজ উইকের ২৬শে এপ্রিল সংখ্যার এই ধরনের খবরের বিশেষ গুরুত্ব ছিল আমাদের কাছে।

… নিষ্ঠুরতার জন্য কুখ্যাত একটি গৃহযুদ্ধে, ঝটিকা আক্রমণগুলো পরিচিত ছিল তাদের বর্বরতার জন্য। বন্দর নগরী চট্টগ্রামে, পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বন্দিদের জোরপূর্বক ট্রাকে তুলে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে বাধ্য করে—যেটা ছিল তাদের প্রিয় শ্লোগান। এই শ্লোগান শুনে লুকিয়ে থাকা বাঙালিরা বেরিয়ে এলে, তাদেরকে নির্বিচারে মেশিনগানের গুলি করে মারে। সিলেট ও কুমিল্লা শহরে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যেরা শত শত বাঙালি কৃষকদের লাশ ফেলে রাখে যত্রতত্র শকুন ও কুকুরের খাদ্য হবার জন্য।

আমরা খবর পাই প্রতি দিন প্রায় এক লাখের মতো বাঙালি শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করছে। সেইসব হাজার হাজার শরণার্থীর বহন করে নিয়ে যাওয়া হাজারো ট্রাজেডির গল্প শুনি আমরা: বাচ্চাদের সামনে বাবা-মাকে হত্যা করা; বাচ্চাদের ওপরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সৈন্যদের বেয়নেটের ডগায় গেঁথে নেওয়া; কমবয়েসি মেয়েদের জোর করে যৌনদাসী করে রাখা; পুরুষদের চোখ উপড়ে ফেলে পিটিয়ে মারা ইত্যাদি।

এইসব নির্মমতার কথা জেনে বরং আমাদের ফেরার ইচ্ছা আরও প্রবল হয়, যাতে করে আমরা তাদের সাহায্য করতে পারি। তবে সেদিনের সেই অসহ্য গরমে ব্যাংককের রাত্রিতে প্রার্থনারত অনেকেই অনুৎসাহিত ছিল এতে। কিন্তু আমাদের তো পর্বত-চূড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শুনেছেন, আমাদের হাতে ভিসা এসে গেছে।

আমাদের দলের অর্ধেক সিদ্ধান্ত নেন মাঝখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ছোট্ট বিরতি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার। মালুমঘাট ছাড়ার পর চৌত্রিশজনের আমাদের এই দলটি গত পাঁচ সপ্তাহ ধরে এতটা সময় একসঙ্গে ছিলাম যে, এমনকি ছোট্ট বারো বছর বয়সী ফিলিপ ওয়াল্‌শও, প্রথম দলের সদস্য তার পরিবারের হাত ধরে অনিচ্ছুকভাবে বলে, “আমি সত্যি মনে করি না আমাদের দল ভাঙা উচিত।”

আমরা যারা ব্যাংককে ছিলাম তারা এই সংবাদ শুনে উল্লাস করি যে, ঢাকার যাত্রাবিরতিতে ডাঃ ওল্‌সেন তাঁর নিজের পরিবার, ওয়াল্‌শ ও কেচামের পরিবারকে অভ্যর্থনা জানান এবং পূর্ব পাকিস্তানে তাঁরা কোথায় থাকবেন তার একটা ছকও আঁটেন। তাঁরা সবাই ফিরে গেছেন, আর আমরা এখানে এই গরম, গুমোট ব্যাংককে আটকে আছি।

পাকিস্তানি দূতাবাস প্রতিজ্ঞা করে যে, ঢাকা প্রত্যাবর্তনের অনুমতি আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের খবর দেবে। কিন্তু অনেক কটা দিন কেটে যায়, কোনো খবর আসে না। ২৯শে মে শুক্রবার মেল বিল্‌স দূতাবাসে আশ্রয় নেন, কিন্তু দুপুরের পরেই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। মুসলিম দেশগুলোতে শুক্রবার দুপুরেই অফিস বন্ধ হয়ে যায়, আর কোনো সরকারই শনিবার ও রবিবার খোলা থাকে না। সেখানে কোনো সম্ভাবনাই ছিল না যে, আমরা রবিবার বিকালের বিমান ধরতে পারব।

