শহীদ মুনীর চৌধুরী: শাসকের গদি তাড়া করে ফেরা এক ‘মুর্দা ফকির’



অসীম নন্দন, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা টোয়েন্টিফোর
অলংকরণ ও সম্পাদনা: রুদ্র হক

অলংকরণ ও সম্পাদনা: রুদ্র হক

  • Font increase
  • Font Decrease

টাইপরাইটারে তখনো বাংলা টাইপ করার ব্যবস্থা চালু হয়নি। সময়টা ১৯৬৫ সাল। কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে বাংলা টাইপিং-এর জন্য সর্বপ্রথম উন্নতমানের কীবোর্ড উদ্ভাবন করলেন একজন অসামান্য প্রতিভাবান মানুষ। মানুষটার নাম মুনীর চৌধুরী। তাঁর নাম অনুসারেই কী-বোর্ডের নাম রাখা হয়েছিল ‘মুনীর অপটিমা’।

১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর, কোনো এক হেমন্তের নবান্নের দিনে খানবাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী এবং উম্মে কবির আফিয়া বেগমের কোলে জন্ম নেন মুনীর চৌধুরী। পুরো নাম আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী। ১৪ জন ভাই-বোনের মাঝে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর বাবা ছিলেন ইংরেজ আমলের জেলা ম্যাজিট্রেট। খানবাহাদুর সাহেবের প্রচুর বই সংগ্রহ করার শখ ছিল। যার ফলে ছেলেবেলাতে পরিবার থেকেই মুনীর চৌধুরী পেয়েছেন একটা চমৎকার সাংস্কৃতিক শিক্ষা। তাঁর বাবা তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ২৭ খন্ডের এনসাইক্লোপিডিয়া উপহার দিয়েছিলেন। আর মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তিনি এই এনসাইক্লোপিডিয়ার বিশাল রাজ্যে বুঁদ হয়ে গিয়েছিলেন।

পরিবার থেকে ভালো সাংস্কৃতিক শিক্ষা পেয়েছিলেন বলেই হয়তো তিনি এমন অসামান্য ব্যক্তি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। অথচ যখন কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন, তখন তাঁর বাবা তাকে মাসোহারা দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি বললেন, তোমার মতের সাথে আমার মতের যেহেতু বিস্তর অমিল; তাই তোমাকে পড়ালেখার খরচ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মুনীর চৌধুরী তাঁর বাবার কথা মেনে নিলেন। এবং ছাত্রাবস্থাতেই সাহিত্যের মাধ্যমে সামান্য আয়-রোজগার করতে শুরু করলেন।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লিলি চৌধুরীর সাথে মুনীর চৌধুরী

ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করে ভর্তি হলেন কলকাতার আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাড়ির কড়া নিয়ম থেকে একটু আলগা পেতেই তিনি নিজের মতন উড়তে শুরু করলেন। পাঠ্যপুস্তকের পড়া তাঁকে বেশি টানতো না। তিনি লাইব্রেরিতে বসে বসে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন। সাহিত্যের পড়াশোনা করতে গিয়ে আইএসসি পরীক্ষায় পেলেন দ্বিতীয় বিভাগ। তারপর এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ভর্তি হলেন। তাঁর বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে ডাক্তার হবে। কিন্তু মুনীর চৌধুরীর ঝোঁক ছিল সাহিত্যে। কলেজে পড়ার সময়ই তাঁর পরিচয় ঘটে বিশ্বসাহিত্যের সাথে। তিনি নিজেই বলেছিলেন: “আলীগড় আমায় মোহিত করতে পারেনি। তবে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের যা আমাকে আকর্ষিত করেছিল, তা হচ্ছে এর বিশাল পাঠাগার। বিশ্বের সকল লেখকের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ যোগ হয় এই পাঠাগারে।”

আলীগড়ে পড়াকালীন সময়ে মুনীর চৌধুরী জাঁকজমকপূর্ণ শৌখিন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। পরনে দামী শেরওয়ানি আর পকেটে দামী সিগারেটের টান নিয়ে বিভিন্ন আড্ডায় যেতেন। এরপর যখন আলীগড় থেকে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখন তাঁর পরিচয় ঘটে রবি গুহ, মদন বসাক, সরদার ফজলুল করিম, দেবপ্রসাদের মতন মেধাবী মানুষদের সাথে। তাঁদের সংস্পর্শে এসে তিনি বামরাজনীতিতে দীক্ষিত হন। এবং জাঁকজমকপূর্ণ শৌখিনতাকে ত্যাগ করে শুরু করেন অনাড়ম্বর জীবন।

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন মুনীর চৌধুরীর সরাসরি ছাত্র। ছাত্র হলেও তাঁদের দুজনের মাঝে ছিল আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এছাড়া একসময় তাঁরা দুইজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মীও হয়েছিলেন। আনিসুজ্জামান সাহেব তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুনীর চৌধুরী সম্পর্কে বলেছেন, “ছেচল্লিশ বছর বয়সে দেশদ্রোহী ঘাতকের হাতে নিহত একজন অসাধারণ প্রতিভাধর মানুষের নাম মুনীর চৌধুরী। অনেক বছর আগে আমি এই বাক্যটি লিখেছিলাম, অসাধারণ প্রতিভাধর বলতে কী বোঝাতে চেয়েছি, তারও একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম—আদর্শ শিক্ষক ও কুশলী বক্তা, সফল নাট্যপ্রতিভা ও ক্ষুরধার সাহিত্য-সমালোচক, জীবনের নিষ্ঠাবান রূপকার ও সমাজচেতনায় দীপ্ত পুরুষ। আমার কাছে তিনি আরও কিছু ছিলেন—শিক্ষক, বন্ধু, পথপ্রদর্শক, প্রেরণাস্থল।”

