সম্রাট শাহজাহানের পছন্দের দারাশিকোহ
সম্রাট শাহজাহানের ছিল চার পুত্র। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তারা হলেন, দারাশিকোহ, শাহ শুজা, আওরঙ্গজেব ও মুরাদ বখস। যৌবনকাল অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গেই চারজনই নানা প্রদেশের শাসনকর্তা ও সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ রূপে কমবেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। জ্যেষ্ঠপুত্র দারা ছিলেন সম্রাটের প্রিয়পাত্র এবং উত্তরাধিকারের জন্য নির্বাচিত, অধিকাংশ সময়ে রাজধানীতে অবস্থানকারী এবং প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রদেশের শাসন পরিচালনাকারী। ফলে যুদ্ধ ও রাজনীতির বাস্তব অভিজ্ঞতায় তিনি ছিলেন পিছিয়ে। যদিও দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, শিল্পকলায় দারা ছিলেন পারদর্শী।
দারার সঙ্গে অন্য ভাইদের ভ্রাতৃসুলভ বন্ধন ছিল না। বলা যায়, প্রত্যেক ভাই ক্ষমতার জন্য তলে তলে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তবে পিতা ও সম্রাটের বেশি আনুকূল্য লাভ করায় বড় ভাই দারার বিরুদ্ধে বাকী তিন ভাই হিংসা, বিদ্বেষ ও ক্ষোভ পোষণ করার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত একজোট ছিলেন। বিশেষ করে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নীতির দিক থেকে দারা ও আওরঙ্গজেবের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত বিপরীতমুখী ও শত্রুভাবাপন্ন।
জ্যেষ্ঠপুত্র দারার প্রতি সম্রাট শাহজাহানের বিশেষ আকর্ষণ ও পক্ষপাতের বিষয়টি লুকানো ছিল না। সম্রাট স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে জানিয়ে দেন যে, তিনি মুঘল সিংহাসন দারাকে দিয়ে যেতে চান। একই মায়ের সন্তান চার পুত্রের মধ্যে দারা যেহেতু সর্বজ্যেষ্ঠ তাই জেষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে দারাকে নির্বাচন করা সম্রাটের জন্য অন্যায় ছিল না। কিন্তু জ্যেষ্ঠ পুত্রের প্রতি সম্রাটের অযাচিত অনুগ্রহ ও আনুকুল্য প্রদর্শন এবং আওরঙ্গজেবের স্বার্থ ও দাবির প্রতি অমনোযোগ তৎকালীন মুঘল রাজনীতিতে একটি মেরুকরণ তৈরি করে। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় কিংবা ঘটনাক্রমে দারাশিকোহ সেই প্রচ্ছন্ন রাজনীতির একজন অন্যতম অংশীদারে পরিণত হন, যদিও সেই পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে তিনি সফলতা দেখাতে পারেন নি।
সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাজে দারাকে প্রশিক্ষণ দানের নিমিত্তে এবং তার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য যা যা প্রয়োজন, তা সম্পন্ন করতে সম্রাট শাহজাহান মোটেও কার্পণ্য করেন নি। সুদীর্ঘ বছর সম্রাট প্রিয় পুত্র দারাকে প্রকাশ্য দরবারে নিজের পাশে বসান। সম্পদশালী, বিরোধমুক্ত ও নিষ্কণ্টক প্রদেশ, যেমন এলাহাবাদ, মুলতান, পাঞ্জাব প্রভৃতি জায়গীর হিসেবে দারাকে প্রদান করেন। এমনকি, এসব এলাকা নিজে না গিয়ে প্রতিনিধির দ্বারা পরিচালনার জন্যও দারাকে অনুমতি দেওয়া হয়, যেমন অনুমতি অন্য কোনো শাহজাদা ও সুবাদারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না।