আমরা আসলে ৩১শে মে রবিবার রাতে ইভাঞ্জেলিকাল চার্চ অভ ব্যাংককে শুরু হতে যাওয়া বিলি গ্রাহামের ছবি টু আ পেনি দেখার ওপর একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলাম, কেননা ততদিনে আমাদের কাছে কেনাকাটা করা, চিড়িয়াখানায় যাওয়া এমনকি সুইমিং পুলে সাঁতার কাটাও আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল।

প্রার্থনার সময় অনেকেই স্বীকার করেছিলেন যে, আমাদের বিশ্বাস একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছিল। অন্যেরা ইতোমধ্যেই ফিরে গেছেন, তাহলে আমরা নই কেন? ঈশ্বর কি তাহলে চাইছিলেন না যে, আমরা ফিরে যাই? এতগুলো সপ্তাহ এখানে বেকার বসে থাকার পর আমাদেরকে কি তাহলে যুক্তরাষ্ট্রেই ফিরে যেতে হবে? আমরা কি তবে মিশনের পরিচালনা পর্ষদের এই পরামর্শকেই মেনে নেব যে, আমাদের মধ্যে যারা স্বাস্থ্যকর্মী তাদের ফিলিপিন্সে গিয়ে স্বাস্থ্য-কর্মসূচিতে কাজ করা উচিত? লিন সে-রাতে বিশেষ কিছু বলেনি। সে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছিল আগেই: ঈশ্বর আমাদেরকে ফিরিয়ে নেবেন, এই রবিবারেই!

ব্যাংককের ইভাঞ্জেলিকাল চার্চ প্রথমে তাদের প্রার্থনাসভার আয়োজন করে, তারপর সংক্ষিপ্ত বিরতি দিয়ে, রবিবারের স্কুলের ক্লাসগুলো চালায়। সকালের অধিবেশনের উপসংহারে পাদ্রি একটা বার্তা পড়ে শোনান, “এখানে যদি ডাঃ কুক বলে কেউ থাকেন, তাহলে তাঁকে ফোনে ডাকা হচ্ছে।” আমাদের ড. ডিকুক ভাবেন নামটা যথেষ্ট কাছাকাছি, তাই তিনি দৌড়ে গিয়ে সবচেয়ে কাছের যে-ফোন সেটা ধরেন। আমরা তখন রবিবারের স্কুলের উদ্বোধনী প্রার্থনাসংগীত গাইতে শুরু করে দিয়েছি, যখন তিনি আকর্ণবিস্তৃত হাসি নিয়ে ফিরে আসেন। বাকি জমায়েতকে একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা প্রদান করে আমরা দ্রুত হেঁটে, বলা চলে প্রায় উড়ে, চলে যাই লবিতে।

বেচারা জো ডিকুক গল্পটা একটু রসিয়ে বলারও সময় পেলেন না। পাকিস্তান এয়ারলাইন্স এতগুলো যাত্রী হারাতে চায় না বলে সরকারি কর্তৃপক্ষের ওপর বিশেষ চাপ প্রয়োগ করে। দেশে প্রবেশের অনুমতি এসে পৌঁছেছে পিআইএ অফিসে। আমরা কি বিকাল ৫টার মধ্যে তৈরী হতে পারব? পারব আমরা? অর্ধেক মহিলা ততক্ষণে লিফটে ঢুকে গেছেন প্রায়, হোটেল ত্যাগ করার জন্য, ইভাঞ্জেলিকাল চার্চ তাদের সভাটি হোটেলেই করেছিল। আমি আরো এক তলা সিঁড়ি ভেঙে বাচ্চাদেরকে ক্লাস থেকে বার করে আনি এবং জুনিয়র ক্লাসের ছাত্রদেরকে অন্যদের বিরক্ত না করে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত করি। তারা আমার সঙ্গে হলঘরে এসে দেখা করে।