প্রথম বর্ষের ছাত্রাবস্থাতেই সলিমুল্লাহ হলের শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে জয় করেছিলেন প্রভোস্টস কাপ। অসামান্য বক্তা ছিলেন তিনি। যখন শিক্ষকতা করতেন, তখন তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্যও ক্লাসরুমে ভীড় জমতো। এছাড়া নাটকের রিহার্সাল এবং রাজনৈতিক সভায় সব জায়গাতেই সমানভাবে বক্তৃতা করতেন তিনি।

মুনীর অপটিমা কি-বোর্ডের লে-আউট

একসময় সক্রিয় রাজনীতি করা ছেড়ে দিলেন। ভাবলেন সংসার করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় তাঁর পরিচয় এবং প্রেম ঘটে লিলি মির্জার সাথে। পরবর্তীতে তাঁদের দুজনের বিয়ে হয়। বাংলাদেশের অন্যতম মেধাবী সন্তান মিশুক মুনীরের জন্ম হয় তাঁদের ঘরেই। যদিও মুনীর চৌধুরী রাজনীতি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রাজনীতি তাকে কোনোদিন ছাড়েনি। সক্রিয় রাজনীতি ছাড়লেও বিভিন্নরকম এক্টিভিজমের সাথে তিনি জড়িত থাকতেন। সাংস্কৃতিকভাবে হলেও সম্পর্ক রেখেছেন রাজনীতির সাথে। সবশেষে রাজনীতির বিষাক্ত দংশনেই দেশদ্রোহী ঘাতকের হাতে গিয়েছে তাঁর প্রাণ।

তাঁর লেখা নাটকগুলোতে সবসময়ই আমরা পাই প্রবল হিউমার। কমেডির ধাঁচে দুনিয়ায় বাস্তবতাকে তিনি রূপায়িত করতেন নাটকে। তিনি যে তীক্ষ্ণ সমাজসচেতন এবং রাজনীতিসচেতন ছিলেন; তার প্রচ্ছন্ন ছায়া পাওয়া যায় নাটকগুলোতে। বেশ কিছু গল্প লিখেছিলেন অল্প বয়সে। তবে গল্পের চেয়ে নাটকের প্রতিই তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি।নাটক ছিল তাঁর প্রথম প্রেম। এছাড়া তিনি প্রখর সাহিত্যসমালোচকও ছিলেন। নাটক এবং সমালোচনা সাহিত্যকে তিনি অন্য এক মাত্রা দিয়েছিলেন। তাঁর লেখাগুলোতে আমরা পাই ইতিহাস-সচেতনতা এবং সমকালীন সমাজের নানান বিকারগ্রস্ত ছবি।

বাংলা-সাহিত্যে সার্থক প্রতিবাদী একাঙ্কিকা নাটক লিখেছিলেন তিনিই। ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার জন্য তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের করা মানববন্ধনে তিনি ভাষা-শহীদদের পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এজন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হলো। জেলে থাকাকালীন সময়ে রণেশ দাশগুপ্ত মুনীর চৌধুরীকে একটা নাটক লিখতে অনুরোধ করলেন। নাটকটি ভাষাশহীদদের স্মরণে জেলেই মঞ্চস্থ করা হবে। এবং নাটককে হতে হবে জেলে মঞ্চস্থ করার উপযোগী। কারণ জেলে তো তেমন আলোকসজ্জা করা সম্ভব নয়। এবং জেলে নারীচরিত্র থাকাও সম্ভব নয়। এই সকল কথা মাথায় রেখেই মুনীর চৌধুরী লিখলেন বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘কবর’ নাটকটি। সকল দিক চিন্তা করে এইজন্যই তিনি ‘কবর’ নাটকের স্থান নির্বাচন করলেন গোরস্থানকে। জেলখানায় বন্দী থেকেও পাকিস্তানিদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখার অপর নাম ‘কবর’। এর মধ্য দিয়ে তাঁর অসম্ভব সাহসিকতার পরিচয় পাই আমরা।

নাটকের চরিত্র শক্তিশালী হলেই কেবল শৈল্পিক-দিক থেকে নাটকের বুনন মজবুত হয়। ‘কবর’ নাটকের প্রধান চরিত্র তিনটি। একজন মাতাল অসৎ ক্ষমতার অপপ্রয়োগকারী রাজনৈতিক নেতা। একজন দূর্নীতিগ্রস্ত চাটুকার পুলিশ কর্মকর্তা। এবং একজন পাগল মুর্দা ফকির। নাটকের প্রেক্ষাপট ভাষা-আন্দোলন। ভাষা-আন্দোলনে শহীদ ছাত্রদের গণকবর দেবার জন্য গোরস্থানে নেয়া হয়েছে। অসৎ নেতা'র ভাষ্যমতে ভাষা-শহীদেরা হচ্ছে দুষ্ট ছেলের দল। আর দুষ্ট ছেলেদের নাকি গুলি করেই মারা উচিত। মদ খেয়ে মাতাল হবার মধ্য দিয়ে নেতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে হাফিজ পুরোটা সময় কেবল নেতার চাটুকারিতায় পঞ্চমুখ। নেতার নেকনজর পেতে সবসময় ব্যস্ত। আর নেতার কাছ থেকে ঘুষ খাওয়ার জন্য হাফিজ সবসময় উন্মুখ হয়ে থাকে। হাফিজ হচ্ছে সবচেয়ে ধূর্ত এবং কৌশলী চরিত্র; যে কিনা সকল দিক সামলিয়ে নিজের আখের গোছাতে চায়। ‘কবর’ নাটকের সবচেয়ে আকর্ষনীয় চরিত্র হলো মুর্দা ফকির। ৪৩'র দুর্ভিক্ষে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে। গোরস্থানেই সে বসবাস করে। মুর্দা ফকির হচ্ছে এই নাটকে রূপক-অর্থে সমাজের বিবেকের ছবি। রূপকধর্মী সংলাপের মধ্য দিয়ে ফকির আমাদেরকে বাস্তবতার সাথে পরিচিত করে।