সম্রাট শাহজাহান জ্যেষ্ঠপুত্র দারাকে এমন সব রাজকীয় খেতাব ও পদ-পদবি প্রদান করেন, যার মাধ্যমে তিনি অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে সম্রাটের কাছাকাছি পৌঁছে যান। মুঘল ক্ষমতা কাঠামোতে দারার রাজনৈতিক মর্যাদাগত অবস্থান এমনই একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে, যা ছিল সম্রাটের ঠিক নীচে এবং যুবরাজদের ঊর্ধ্বে। দারার প্রতি সম্রাটের একতরফা আনুকুল্যের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমনকি, কান্দাহারে ব্যর্থ ও নিষ্ফল অবরোধের পর দারা খালি হাতে রাজধানীতে ফিরে এলেও তাকে ‘শাহ-ই-বুলন্দ ইকবাল’ নামে অতি উচ্চ রাজকীয় পদবিতে ভূষিত করা হয়, যার অর্থ ‘সৌভাগ্যের বাদশাহ’। তাকে হীরা, মুক্তা খচিত একটি সম্মানসূচক পোষাক উপহার দেওয়া হয়, যার আনুমানিক মূল্য ধরা হয় সে যুগের পঞ্চাশ হাজার টাকা। এগুলো ছাড়াও তাকে আরো অনেক স্বর্ণালঙ্কার ও মুদ্রা উপহার দেওয়া হয়, যার তৎকালীন বাজার মূল্য তিন লক্ষ টাকার অধিক ছিল। তদুপরি, আগে থেকেই দারাকে ‘বাদশাহজাদা-ই-বুজুর্গ মর্তবা’ বা ‘উচ্চতর যুবরাজ’ নামের বিশেষ উপাধি দিয়ে ভূষিত করা হয়।
সম্রাট পিতার মুঘল দরবার থেকে প্রাপ্ত নানা উপাধির যথার্থ মর্মার্থকে সপ্রমাণিত করে বাস্তব সৌভাগ্যের প্রমাণ দারাশিকোহ যুদ্ধক্ষেত্র ও রাজনীতির মাঠে আদৌ দেখাতে পারেন নি, যতটুকু পেরেছেন ধর্ম-দর্শন আলোচনা, শিল্প ও সাহিত্য চর্চায়। বরং তাকে অভূতপূর্ব উচ্চ পদবি, নানাবিধ উপাধি ও উপঢৌকন, চল্লিশ হাজার সৈন্যের মনসবদারি প্রদান এবং বিপুল জায়গীয় ও সম্পত্তির মাধ্যমে প্রচুর আয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়ায় অন্যান্য যুবরাজসহ অনেকেই ঈর্ষান্বিত হন। তদুপরি দরবারে সম্রাটের পাশে বসার অনুমতি এবং সিংহাসনের অল্প নীচে স্বর্ণ নির্মিত রাজকীয় আসনে উপবেশনের একচ্ছত্র ও একমাত্র অধিকার পাওয়ায় দারার প্রতি নিজের ভাইদের বাইরেও অনেক রাজন্য তলে তলে ক্ষিপ্ত হন। শুধু তাই নয়, দারার পুত্রগণ যেসব রাজকীয় সম্মান ও পদবি লাভ করেন তা ছিল সম্রাটের কনিষ্ঠ সন্তানের মর্যাদার সমতুল্য। রাজ দরবারে দারার প্রভাব ও ক্ষমতা এতোটাই বৃদ্ধি পায় যে, সম্রাটের কাছ থেকে যে কোনো সুযোগ-সুবিধা, পদোন্নতি, সুবাদারি, মনসবদারি, সুপারিশ ও তদবির পাওয়ার জন্য দারার নিকট সবাই ধর্ণা দিতে থাকে এবং এতে কাজও হয়।
সম্রাটের সুস্পষ্ট ইঙ্গিতে ও সমর্থনে প্রকাশ্য দরবারের কাজ-কর্ম এবং সরকার পরিচালনার প্রায় সমস্ত কাজে দারার প্রাধান্যও বৃদ্ধি করা হয়। সম্রাটের উপস্থিতিতেই দারা কর্তৃক বিভিন্ন নির্দেশ প্রদান ও কর্ম সম্পাদিত হতে থাকে। বস্তুত পক্ষে, সম্রাট শাহজাহান এমন একটি পরিবেশ ও ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করতে চান যেন তার অবর্তমানে বা মৃত্যুর পর দারাই হবেন মুঘল সালতানাতের পরবর্তী সম্রাট। কিন্তু সম্রাট তার এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ওয়াকেবহাল ছিলেন না। দারার একচ্ছত্র ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে তার অন্যান্য সন্তানদের মনোভাবও তিনি জানতে পারেন নি বা জানতে চেষ্টা করেন নি। তদুপরি, যুদ্ধ, রাজনীতি ইত্যাদি বাস্তব ক্ষেত্রে দারার কর্তৃত্ব ও যোগ্যতা পরীক্ষা করারও কোনো ব্যবস্থা সম্রাট করেন নি। ফলে মুঘল ঐতিহ্য অনুযায়ী অস্ত্র ও শক্তির মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে উত্তরাধিকার নির্ধারণের সময় দারা নিজেকে সফল প্রমাণ করতে পারেন নি এবং পিতা ও সম্রাটের যাবতীয় সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার পরেও মুঘল ক্ষমতার শীর্ষে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হন। সাম্রাজ্যর কোহিনুর-খচিত মুকুট ও ময়ূর সিংহাসন পাওয়ার বদলে তার ভাগ্যে জোটে পলাতক জীবনের বিয়োগান্ত পরিণতিতে করুণ মৃত্যু।