“ব্যাপার কী?” দশ বছর বয়সী ড্যানি জিজ্ঞাসা করে।“

আমরা আজ বিকালে বাড়ি যাচ্ছি, ড্যানি।” আমি উত্তর করি।

“বাড়ি? মানে আমরা পাকিস্তান ফিরে যাচ্ছি? কী মজা! আমাকে ক্লাসে ফিরে গিয়ে সবাইকে তা বলতে হবে। তারা সবাই প্রার্থনা করছিল যেন আমরা ফিরে যেতে পারি।”

আমাদের প্রার্থনার এমন ইতিবাচক উত্তরের অভিঘাত আমাদের মধ্যে দৃশ্যমান হয়, আমরা যখন অতগুলি সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত নেমে আসি।

“অই যায়, টু আ পেনি!” আমরা ট্যাক্সিতে ওঠার সময় ড্যানি বলে ওঠে। [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৫)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৪)

কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৩)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১২)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১১)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১০)

 

 

   

গড়তে চান বই পড়ার অভ্যাস?



মোঃ শরীফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

  • Font increase
  • Font Decrease

লাইব্রেরিগুলো আজকাল ফাঁকা পড়ে থাকে। ক্যাম্পাসের আড্ডায় বই, সে বড়ই হাস্যকর! বই পড়ার মতো সময় হয়ে ওঠে না কারোরই! আমাদের বর্তমান সময়টা কেড়ে নিয়েছে মোবাইল আর ইন্টারনেট। অথচ বই পড়ার গুরুত্ব কমবেশ সকলেরই জানা।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য বই কতটা জরুরি সেটা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু একটি বই পড়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন, প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঠিক বই নির্বাচন।

বই পড়া শুরুর ক্ষেত্রে নতুন পাঠকরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পেরে অনেকের আর বই পড়াই হয় না। আজকের আলোচনায় আমরা জানব কীভাবে একটি বই পাঠ করা যায়, গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস।

সময়: বই পড়ার কথা বললেই সবাই এক বাক্যে বলবে, ‘সময় নেই!’ সময় নিয়ে আমাদের অভিযোগের বড় কারণ হলো, নিজের কাজগুলো গুছিয়ে না করা। প্রতিদিন মাত্র ২০-৩০ মিনিট সময় দিয়েই কিন্তু গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস। সময় না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া। তাই, সকাল কিংবা সন্ধ্যা হাতের ফোনটা দূরে সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসে যান বই নিয়ে।

পরিবেশ: উপযুক্ত পরিবেশ বই পড়ার মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। জানালার পাশে, বেলকনিতে কিংবা বাসার ছাদে বই পড়ার স্থানটি যেন হয় নির্জন এবং শান্ত। আজকাল বিভিন্ন পার্কে ‘নীরব বই পাঠ কর্মসূচি’ দেখা যায়। চাইলে যোগ দিতে পারেন তাঁদের দলেও। বই পড়ার পাশাপাশি পরিচয় হবে বইপ্রেমী মানুষদের সাথে।

বই নির্বাচন: বই পড়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছে যেমন জরুরি তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক বই নির্বাচন। এক্ষেত্রে নিজের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিন। যেসব গল্প আপনাকে আকর্ষণ করে শুরুতে সেই বইগুলোকেই আপনার পাঠ্য তালিকায় রাখুন। 

পাঠাগার: পাঠাগারে গেলেই যে বই পড়তেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বইয়ের সাথে সময় কাটালে এক সময় সেটা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হবে। আর ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে কখন যে দু’য়েক পাতা পড়ে ফেলবেন, নিজেই টের পাবেন না! তাই বই পড়ার অভ্যাস গড়তে চলে যান পাঠাগারে। বই না পড়ুন, অন্তত সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা তো হবে!