“গন্ধ! তোমাদের গায়ে মরা মানুষের গন্ধ! তোমরা এখানে কী করছ? যাও, তাড়াতাড়ি কবরে যাও। ফাঁকি দিয়ে ওদের পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা বাইরে থেকে মজা লুটতে চাও, না? না, না আমার রাজ্যে এসব চলবে না।” মাতাল নেতা এবং পুলিশের উদ্দেশ্যে মুর্দা ফকিরের এই সংলাপটির মধ্য দিয়েই আমরা এই চরিত্রের হিউমার ও মুনীর চৌধুরীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা পরিলক্ষিত হয়।

মুনীর চৌধুরী রচিত ‘কবর’ নাটকের একটি দৃশ্য

ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে ওরা ছাত্রদের হত্যা করে যখন রাতের অন্ধকারে কবর দিতে নিয়ে গেল। তখন নাটকের শেষদিকে আমরা দেখি, ভাষাশহীদেরা জেগে উঠে প্রতিবাদ করছে। তাঁরা কবরে যেতে চায় না। হাফিজের কথার প্রতিবাদে ওরা বলে, “মিথ্যে কথা। আমরা মরিনি। আমরা মরতে চাইনি। আমরা মরব না।...কবরে যাব না।” এই নাটকের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দেশের ইতিহাসে মহান ভাষা-আন্দোলনের তাৎপর্য খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি। জর্জ বার্নাড'শর ব্যঙ্গাত্মক রচনায় তিনি প্রভাবিত হয়ে ‘কবর’ নাটক সৃষ্টি করলেও, ‘কবর’ বাংলাসাহিত্যের প্রতিবাদী নাটক হিসেবে এক অনন্য সৃষ্টি।

এছাড়া তাঁর রচিত নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ বাংলাসাহিত্যের আরেকটি অনবদ্য রচনা। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধকে আবহ করে রচিত হয় ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’। যদিও যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত, তবে যুদ্ধ এই রচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। যুদ্ধের থেকেও যুদ্ধের সময়ে মানুষের হৃদয়ের ক্ষত-বিক্ষত অনুভূতিই এই নাটকের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে ভারতবর্ষের মানুষের মাঝে হিন্দু-মুসলিম বিভেদের সেই বিভৎস সাম্প্রদায়িক ছবি এবং লেখকের লেখনী এই নাটককে নিয়ে গেছে অন্যন্য উচ্চতায়। এই নাটকের প্রধান চরিত্রগুলো হলো সুজাউদ্দৌলা, নজীবদ্দৌলা, জোহরা, ইব্রাহিম কার্দি এবং আহমদ শাহ আবদালি। এটি একটি সফল ট্র্যাজিক কাহিনি। যুদ্ধের ময়দানে নায়কের করুণ মৃত্যু ঘটে। আর নায়কের মৃত্যুতে নায়িকার হৃদয়ের বেদনা এই নাটককে সার্থক ট্র্যাজেডিতে পরিণত করেছে।

এছাড়াও মুনীর চৌধুরী ছিলেন একজন অনবদ্য অনুবাদক। জর্জ বার্নার্ড'শ-সহ আরো অনেক বিশ্বমানের লেখকের লেখা তিনি অনুবাদ করেছিলেন। আগেই বলেছিলাম তিনি রাজনীতি ছাড়তে চেয়েছিলেন। সক্রিয় রাজনীতি থেকে বেরিয়েও এসেছিলেন।কিন্তু রাজনীতি তাঁকে ছাড়েনি। তাঁর লেখায় সবসময় পাওয়া গেছে বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। সবসময় তিনি ছিলেন মননশীলতা, উদারতা এবং প্রগতিশীলতার পক্ষে। আর এজন্যই তিনি পাকবাহিনীর হিট-লিস্টে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের সেই কালো দিনটিতে তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানিদের সহযোগী আলবদর বাহিনী। আর আমরা হারিয়েছি বাংলাসাহিত্যের এক অসামান্য প্রতিভাবান মানুষকে।

