দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান

  • মহীবুল আজিজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গ্রাফিক্স: বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক্স: বার্তা২৪.কম

লুইগি পালোমার সুবর্ণদ্বীপের জন্যে মঙ্গল না অমঙ্গলের বার্তা বয়ে আনে সে-ভাবনা অনেককেই সংশয়ী করে তোলে। কিছুকাল আগে একবার ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠান মেদসাঁ সঁ ফ্রঁতিয়েরের একজন চিকিৎসক আসে সুবর্ণদ্বীপে। সকাল-সন্ধ্যা কাটিয়ে তিনি রোগগ্রস্ত লোকেদের কথা শোনেন, তাদের ইতিহাস নেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে দেন ব্যবস্থাপত্রও। তাঁর চলে যাওয়ার একদিনের মধ্যেই দ্বীপে একইসঙ্গে কুড়িজন লোক মুত্যুবরণ করে। অনেকেই এটিকে বিদেশি ডাক্তারের অশুভ সংযোগজনিত ফল বলে মনে করে। আবার, কেউ-কেউ ভাবে, তারা আসলে মরতোই, মরবার আগে তারা শুধু একজন বিদেশি ডাক্তারকে দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল। বলা যায়, উন্নত চিকিৎসা না পেলেও তারা পেয়েছিল উন্নত চিকিৎসক। বড়-বড় তিনটি বহুতল আশ্রয়কেন্দ্রের কাছাকাছি নির্মিত আরেকটি ত্রিতল ভবন ‘নিরাময়’ লুইগির কর্মস্থল। নিচতলায় হাসান-হোসেন নামক দু’জন প্রহরীর থাকবার জন্যে দু’টি কক্ষ এবং একটি স্টোররুম। দোতলাটা ডাক্তারের কর্মস্থল এবং ল্যাবরেটরি। তৃতীয় তলা সম্পূর্ণটাই ডাক্তারের বাসভবন। তিন তলায় দাঁড়ালে একটু দূরে রেণুকা নদীর একাংশ, কিছু ঘরবাড়ি-দোকানপাট এবং আরও দূরে বিশাল সাগরের অবিরাম জলরাশি। এমন ভূদৃশ্যাবলী লুইগিকে দারুণ মুগ্ধ করে। প্রায়ই তাকে দেখা যায়, তিন তলার ছাদে একটা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বই বা ম্যাগাজিন পড়ছে কিংবা মোবাইলে কথা বলছে ঘাড়-মাথা নাড়িয়ে-নাড়িয়ে।  

আরও পড়ুন: দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান (পর্ব-১)

বিজ্ঞাপন

হাসান-হোসেন দু’জনেই লুইগির নিরাময়ের প্রহরী। তবে, কখনও-কখনও দু’জনকে একসঙ্গে পাওয়া যায় না। হাসান হয়তো গেছে বাজারে আর হোসেন রান্নাঘরে। কিংবা হাসান লুইগির কাপড়চোপড় কাঁচে ওয়াশিং-মেশিনে কি হোসেন গার্হস্থ্য দায়িত্ব পালন করে। মোটকথা তারা দু’জনে একসঙ্গে হতে পারে মাঝে-মাঝে। রাতে তাদের ডিউটি ভাগ করা আছে। তিন ঘণ্টা হাসান প্রহরায় থাকে এবং সেই তিন ঘণ্টা হোসেন ঘুমায়। এভাবে পালাক্রমে তাদের প্রহরার কাল কাটে। সেদিন হাসান ঘুমাচ্ছিল এবং হোসেন ছিল প্রহরায়। লুইগি তার ল্যাবরেটরিতে কর্মরত ছিল কোন একটা রোগের মীমাংসা নির্ণয় করবার জন্যে। মাইক্রোস্কোপের নিচে একটা স্লাইডের মধ্যে নিহিত ছিল তার গভীর দৃষ্টি। লুইগি এরিমধ্যে নিরাময়ের জন্যে আরও লোক চেয়ে পাঠিয়েছে। যে-সংস্থাটির আর্থিক সহায়তায় চিকিৎসাকেন্দ্রটি নির্মিত সেটির অনুমোদন চূড়ান্ত হলেই প্রয়োজনীয় লোকবল মিলবে লুইগি পালোমারের। একটা অস্বস্তিকর শব্দে কান খাড়া করে হোসেন দ্রুত দোতলায় চলে আসে নিঃশব্দে। একটা কামরার জানলা থেকে দেখতে পায় আঙ্গিনার আলো ছাড়িয়ে দু’টি ধীর ছায়ামূর্তি চলমান। তারা এগোয় লুইগির নিরাময়ের দিকে। এত রাতে নিশ্চয়ই রোগশোকের মামলা নিয়ে লোকে আসবে না। আর মূর্তিদু’টোর গতিও সন্দেহজনক। দু’জনের একজনের হাতে চটের বস্তার মত একটা থলে দেখা যায়। হোসেন নিচতলায় গিয়ে জাগিয়ে তোলে হাসানকে। তারা অপেক্ষা করে দোতলার বারান্দায়। হাসানের হাতে একটা লোহার রড এবং হোসেনের হাতে একটা সেগুন কাঠের গদা। আলো-আঁধারির মধ্যে ছায়ামূর্তিদু’টো দেয়াল টপকে ভেতরে ঢোকে। কিন্তু তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আলী-আলী করে লোহা আর গদা নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাসান-হোসেন। চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে আসে লুইগি। তিনজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দু’টি ছায়ামূর্তি পাকড়াও হয়ে যায়। কুড়ি/বাইশ বছরের দুই যুবক। তারা সুবর্ণদ্বীপেরই বাসিন্দা। তাদের চটের মধ্যে ছিল একটি ধারাল রামদা এবং একটি মাংস কাটার ছুরি।