সোশ্যাল মিডিয়া: আমরা সবকিছুতেই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার সুষ্ঠু ব্যবহার আপনার অভ্যাস গড়ার বড় সহায়ক। ফেসবুকে সাহিত্য তথা বই বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা হয়, হয় বই বিষয়ক আড্ডাও। এসব গ্রুপে যুক্ত হয়ে বাড়াতে পারেন বইয়ের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা।

ধারাবাহিকতা: বলা হয়ে থাকে টানা ২১ দিন কোনো কাজ করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। বই পড়ার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। অভ্যাস গড়তে হলে ধরে রাখতে হবে ধারাবাহিকতা। সামান্য হলেও প্রতিদিন পড়ুন। এই ধারাবাহিকতায় আপনার বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করবে। 

বই পড়ার অভ্যাস রাতারাতি তৈরি হবে না। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়। নতুন পাঠকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছুদূর পড়ার পর বইটি আর ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যহারা হওয়া যাবে। জোর করে সে বই পড়ার প্রয়োজন নেই।

বই মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। বই পড়ার অভ্যাস গড়তে পারলে জীবনে উন্নতি সাধন অবধারিত। একাডেমিক পড়ার বাইরেও বইয়ের বিশাল একটি জগত রয়েছে। সেই জগতে মানুষ জানার জন্য পড়ে, পড়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য। বই পড়লে মানসিক চাপ হ্রাস পায়, হয় মস্তিস্কের ব্যায়াম, বাড়ে শব্দ ভান্ডার ও স্মৃতি শক্তি। বই পাঠকের চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করে, বৃদ্ধি করে বিশ্লেষণ ক্ষমতা। বই পড়ার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়। তাই বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু এবং বইয়ের সঙ্গে হোক আমাদের মিতালি।

;

মায়ের সমাধির খোঁজে



মহীবুল আজিজ
মায়ের সমাধির খোঁজে

মায়ের সমাধির খোঁজে

  • Font increase
  • Font Decrease

কন্ডাক্টরকে বললাম, এখানে নামিয়ে দিন,
এখানে এই মিয়াপাড়ায় আমি নামবো—
মিয়াপাড়া কবরস্থানে শুয়ে আছে আমার মা।
মায়ের কবর দেখতে এলাম আটান্ন বছর পরে,
জ্যাঠা বলেছিলেন, গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটু গেলে
একটা গোলাপ গাছ ঘেঁষে কবরটা,
কবরের আগে আমাকে গোলাপ গাছ খুঁজতে হয়—
জ্যাঠা চলে গেছেন তা-ও বত্রিশ বছর।
ডানদিকে ঘুরতেই জড়িয়ে ধরে তাজা গোলাপের ঘ্রাণ,
পাশাপাশি চারটা কবর, চারটাতেই গোলাপের পাহারা;
এত কবর এত কবর, কবরে ভর্তি কবরস্থান—
কোথায় শেষ শয্যা নিয়েছিলেন আমার মা!
হাওয়ায় পাতা দোলে গোলাপের, চারটাই একসঙ্গে,
চারটা গাছ থেকেই মুখবাড়ানো গোলাপ ডাক দেয়—
এইখানে এইখানে এইখানে—কোন্খানে!
উবু হবো কবরের মাটি নিতে
কিন্তু চারটাই ডানদিকে, চারটাই গোলাপের পাশে,
প্রতিটি কবর থেকে একটি একটি মুঠো নিয়ে
পলিথিনের চারটে ব্যাগে রাখি।
একবার মনে হয় প্রথমটাতে,
তারপর মনে হয় দ্বিতীয়টাতে,
আবার মনে হয় তৃতীয়টাতে
এবং মনে হয় চতুর্থটাতে সন্ধান রয়েছে মায়ের।
মা সুপ্ত থেকে যান অনির্দিষ্ট মাটিতে ,
তবে কোন্ মানবের মাটি ধরে রাখি বুকের কাছে!
ঠিক তখন বিস্ময়ের মতন একটি ফুটন্ত গোলাপ
গাছ থেকে ঝরে পড়ে দ্বিতীয় কবরে,
সংশয়ী মন বলে, তবে কী গোলাপই বার্তাবহ মায়ের!
অদৃষ্টে অবিশ্বাসী মন দোলে সংশয়ে,
তখন আরেকটি গোলাপ ঝরে পড়ে চতুর্থ কবরে।
অর্থাৎ দুই যোগ দুইয়ে এসে আমার আর হিসেব মেলে না,
জ্যাঠা বলেছিলেন, কবরটা গেটের ডানদিকে ঘুরতেই
এবং গোলাপের পাশে।
বত্রিশ বছরে চতুর্গুণ হয়েছে গোলাপ
কিন্তু এক ও অবিভাজ্য আমার মা’কে
এই গোলাপের কারণেই খুঁজে পাই না আমি—
ফিরে আসি শুধু গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে।