আজ ২৭ নভেম্বর। এই অসামান্য প্রতিভাধর মানুষটার ৯৬ তম জন্মদিন। তিনি তাঁর ভিন্নধর্মী ক্ষুরধার নাটক আর সমালোচনা-সাহিত্যের জন্য বাংলাসাহিত্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন। তাঁর প্রজ্ঞা, তীক্ষ্ণধী, প্রগতিশীলতায় তিনি অনন্য। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সাহেবের লেখা থেকে আমরা জানতে পাই, প্রেমে ব্যর্থ এক ছাত্র একবার মুনীর চৌধুরীর কাছে গিয়ে মনের আবেগের কথা জানায়। সেই বয়সের আবেগ থেকে ছাত্রটি তাকে আত্মহত্যার ইচ্ছার কথা জানায়। মুনীর চৌধুরী তাঁকে বলেছিলেন, “দেখো, তোমার মতো অবস্থায় আমারও একাধিকবার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু পরে দেখেছি, আত্মহত্যা না করে ভালোই করেছি—পৃথিবীটা বসবাসের যোগ্য।” তাঁর সেই যাপনযোগ্য জীবনের অবসান হলো অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে; কমেডি যাঁর প্রিয় শিল্পমাধ্যম, তাঁর জীবনে নেমে এল মহৎ ট্র্যাজেডি—তাঁর পক্ষে শহীদের মর্যাদালাভও আমাদের এ দুঃখ ঘোচাতে পারে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচয়পত্রে মুনীর চৌধুরীর ছবি

এক নজরে জীবনপঞ্জি:
পুরো নাম: আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী
জন্ম: ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর
জন্মস্থান: মানিকগঞ্জ, বাংলাদেশ
মৃত্যু: ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), স্বাধীনতা পুরস্কার(১৯৮০)
উল্লেখযোগ্য রচনা: কবর, রক্তাক্ত প্রান্তর, চিঠি, কেউ কিছু বলতে পারে না (অনুবাদ-সাহিত্য), রূপার কৌটা(অনুবাদ-সাহিত্য)

ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মনের বীক্ষণে দলিত, তপশিলি, নিম্নশ্রেণির ইতিহাস



সাৰ্থক লাহা
ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন

ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাস চর্চা দীর্ঘকাল ধরে মূলত রাজনীতি, রাজনৈতিক চিন্তা, রাজবংশ, রাজা-রাজত্বের মধ্যে সীমায়িত ছিল। আবার একইসাথে ইতিহাসের সংজ্ঞায়নে কেউ কেউ বলেছেন মহান মহান মানুষের জীবন অবতারনা বা আলোচনার নামই হল ইতিহাস। থমাস কার্লাইলের ভাষায়, 'ইতিহাস হল অসংখ্য মহান মানুষের আত্মজীবনির সারবস্তু’।

মূলত একটা সময় ইতিহাস মানে নেপোলিয়ান, আলেকজান্ডার, অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, আকবর প্রমুখ মানুষদের জীবনীগাঁথা ও তাঁদের সময়কালকেই বোঝা হতো। কিন্তু ইতিহাসের যে অন্য অনুষঙ্গ আছে বা ইতিহাস যে সমস্ত শ্রেণির মানুষের ইতিবৃত্ত সেটা বুঝতে বেশ কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়।

মূলত গত শতাব্দীর ৮০’র দশক থেকে নিম্নবর্গের কথা ঐতিহাসিক কলমে উন্মোচিত হয়। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠেছে ‘নিম্নবর্গের মানুষ কি সত্যিই কথা বলতে পারে?’- এই প্রশ্নের উত্তরে সজ্জিত উপাত্ত নিয়ে ইতিহাসে যে দলিত শ্রেনি, তপশিলি জাতির উচ্চারনও সমানভাবে প্রতীয়মান, সেই জায়গাটি বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার আলোকে যিনি সম্মুখে আনেন তিনি হলেন অন্যতম ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন। যার কলমে বিভিন্ন গ্রন্থে দলিত শ্রেনি, তপশিলি শ্রেণির তথা নিম্নশ্রেনির ইতিহাস, আত্মকথন, স্বকীয় রচনাগুলি পরিস্ফুটিত হয়েছে। লেখকের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটিও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।

ইতিহাসচর্চা বস্তুনিষ্ঠতা, বিজ্ঞানবাদিতা, নিরপেক্ষতা সহ নানা নতুন অনুষঙ্গ নিয়ে ক্রমশই অগ্রবর্তী হচ্ছে। ইতিহাসবেত্তাদের কলমে ক্রমশই পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, মহামারি, বিজ্ঞান, ক্রীড়াসহ নানাবিধ চর্চা বিশ শতকে নানা আবর্ত আলোচিত হতে দেখা যায়।

মুখ্যত বাংলা ভাষায় জাতপাত, জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ বিষয়ক আলোচনার আবর্ত দীর্ঘকাল যাবৎ ইতিহাসচর্চাকারীদের কলমে অপাংক্তেয় অবস্থাতেই থেকে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক কালপর্বে এবং সাম্প্রতিকে কিছুক্ষেত্রে জাতিচেতনা, দলিত আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি হলেও মূলত তা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যেই সীমায়িত। কাজেই কলকাতার গাঙচিল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রূপ কুমার বর্মনের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ এই গ্রন্থটি জাতপাতের ও আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিকনির্দেশক গ্রন্থ তা বলাই যায়।

লেখক মূলত সমকালীন পশ্চিমবঙ্গকে এক্ষেত্রে অনুধাবন করেছেন। অসংখ্য সাক্ষাৎকার ও ক্ষেত্রসমীক্ষা সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজন এবং অসংখ্য প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্তিকরনের প্রয়াসের ফসল এই গবেষণা গ্রন্থটি। শিরোনামেই ধরা পড়েছে গ্রন্থের মূল নির্যাস। যার মধ্যে সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের জাতপাত, জাতি-হিংসা, তপশিলিদের সামাজিক স্তরীকরণে কী অবস্থা, অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, নারীদের বৈষম্যকরনের পাশাপাশি ডান-বাম রাজনীতির আবহে এই তপশিলি জাতির চিত্রপটের স্বরূপ অনুধাবন, জাতিকেন্দ্রিক রচনা, কিছু ব্যক্তিত্বের বর্ননের সাথেও সরকারী নীতি, বিভাগ স্থাপন, প্রতিস্থান নির্মান ও নামকরন প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ের সংযুক্তকরুন বইটিকে এক অনন্য মাত্রা দান করেছে।