সারারাত তাদেরকে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় দু’টো আলাদা-আলাদা পিলারের সঙ্গে। তিনজনের কারও চোখেই ঘুম আসে না। যুবকদের কাছ থেকেও কোন স্বীকারোক্তি আদায় করা যায় না। হাসান-হোসেনের ধারণা তারা হয়তো পেশায় চোর বা ডাকাতই। মূল্যবান কিছুর আশায় নিরাময়ে এসেছিল। পুলিশ এসে তাদের ধরে নিয়ে যায় সকালবেলা। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পরে জানা গেল চুরি-ডাকাতি তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না। কেননা, এর আগে এমন কোন কাজে তাদের লিপ্ত থাকবার কোন নজির পুলিশের খাতায় পাওয়া যায় না। তবুও হতে কী পারে না, তাদের কেবলই হাতেখড়ি ঘটতে যাচ্ছিল নিরাময়ে অনুপ্রবেশের মধ্য দিয়ে। সফলকাম হলে তারা গর্বভরে সেটিকে প্রচার করতো। বুক ফুলিয়ে তারা বলতে পারতো, তারা বিদেশির ঘরে চুরি কিংবা ডাকাতি করেছিল। চোর-ডাকাত পেশার তৎপরতা হিসেবে সেটিকে উল্লেখযোগ্য সফলতা হিসেবেই বিবেচনা করতো সবাই। কিন্তু তারা চোর বা ডাকাত নয় এবং তাদের উদ্দেশ্য ছিল আরও গুরুতর। তারা আসলে হত্যা করতে এসেছিল লুইগি পালোমারকে। আনুষ্ঠানিক রিমান্ডে নেওয়ার আগে বলা যায় রিমান্ডের ভয় দেখিয়েই এবং খানিকটা লাঠ্যৌষধ প্রয়োগ করে পুলিশ একটি ভয়ংকর হত্যা-ষড়যন্ত্রের রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়।

বিজ্ঞাপন

যুবকেরা এসেছিল একটি আন্তর্জাতিক ঘটনার সূত্র ধরে। ইজরায়েলে সংঘটিত একটি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তারা লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল লুইগিকে। দু’দিন আগে গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা করে ইজরায়েলি সৈন্যরা। সেই হামলায় পাঁচজন লোক মারা যায় যাদের মধ্যে ছিল দু’টি শিশু। টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদটির সচিত্র প্রতিবেদন দেখে একটা প্রতিশোধপরায়ণতায় উদ্দীপ্ত হয়ে যুবকদু’টি সুবর্ণদ্বীপের বিদেশি চিকিৎসক লুইগিকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। কোথায় ইজরায়েল আর কোথায় সুবর্ণদ্বীপ! দারোগার কথা শুনে হতভম্ব লুইগি। সে তো ইজরায়েলি নয় এমনকি ধর্মসূত্রে ইহুদিও নয়, রোমান ক্যাথলিক। তখন দারোগা বলে, আপনাকে ওরা ভেবেছিল আমেরিকার মানুষ। ওদের ধারণা আমেরিকা ইজরায়েলকে মদদ দেওয়ার কারণেই তারা নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার সাহস দেখাতে পারে। লুইগি আসলে ইতালিয় নাগরিক।  আই এ্যাম ফ্রম তুরিন- সে মার্কিন বা ব্রিটিশদের মতো ‘ট’ না বলে তুরিন উচ্চারণে ‘ত’-ই লে। কিন্তু যুবকদের তা জানবার কথা নয়। তারা কিংবা তাদের মত লোকেরাই টুপি না দিলে চেচনিয়দেরও ভাবতো আমেরিকান। এখন থেকে লুইগিকে সাবধানে চলাফেরা করবার পরামর্শ দেওয়া হলো। যখন-তখন এখানে-ওখানে যাওয়ার বিলাসিতা তাকে বাদ দিতে হবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্যে ভবনের ছাদেই তাকে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। চাইলেই নদী বা সাগরতীরে ছুটে যাওয়া চলবে না। একজন কর্তব্যরত পুলিশের ব্যবস্থা করা হয় নিরাময়-কেন্দ্রে। নতুন  পাহারাদার পেয়ে হাসান-হোসেন উৎফুল্ল। নিজেদের কাজের বোঝা লাঘব হয়েছে এই ভেবে নয়, আসলে পুলিশের কাঁধে থাকা রাইফেল তাদের নিরাপত্তার বোধে উদ্দীপ্ত করে তোলে।

আরও পড়ুন: দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-২)

চলবে...

৪র্থ পূর্ব পড়ুন আগামী শুক্রবার