১১-০৯-২০২৩

;

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল



শরীফুল আলম
অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আমি সীজার হতে চাইনি
তবুও তুমি ক্লিওপেট্রাই থেকে গেলে
অহেতুক লড়াইয়ে তুমি জয়ী হতে চেয়েছিলে
সম্ভবত একেই পরিযায়ী প্রেম বলে
আলো আঁধারীর খেলা বলে
স্বপ্ন আর জেগে থাকা বলে ,
সমাপ্তি কিম্বা বিবিধ, তা সে যাই হউক
এই সহজ কথাটি
আমরা কেউ কাউকে সহজ ভাবে বলতে পারিনি
অথচ তুমি ফ্রিজিডেয়ারটি বন্ধ করে রাখলে
আর বললে, "নোটেড ",

নিউইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
হ্যাঁ, এটাই সত্যি
তুমি লৌহশৃংখলে অনুজ্জ্বল এক ডিমলাইট
সুচারু মোহের অভাবে তুমি প্রমত্তা নদী
বাবুই পাখীর বাসার ন্যায় তুমি ঝুলে থাক আমার স্বপ্নে
যা হতে পারতো নির্মল এক সবুজের প্রান্তর ।

তুমি ওঁত পেতে থাকা বাঁশপাতার ফাঁকে পূর্ণিমা
আমি তোলপাড় করে ছুটে চলা এক্সপ্রেস ট্রেন
দলছুট শালিক,
আজ কোন বৈভব নেই
ভালোবাসাবাসি নেই ,
কবিতাও ইদানিং প্রিয় লাগেনা
তবু স্নায়ুরা জেগে থাকে
মনে হয় হলুদ পাতায় যেন ক্লোরোফিল
আমিও প্রবণতায় ফিরে যাই সাইবেরিয়া ।

আনচান মনে কত আকুলতা
কালবৈশাখীর তান্ডব
যেন বাতাসে কাঁপন ধরে,
এসো সখা,
এই শ্রাবণে আবার রিডিজাইন করি,
স্যাটেলাইটে প্যারালাল বার্তা পাঠাই
ভুলে যাই অর্ধেক রিয়েল আর অর্ধেক ভুল
প্লাবনে অবাধ্য ঢেউয়ের উছ্বল ।

________________________________________

 ৯ সেপ্টেম্বর । ২০২৩।
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

 

;