রুপ কুমার বর্মনের গ্রন্থটিতে ভূমিকা, অধ্যায়ীকরন, উপসংহার, সুদীর্ঘ গ্রন্থ তালিকা সহ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের সন্নিবিষ্টকরন পরিলক্ষিত করতে পারি। গ্রন্থ তালিকায় প্রাথমিক তথ্যাদি সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক রচনা, অফিসিয়াল ও লেখ্যাগারের তথ্যাদি ও বৈদেশিক গ্রন্থের প্রয়োগ গ্রন্থটির প্রামাণ্যতাকে নির্দেশ করে। অতিরিক্ত তথ্যাদির এই ব্যবহার গ্রন্থটিকে আরো প্রাঞ্জল করেছে।

গ্রন্থটির ভূমিকাংশে জাতপাত এবং জাতি, বর্ণবাদের উৎপত্তির ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের বর্ণবাদের বিকাশ এবং ক্রমশই যে জাতপাতের ভারতীয় সমাজে নিম্নবর্ণীয়দের প্রান্তিকায়িত করার আভাস তার ব্যাখ্যা দেখতে পায়। লেখক ইসলামিক এবং ঔপনিবেশিক সময়কালেও গ্রন্থগুলি অবলোকন করে ভারতীয় সমাজের নিম্নবর্ণীয়দের কি অবস্থান, তারা কিভাবে জাতি বৈষম্যের শিকার সেই ব্যাখ্যা করেছেন এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন আইন এবং প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা মধ্য দিয়ে নিম্নবর্ণীয়দের অবস্থা যে ক্রমিক প্রভু-দাস সম্পর্কের (patron-client Relationship) বন্ধনে নিমজ্জিত হয়েছে। এবং প্রান্তিকিকরন হয়ে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা সেটা আমরা দেখতে পাই এবং স্বাধীনতার সময়কালে ভারতের নিম্ন বর্ণের জাতি জাতি হিংসা অবসানের যে প্রচেষ্টা এবং সেই প্রচেষ্টায় তপশিলি জাতি এবং জনজাতীয় অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতির স্বরূপ কতটা বিকাশমূলক হয়েছে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এবং খুব সুস্পষ্টভাবে ভারতীয় প্রেক্ষিতে পরিবর্তনের অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন এবং সমকালীন পশ্চিমবঙ্গেও জাতপাতের যে ধারাবাহিকতা সেটির আলোচনা করেছেন।

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে তপশিলি জাতি ক্রমিক কিভাবে মৌখিক তথা বাহ্যিক এবং মানসিক জাতপাতের শিকার হচ্ছে সেই নব ব্যাখ্যাও এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট।

গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে এই জাতপাত, জাতি-রাজনীতি, জাতি-হিংসা, জাতি-বৈষম্য এই বিষয়গুলি পরিস্ফুটিত হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত, জাতি হিংসা এবং সামাজিক সংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক স্তরীকরণের ক্ষেত্রে জাতপাতের যে গুরুত্বপূর্ণ সেই ব্যাখ্যা যেমন আলোচিত হয়েছে তেমনি অন্য মেরুতে পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে চলতে থাকা বাচিক, মানসিক, ব্যবহারগত জাতপাতের যে অন্ধকার দিক সেটি লেখক তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্বাধীনতার পর্বে পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনকালীন রাজনীতি জাতপাত বা জাতি রাজনীতি কে কতটা ত্বরান্বিত করেছে এবং তপশিলি জাতির বিকাশ তথা উন্নয়ন নাকি তপশিলিরা রাজনীতির শিকার হয়েছে সেই ব্যাখ্যায় আমরা মূলত সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত পর্যবেক্ষিত হতে দেখি।

গ্রন্থটির তৃতীয় অধ্যায় মূলত বাংলার নিম্নবর্ণীয়দের নিজস্ব স্বকীয় লেখনীর মাধ্যমে তাদের অবস্থা নির্ণয়ের বা নির্মাণের আলোকে উঠে এসেছে। খুব সুন্দর ভাবেই লেখক বিভিন্ন জীবনী সাহিত্য, সৃজনধর্মী সাহিত্য অবলোকন এবং ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে নিম্নবর্ণের উত্থানের প্রশ্নটিই উত্থাপন করেছেন। গ্রন্থটির চতুর্থ অধ্যায়ে বাংলার তপশিলি সমাজের থেকে রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্বকরণ এবং বেশ কিছু নিম্নবর্ণীয় মানুষের বিস্মৃত স্মৃতির নতুন করে চর্চা এবং চর্যার জগতে আনার আলোকে রচিত হয়েছে।

জাতপাত, জাতি-বৈষম্য, জাতি রাজনীতি এই শব্দবন্ধগুলি ভারতীয় সমাজের আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমানভাবেই বহমান হয়ে রয়েছে। সমাজে অন্যকে দেখার মানসিকতা, প্রভু-দাসত্বের সম্পর্ক উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের রূপক বর্তমান বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির যুগেও সমভাবেই জাজ্বল্যমান সেটি পরিস্ফুটিত হয়েছে। গ্রন্থটি অনুধাবন করলে আমরা এই বিষয়টির সুস্পষ্ট বর্ণনা ফুটে উঠতে দেখতে পারি। কাজেই শুধুমাত্র ইতিহাস চর্চার আলোকে বা ইতিহাস পাঠকদের কাছেই নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে এই বইটির এক অন্যকথনের গল্প বলে যে গল্প জাতপাত, জাতি হিংসা, বৈষম্য প্রভৃতি বিষয়ের সংযোজনে জাতপাতের ইতিহাসে এই গ্রন্থটির গুরুত্বকে বর্নিত করে।

অনেক প্রশ্নের জবাব রূপ কুমার বর্মনের সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটি সজ্জা, জাতি ইতিহাসের নানা আঙ্গিকে বর্ননা, নির্ভরযোগ্য গ্রন্থতালিকা এবং সার্বিক-সুস্পষ্ট বর্ননা গ্রন্থটিকে অনন্য মাত্রা দান করে। হাল আমলে দাঁড়িয়ে জাতপাতের বর্ননা, আঞ্চলিক প্রেক্ষিত, জাতি-হিংসার নানা দিকের উন্মোচন এবং বিভিন্ন তথ্যাদির প্রয়োগে সার্বিকভাবে সমকালীন বাংলার জাতপাতের ইতিহাস নির্মানের ক্ষেত্রে এক দিকনির্দেশক পাঠ হয়ে উঠেছে রূপ কুমার বর্মনের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটি।

গ্ৰন্থ আলোচনা
সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ: জাতপাত, জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ
রূপ কুমার বর্মণ
গাঙচিল প্রকাশনী, কলকাতা, ২০২২, দাম- ৪০০ টাকা
.....

সাৰ্থক লাহা, গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

;

নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা



সোমঋতা মল্লিক
নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা

নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা

  • Font increase
  • Font Decrease

“তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু।

আমরা অবোধ, অন্ধ মায়ায় তাই তো কাঁদি প্রভু।।"

১৪ মে, সকাল। কলকাতার রবীন্দ্র সদনে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হল এই নজরুল সঙ্গীত। বহুল প্রচলিত গানটি এই বিশেষ দিনে আমার কাছে ধরা দেয় অন্যরূপে। সমুখে শায়িত রয়েছেন সদ্য প্রয়াত কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ শ্রীমতী কল্যাণী কাজী। নিথর দেহে পুষ্পের অঞ্জলি। তাঁকে ঘিরে তাঁর আপনজনদের এই মর্মস্পর্শী উচ্চারণ মনকে ব্যাকুল করে।

তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ ১২-১৩ বছরের আত্মিক সম্পর্ক। ছায়ানট (কলকাতা)-এর হাত ধরেই যদিও এই সম্পর্ক শুরু হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের পরিবারের একজন। তাঁর কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি তা অবর্ণনীয়। আমার জীবনে এই প্রথম নজরুল জন্মজয়ন্তী যেদিন কল্যাণী কাজী আর সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই। একথা ভাবলেই চোখ ভরে ওঠে জলে। বছরের এই বিশেষ দিনগুলিতে তাঁর সাথে দেখা হলে মনে হত, কি অসীম ভালোবাসায় তিনি আমাদের প্রাণের কবিকে অন্তরে ধারণ করেন। আর পাঁচজন শিশুর মতো তিনিও নজরুলকে ভালোবেসেছেন শৈশবেই।


'অন্তরঙ্গ অনিরুদ্ধ' বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, "ছেলেবেলা থেকেই আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। 'প্রভাতী', ‘লিচুচোর’ থেকে শুরু করে ‘বিদ্রোহী', 'আমার কৈফিয়ৎ’ ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘ইন্দ্রপতন’ প্রভৃতি কবিতা বিভিন্ন বয়সে মনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ছবিতে তাঁর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল আর বড় বড় ভাবালু চোখ দুটোর দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখার ইচ্ছা হত। মনে পড়ছে, একবার গৃহশিক্ষককে অনুরোধ করেছিলাম তাঁকে দেখতে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু কেন জানি না শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠেনি। নিয়তি সেদিন অলক্ষ্যে নিশ্চয় হেসেছিলেন। নয়ত যে মানুষটাকে শুধু মাত্র চোখের দেখা দেখবার জন্য সেদিন ব্যাকুল হয়েছিলাম - পরবর্তী জীবনে তাঁরই পরিবারের একজন হয়ে তাঁর কাছে থেকে তাঁকে সেবা করার সুযোগ পেলাম কি করে? একেই বোধহয় বলে ‘বিধিলিপি’!