পাট পাতার পেলকা সজনে শাকের শোলকা



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সোনালী আঁশ বা পাটের দেশ বাংলাদেশ। এক সময় আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। পাটোয়ারী পরিবারগুলো তো বটেই মৌসুমি পাটের ব্যবসায়ীরাও সমাজে মযার্দা পেত। কারণ, যারা পাটের ব্যবসা করতেন তাদের হাতে থাকতো প্রচুর টাকা। তখন পাটকলে যারা চাকরি করতেন তাদের পরিবারেরও অনেক সচ্ছলতা ছিল। নাইলন ও পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হলে পাটের গুরুত্ব কমে যেতে শুরু করে। পাটের চট, রশি, শাড়ি আজকাল কেউ ব্যবহার করতে চায় না। দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলগুলোর বড় বড় যন্ত্রপাতি মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরুতে পাট শাকের চাহিদা বেড়ে যায়।

কারণ, পাট পাতার বহুবিধ গুণ। পাট শাক তেতো ও মিষ্টি দুটোই সমভাবে মানুষের কাছে প্রিয়। পাট শাক দিয়ে তৈরি এক ধরণের জনপ্রিয় খাবারের নাম ‘পেলকা’। এই পেলকা ভাজা চালের গুঁড়ো, খাবার সোডা, কাঁঠালবিচি, গোটা রসুন ও কাঁচা মরিচ দিয়ে মিশিয়ে তৈরি করে সাদা ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এই রান্নায় নানা ধরণের মশলা ব্যবহার করা হয়। যেগুলো বেশিরভাগ ঘরে তৈরি ভাজা উপকরণের ঢেঁকিছাটা সুগন্ধি গুঁড়ো বা শিলপাটায় পেষানো মিহি মশলা। সাধারণত: পেলকা ও শোলকা রান্নার আগে সরিষা, মেথি, ধনে, মৌরি, কালোজিরা ইত্যাদি ভেজে এই বিশেষ মশলা তৈরি করা হয়। সবকিছুর সংমিশ্রণে ভারী স্যুপের মতো করে সবুজ রংঙের এই রান্না সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। যার ফলে পেলকার স্বাদ হয় খুবই অনন্য ও লোভনীয়।

অনেকে পাটের মৌসুমে পেলকা খাওয়ার লোভে শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এই বিশেষ রান্নার আয়োজন করতে বায়না ধরে থাকেন। অনেকে পাট শাকের শুকতানি তৈরি করে শুকিয়ে সারা বছরের ভেষজ খাবার হিসেবে যত্ন সহকারে ঘরে সংরক্ষণ করেন। গ্রামের অনেকের কাছে পাট শাকের শুকতানি ভেজা পানি নানা রোগের মহাষৌধ হিসেবে বিবেচিত। অধুনা শহরের বহুতল ছাদ বাগানে পাট শাকের আবাদ করতে দেখা যাচ্ছে।

আরেকটি বিশেষ খাবারের নাম শোলকা। যেটি কচি সজনে পাতা দিয়ে তৈরি কর হয়। পাট শাকের তৈরি পেলকা মৌসুমি রান্না। কিন্তু সজনে পাতার তৈরি শোলকা সারা বছরব্যাপী রান্না করে খাওয়া যায়। বিশেষ করে বারোমাসী সজনে গাছ বাড়িতে থাকলে তো কোন কথাই নেই।

তবে কালের স্রোতে সৌখিন এসব খাবার হারিয়ে যেতে বসেছে। ব্যস্ত কর্মজীবি মানুষ আজকাল সামনে যা পায় তাই ঝট্পট খেয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। পেলকা ও শোলকা রান্নার মতো সময় ও ধৈর্য্যধারণ করার ক্ষমতা আজকাল গ্রামীণ গৃহবধূদেরও নেই। বাজার থেকে পাট শাক কিনে কোন শহুরে পরিবারে রান্না হলে বাচ্চারা সেটা তিতা বলে খেতে চায় না। কিন্তু বিদেশি তিতো চকোলেটযুক্ত দামি চকোপাই বা আইসক্রীম তাদের কাছে খুবই প্রিয়।

এভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে পাট পাতা ও সজনে পাতা দিয়ে তৈরি জনপ্রিয় খাবার দুটো। কিন্তু অবাধ ইন্টারনেটের এই যুগে আবারো পাট ও সজনে পাতা দিয়ে তৈরি বিশেষ খাবার নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে। কচি পাট পাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে শক্তিবর্ধক ভেষজ ওষুধ ও টনিক। আর সজনে পাতা ‘সুপার ফুডের’ তালিকায় নিজের নাম লিখিয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করে ফেলেছে।

একজন জাপানিজ গবেষক আফ্রিকা থেকে সজনে পাতা এনে গবেষণা করে এই মিরাক্কেল শাক থেকে ‘মরিঙ্গা পাউডার’ তৈরি করে এর বহুবিধ গুণ প্রচার করেছিলেন। সজনে গাছকে তিনি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদ হিসেবে জানতেন। কিন্তু বাংলাদেশে ‘ড্রামস্টিক ট্রি’বা সজনে গাছ এত সহজলভ্য এবং এতটাই সুপরিচিত যে তিনি সেটা জানতে পেরে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। সজনে পাতা নামক ‘সুপার ফুডের’প্রতি আমাদের দেশের মানুষের অজ্ঞতা ও অবহেলা তাকে খুবই বিস্মিত করে তুলেছিল।

সজনে পাতা নামক ‘সুপার ফুডের’ প্রচার ও এর চাহিদার দিকে লক্ষ্য করে আজকাল সজনে বাগান তৈরির হিড়িক পড়ে গেছে। সজনে বাগান কেন্দ্রিক কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব কারখনায় মহিলা শ্রমিক সহ অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সজনে পাতার পাউডার—এর ব্যাপক গুণকীর্তন চালু থাকায় বাজারে এর চাহিদা বেড়ে গেছে বহুগুণ।

প্রচারে প্রসার—এই তত্ত্ব যেন সজনে পাতাকে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। সাইবার জগতের এই বিরাট সাড়া আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোন জাগরণ তৈরি করেছে কবলে মনে হচ্ছে না। আগেকার দিনে পাট পাতা ও সজনে পাতা দিয়ে নানাব্যঞ্জন রান্না করা হতো। পরিবারের সদস্যরা সেগুলো মজা করে খেতেন। তাই তখন এত রোগ—বালাই হতো না। এটি মূলত: একটি সাধারণ প্রচলণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ।

আজকাল মানুষ কৃত্রিম খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিক্যাল ও বাহারি রং মেশানো খাবার পাতে না হলে আধুনিক মানুষের মন ভরে না। আধুনিক মশলার মধ্যে আসলে কি কি উপাদান মিশ্রিত রয়েছে তা যাচাই করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। ভেজালের এই যুগে বিএসটিআই—এর প্রতীক লাগানো কতকিছুই হরদম জব্দ করে জরিমানা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে উন্নয়নের অতিপ্রচার দেখে বিদেশিরা বাংলাদেশের দিকে ঘন ঘন তাকানো শুরু করেছে। তবে ঋণ ও ক্ষমতা লাভের জন্য তাদের দিকে আমরা আরো বেশি করে তাকিয়ে থাকি। এই পরনির্ভরশীলতা আমাদেরকে আরো বেশি পঙ্গু করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এবছর দেশের একদিকে দারুণ খরা, অন্যদিকে হঠাৎ বন্যা শুরু হয়েছে। কেউ বষার্কালে গভীর নলকূপের পানিতে সেচ দিয়ে রোপা আমন ধানের চারা লাগাচ্ছে আবার কারো বীজতলা তলিয়ে গেছে ঢলের পানিতে। এরই মাঝে এডিস মশা দেশের সব জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ায় সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২৩ পর্যন্ত রেকর্ড সংখ্যাক ৬৫৭ জন মারা গেছেন। মফস্বলের হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে জীবন বাঁচাতে হন্যে হয়ে ছুটে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার দিকে।