এই বিরল ব্যক্তিত্বের খুব কাছের মানুষ হয়েও, দুর্ভাগ্যবশত আমি সুস্থ অবস্থায় তাঁকে পাইনি। আমি এ বাড়ীর ছোট বউ হয়ে আসার বেশ কয়েক বছর আগেই বিস্মৃতি তাঁর চেতনার ওপর কালো পর্দা টেনে দিয়েছিল। তবুও আমাদের সবার প্রিয় ‘মামনি’ প্রমীলার স্নেহচ্ছায়ায় থেকে, তাঁর যতটুকু সেবা করার সুযোগ পেয়েছি তাতেই আমি ধন্য।"


এভাবেই কাজী অনিরুদ্ধর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার সুবাদে নজরুল পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বহু অন্তরঙ্গ আড্ডায় তিনি পরিবারিক স্মৃতিচারণা করতেন।

প্রথমবার তাঁর শ্বশুরবাবা কে সামনে থেকে দেখার অনুভূতির বর্ণনা যখনই দিতেন, মনে হত আমরাও সেই সময়ে উপস্থিত হয়েছি। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারণ। অতি সামান্য ঘটনাও তাঁর বাচনভঙ্গিতে হয়ে উঠত অসাধারণ।

তাঁকে ঘিরেই জমে উঠত আড্ডা। কখনও কথা, আবার কখনও গেয়ে উঠতেন একের পর এক নজরুল সঙ্গীত। নিয়মিত দূরদর্শনে নজর রাখতেন কোন্ শিল্পী কিভাবে নজরুলের গান গাইছেন। বিভিন্ন চ্যানেলের প্রভাতী অনুষ্ঠান দেখতে খুবই ভালোবাসতেন। পরিচিত শিল্পী হলে অনুষ্ঠানের পরেই চলভাষের মাধ্যমে অভিনন্দন জানাতেন। এভাবেই তিনি ভালোবাসায় আবদ্ধ করে রাখতেন সকলকে।

নজরুল চর্চার সঙ্গে যুক্ত যে কোন ব্যক্তি/সংগঠনকে তিনি আপন করে নিতেন। তাঁর পূর্ণদাস রোডের বাড়িতে ছিল নজরুল প্রেমীদের নিত্য যাতায়াত। নজরুল বিষয়ক আলোচনায় তাঁর ক্লান্তি ছিলনা। যে কোন সময়, যে কোন পরিস্থিতে তিনি পাশে থেকেছেন। ২০১৭ সালে কলকাতার বুকে প্রথম নজরুল মেলার আয়োজন করে ছায়ানট (কলকাতা), উদ্বোধক কল্যাণী কাজী। শিশুদের জন্য নজরুলের লেখা ২৫টি ছড়া ও কবিতা নিয়ে ২০২১ সালে ছায়ানটের উদ্যোগে কল্যাণী কাজীর কণ্ঠে ‘শিশু কিশোরদের নজরুল’ শিরোনামে একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। পরম যত্নে তাঁর হাতে গড়া দল 'বিষের বাঁশী' ছায়ানট (কলকাতা) - এর বহু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে।


নজরুল সঙ্গীতের শিক্ষা তিনি কিভাবে পেয়েছিলেন সেই বিষয়ে কল্যাণী কাজী স্মৃতিচারণা করেছেন, "সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিল্পী শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে গান শেখার সুযোগ পাই। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে আমি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। বাংলা গানের সাথে সাথে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও যাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারি,  তিনি তার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমার তখন চটুল গানের দিকেই ঝোঁক বেশি, তাই রাগ সঙ্গীতের জটিল পথে চলতে মন চাইত না। যতদিন যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছি গলাকে স্ববশে রেখে গান গাইতে হলে, বিশেষ করে নজরুল গীতিকে প্রাণবন্ত করতে রাগ সঙ্গীত চর্চা খুবই দরকার।

আজ সঙ্গীতের শিক্ষকতা করতে গিয়ে নজরুল গীতির সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের সব রকমের বাংলা গানের চাহিদা যে মেটাতে পারি, তারজন্য আমি আমার গুরু শ্রদ্ধেয় শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। সেদিন যদি তিনি জোর করে খেয়াল, ঠুংরী, দাদরা, গীত, গজল এর সাথে সাথে কীর্তন, পুরাতনী, রাগপ্রধান প্রভৃতি গান না শেখাতেন, তবে গানের অনেক ধারাই আমার অজানা থেকে যেত। কাজী নজরুলের গানের সঙ্গে প্রকৃত পক্ষে তিনিই আমায় প্রথম পরিচয় করান। প্রথম যে নজরুল গীতিটা শিখিয়েছিলেন সেটা হল হাম্বির রাগে নিবদ্ধ 'আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া'। এরপর তিনি শেখালেন 'ভোরের ঝিলের জলে', 'প্রথম প্রদীপ জ্বালো', 'শাওন আসিল ফিরে', 'ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি' প্রভৃতি নজরুলের রাগভিত্তিক গানগুলো।


আমার স্বামী অনিরুদ্ধ যখন নজরুল গীতির স্বরলিপির বই 'রাগবিচিত্রা'-র প্রস্তুতি নেন, তখন আমিই হাম্বির রাগের গানটির স্বরলিপির কাজে সাহায্য করেছিলাম। তিনি গানটা জানতেন না। অপ্রচলিত গানটা পরে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।" 

তিনি অসুস্থ ছিলেন বেশ কয়েকমাস, কিন্তু তাঁর জীবনীশক্তি ছিল প্রবল। জীবনের বহু দুঃসময়কে তিনি জয় করেছিলেন অবলীলায়। ১২ মে ভোরে নজরুল অনুরাগীদের চোখের জলে ভাসিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন তিনি।

তাঁর কন্যা অনিন্দিতা কাজী বলেছেন মায়ের শেষ ইচ্ছের কথা। শোকবার্তায় অনিন্দিতা লিখেছেন - "মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর নিজের বাড়িতে (৭৪ এইচ, পূর্ণদাস রোড, ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক) দাদু ও ঠাকুমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটা আর্কাইভ হবে।"

আমরা সকলেই চাই তাঁর শেষ ইচ্ছে পূরণ হোক।

সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ও গবেষক। সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)।

;

বাজারে এলো আতিফ ওয়াফিকের বই ‘এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া’ 



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

এইচ এম আতিফ ওয়াফিক, যোগাযোগের ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ, তার সর্বশেষ বই "এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" বাজারে এসেছে। এই বইটি আজকের পাঠকদের দ্রুত-গতির বিশ্বে সঠিক আচরণের শিল্প সম্পর্কে একটি সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গি সরবরাহ করবে বলে লেখক মনে করেন।

একটি সমাজে যেখানে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, "এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" সেই ব্যক্তিদের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ হিসাবে কাজ করবে বলে লেখক মনে করেন। বিশেষ করে আজকের স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রী দের এই বই টি অনেক কাজে আসবে। এই বইটি পাঠকদের আধুনিক আচরণের সূক্ষ্মতা আয়ত্ত করতে সাহায্য করার জন্য ব্যবহারিক পরামর্শ এবং কার্যকরী টিপস প্রদান করে৷

"এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" যত্ন সহকারে গবেষণা করা হয়েছে, পাঠকদের সমসাময়িক শিষ্টাচারের নিয়ম সম্পর্কে সর্বশেষ অন্তর্দৃষ্টি এবং নির্দেশিকা প্রদান করে। এর সহজ ভাষা এবং উপস্থাপন উদাহরণ সহ, সমস্ত পটভূমির পাঠকদের জন্য উপযুক্ত, তারা তাদের সামাজিক দক্ষতা পোলিশ করতে চাইছে বা তাদের পেশাদার চিত্র উন্নত করতে চাইছে।

এইচ এম আতিফ ওয়াফিক একজন অন্বেষিত যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, তার আকর্ষক কথা বলার ব্যস্ততা এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ পরামর্শের জন্য পরিচিত। বর্তমানে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স এ ।

রিডিং ক্যাফে, বনানীতে বইটি উন্মোচনের সময়, জনাব ববি হাজ্জাজ (একজন অক্সফোর্ড স্কলার), জনাব সোলায়মান শুকন (একজন বাংলাদেশী যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ), জনাব শাহরিয়ার নাফীস (সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার), জনাব হাসান মাহমুদ (প্রতিষ্ঠাতা, স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ার্স), জনাব বেনজির আবরার (প্রতিষ্ঠাতা, এক্সিলেন্স বাংলাদেশ), মিসেস আফরুজা তানজি (রাষ্ট্রদূত, ওয়ান ইয়াং ওয়ার্ল্ড), মিসেস শারমিন কবির (প্রতিষ্ঠাতা, রিতু), মিসেস ইশরাত নাহের ইরিনা (প্রতিষ্ঠাতা, প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশ), জনাব ফাহিন আরাফিন (ক্রিয়েটিভ হেড, স্বপ্ন), জনাব সালেহীন মাহবুব (বিশ্ববিদ্যালয় অনুষদ), মিসেস ফারহানা শারমিন (ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজিস্ট, রিমার্ক এইচবি), এবং আরও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী প্রিয় শিক্ষার্থীউপস্থিত ছিলেন।

;

কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'



কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'

কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'

  • Font increase
  • Font Decrease

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তিনি একক ও অনন্য। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। যার অগ্নিঝরা লেখনি ত্রস্ত করেছে ঔপনিবেশিক শাসকদের। যার বই বার বার বাজেয়াপ্ত হয়েছে। যাকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন।

নজরুল শতবর্ষ আগে বন্দি ছিলেন কলকাতার আলীপুর সেন্ট্রাল জেলখানায়। নজরুল বিষয়ক সংগঠন ছায়ানট কলকাতা শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা-গবেষণার পাশাপাশি নজরুল স্মৃতিধন্য হেরিটেজ স্থান ও স্থাপনাসমূহ রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সক্রিয় রয়েছে। ছায়ানট কলকাতার সভাপতি, বিশিষ্ট শিল্পী, সোমঋতা মল্লিক কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের নজরুলতীর্থগুলো নিজে গিয়ে সেগুলো রক্ষার প্রশাসনিক ও নাগরিক তৎপরতা চালিয়ে ছিলেন। যার ফলে এবছর নজরুল জয়ন্তীতে কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে স্থাপিত হয়েছে 'নজরুল কক্ষ'।


ছায়ানট কলকাতা সভাপতি সোমঋতা মল্লিক বার্তা২৪.কম'কে জানান, গত ১৪ ডিসেম্বর,২০২২ তারিখে ছায়ানট (কলকাতা) তথ্য সহ WBHIDCO - এর কাছে এই মর্মে আবেদন করে যে, নজরুল স্মৃতি বিজড়িত আলিপুর জেল মিউজিয়ামে কাজী নজরুল ইসলাম যে জায়গায় বন্দি হিসেবে ছিলেন, সেই জায়গাটি চিহ্নিত করা এবং নজরুল মূর্তি স্থাপন করার জন্য।

তিনি বলেন, গত ১৭ জানুয়ারি,২০২৩ তারিখে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নজরুলের আগমনের শতবর্ষকে স্মরণ করে ছায়ানট (কলকাতা) এবং আলিপুর মিউজিয়াম যৌথভাবে একটি অনুষ্ঠানও পালন করে।

শনিবার (২৬ মে) আমরা সত্যিই আনন্দিত, আমাদের এই প্রস্তাব তাঁরা বিবেচনা করেছেন এবং আলিপুর মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ' তৈরি হয়েছে, জানান সোমঋতা মল্লিক।

;