ঢাকায় গিয়ে হাসপাতালের বেডে জায়গা না পেয়ে মেঝে, বারান্দায়, ওয়েটিং রুমে মাদুর পেতে রোগী নিয়ে শুয়ে আছেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যখন কোন জটিল রোগীর জন্য জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন তখন। মফস্বল থেকে আসা অধিকাংশ রোগীর আত্মীয়—স্বজন রক্ত দেয়ার ব্যাপারে সজাগ নন। রক্ত দেয়ার কথা শুনলেই তারা অনেকে আঁৎকে উঠেন। কেউ কেউ কান্নাকাটি শুরু করে দেন। এছাড়া বাইরে থেকে রক্ত সংগ্রহ, খরচ বহন ইত্যাদির জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত নন।

এরই মাঝে রাজপথের একটি লেনে একটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের মিছিলের লম্বা লাইন যখন ৪—৫ মাইল লম্বা হচ্ছে তখন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে সরকারি দলও অপর দিকের বাকি লেনটি দখল করে মিছিল শুরু করে দিচ্ছে। ডেঙ্গুর হটস্পট রাজধানী ঢাকায় সারা দেশ থেকে ভাড়ায় মানুষ ডেকে এনে সম্মেলন ও মিছিল করাচ্ছে সরকারি দলও! এর ফলে প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ ডেঙ্গু।

অন্যদিকে দেশে কেউ যেন কিছকেইু ঠিকমতো পাত্তা দিতে চাচ্ছে না। স্থানীয় জনগণের উপলব্ধিকে পাত্তা না দেয়া আমাদের দেশজ উন্নয়ন অবনমনের প্রধান কারণ বা অন্তরায় হিসেবে আবিভূর্ত হয়েছে। এদেশে কেউ তার নিজের দোষ সহজে স্বীকার করতে অভ্যস্ত নয়। তাই মিথ্যা-জালিয়াতির বেসাতিতে বিপদ বেড়েই চলেছে চারদিকে। সেজন্য অতিদ্রুত পারস্পরিক দোষারোপ ও পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে দেশজ তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক গবেষণা করে, দেশজ সম্পদ রক্ষা করতে হবে।

আমরা যখন ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা মেনে ঘুমিয়ে থাকি তখন অন্যেরা এসে ধরে উজাড় করে দেয়। আমরা যখন জাল ফেলি তখন নদী মাছশূন্য। বিদেশি লুটেরাদের হাতে উজাড় হচ্ছে জাতীয় মৎস্য সম্পদ। ইলিশ মাছের শুধু এক ভিডিও সব ইউটিউবারদের ‘তুমি সুড়ংঙ্গে’ ছড়াছড়ি। অথচ ইলিশের এই ভরা মৌসুমে কাঁচাবাজার ইলিশ শূন্য। বাড়ছে অবৈধ রোহিঙ্গা অভিবাসীদের ফুলে ফেঁপে উঠা সংখ্যার মতো বিষফোঁড়া। মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে ইয়াবা আসা বন্ধ হলে শুধু কক্সবাজার জেলাতেই দশ হাজার মানুষ বেকার হয়ে যাবে বলে ভাষ্য দেন কোন বিচারক!

খুব দ্রুত আধুনিক হবার জন্য শোলকা পেলকার মতো দেশজ খাবার ত্যাগ করে যখন দুর্বল শরীর নিয়ে কালাতিপাত করছি ঠিক তখন জাপানিজ গবেষকের উদ্ভাবিত সজনে পাতার পাউডার আমাদেরকে নবজীবন দান করতে পারবে বলে সেই আশায় সেদিকে হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছি। তবে শোলকা—পেলকার মতো দেশজ খাবার গ্রহণ করে মেরুদণ্ড সোজা করে চলতে শুরু না করলে বৈশ্বিক উজানের হঠাৎ ঢল এসে সাতকানিয়ার নতুন রেললাইন বাঁকা করে দেয়ার মতো ঘটনা আরো ঘন ঘন জেঁকে বসতে থাকবে বৈ—কি?

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

 

;