বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ
শাশ্বত, চির-আধুনিক রবীন্দ্রনাথকে অনুভবের প্রধান অবলম্বন তাঁর সুবিশাল সৃষ্টি সম্ভার। যেখানে রয়েছে, ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর মোট ৯৫টি ছোটগল্প এবং ১৯১৫টি গান যথাক্রমে ‘গল্পগুচ্ছ’ ও ‘গীতবিতান’ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২টি খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সকল পত্রসাহিত্য ১৯ খণ্ডে ‘চিঠিপত্র’ সংকলনে ও অন্য চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের এই সুবিশাল রচনাসমূহের সম্পূর্ণ পাঠ গ্রহণকারীর সংখ্যা অবশ্যই মুষ্টিমেয়। বিশ্বায়নের দ্রুতলয় পরিস্থিতিতে অতি-ব্যস্ত মানুষের জীবন বাস্তবতায় পাঠের সময় ও সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু নির্বাচিত ও বিশেষ পাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ‘আমাদের রবীন্দ্রনাথ’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, “সর্বভারতীয় একটি বাংলা দৈনিকে ফি শনিবার ‘বেস্টসেলার’ কুড়িটি বাংলা বইয়ের তালিকা ছাপা হয়। বলা বাহুল্য যে প্রতি সপ্তাহেই সেই তালিকায় অদল-বদল হয় খানিকটা এবং যদ্দুর মনে পড়ছে, সাম্প্রতিক অতীতে ‘গল্পগুচ্ছ’ আর ‘গীতবিতান’ ছাড়া রবীন্দ্রনাথের আর কোনো সংকলন সেই তালিকায় স্থান পায়নি” (রাহুল দাস, ‘কোথায় পাব তারে’, আমাদের রবীন্দ্রনাথ, তপোধীর ভট্টাচার্য (সম্পা.), কলকাতা: একুশ শতক, ২০১২, পৃ. ১৯১)।
রবীন্দ্রনাথকে অনুধ্যানের দ্বিতীয় মাধ্যম হলো, তাঁর ও তাঁর রচনাসমূহ সম্পর্কে রচিত ও প্রকাশিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গ্রন্থ, যার পরিমাণও রবীন্দ্র রচনাবলির মতোই সুবিশাল এবং সব লেখাই সর্বদা সুলভ নয় কিংবা প্রয়োজনের সময় হাতের কাছে যে পাওয়া যাবেই, সে সম্পর্কে তেমন নিশ্চয়তাও নেই।
তৃতীয় ও সর্বশেষ যে মাধ্যমে আমরা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি, তা হলো, আমাদের অভিজ্ঞতা। আমাদের জীবন যাপনের বাঁকে বাঁকে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচরণে, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পঠনে, পাঠনে, চর্চায় যে অভিজ্ঞতা প্রতিটি বাঙালিই সঞ্চয় করেন এবং এরই মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব মনোভাব তৈরি হয়।
বাস্তব বিষয় হলো, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, অঞ্চলে অঞ্চলে, বিশ্বাসে-দর্শনে এই অভিজ্ঞতার ধরণ সঙ্গত কারণেই স্বতন্ত্র ও আলাদা এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মনোভাবও এজন্য বিচিত্র, বিভিন্ন, প্রশংসা ও সমালোচনাপূর্ণ। বহুমাত্রিক, জ্যোতির্ময় রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে ব্যক্তিগত অধ্যয়নকালে এসব বিষয় এড়িয়ে যাওয় অসম্ভব। এরই মধ্যে যে মনোভাব সৃজন হয়, সেটাই ‘আমাদের রবীন্দ্রনাথ’ কিংবা ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’। এখানে ‘আমাদের’ ও ‘আমার’ আর্থ-সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক-মতাদর্শিক অবস্থান ও ভূমিকা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, যার ভিত্তিতে রবীন্দ্র বিষয়ক যাবতীয় আলাপ, আলোচনা, সমালোচনা অবয়ব লাভ করেছে। এবং এখানেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মতোই রবীন্দ্রচর্চার নান্দনিক সৌন্দর্য ও বহুমাত্রিকতা বিভা আলোকোজ্জ্বল দীপ্তিতে গৌরবান্বিত।
বলে রাখা ভালো, “বাংলা সাহিত্যের পরিমণ্ডলে কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন যারা হয়েছেন, তাদের মধ্যে শীর্ষগণ্য রবীন্দ্রনাথ। সেই রবীন্দ্রনাথের দ্বারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন কে? কৌতূহলোদ্দীপক এই জিজ্ঞাসার উত্তরে যার নাম উদ্ভাসিত হয়, তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)। আরো বিশেষভাবে বলা যায়, মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১)। আমরা মনে করি, একজন মহৎ কবির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় মধুসূদনের মহাকবিত্বের মহিমা বেড়েছে বৈ কমেনি। আক্রমণাত্মক সমালোচনাকারীর তালিকায় রয়েছেন আরো দু’জন বিদগ্ধ কবি-সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০) ও বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪)। দূরপরবর্তীকালের দুবিনীত সমালোচনাসমূহ প্রকারান্তরে এই কথাই প্রমাণ করে যে, আক্রান্ত হওয়ার যোগ্যতা যার রয়েছে, তিনি মনোযোগ্য ও অপরিহার্যও বটে” (ময়ুখ চৌধুরী, ‘মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা: পুনর্বিচার’, নুরুল আমিন (সম্পা.), পাণ্ডুলিপি, বাংলা সাহিত্য সমিতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রয়োবিংশ সংখ্যা, ২০১৫, পৃ. ৯)।
সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে আসা বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ ও বাঙালি মননের নিত্যসঙ্গী রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা বাতুলতা মাত্র। বরং সমকালীন পটভূমিতে জ্বাজ্জল্যমান এজেন্ডা, ইস্যু ও বাস্তবতায় তাঁকে এবং তাঁর কাজকে প্রতিস্থাপন করাই সঙ্গত। আলোচনা ও সমালোচনা এবং সংগতি ও অসংগতির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বীক্ষণের তেমনি এক প্রয়াস সময় ও বাস্তবতার দাবি।
সংগতি ও অসংগতির রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে আনিসুজ্জামানের মতো একজন বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞের অভিমত হলো, “আশি বছরের দীর্ঘজীবন যিনি যাপন করেছেন, যে জীবন সৃষ্টিশীলতায় অনন্য, অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, ঘাত-প্রতিঘাতে চঞ্চল, সেই দীর্ঘজীবনে পূর্বপর সংগতি বজায় রাখা কি সম্ভবপর না সংগত? কালে কালে তাঁর ধ্যানধারণার পরিবর্তন হয়েছে, মত বদলেছে, ভালোমন্দ বোধের বদল হয়েছে। সেটা স্বাভাবিকও। কিন্তু কখনো কখনো তাঁর বক্তব্য বা কাজকে পরস্পরবিরোধী বা সংগতিহীন বলেও মনে হয়েছে” (আনিসুজ্জামান, ‘নানা রবীন্দ্রনাথের মালা’, নুরুল আমিন (সম্পা.), পাণ্ডুলিপি, বাংলা সাহিত্য সমিতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বাবিংশ সংখ্যা, ২০১৪, পৃ. ৯)।
রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর সম্পর্কে উদাসীন তো ছিলেনই না, বরং অনেকটাই নিষ্ঠুর সত্যভাষী ছিলেন। একটি স্বল্প উল্লেখিত তথ্য থেকে জানা যায়, “রবীন্দ্রনাথ একবার যখন বিলেতে, স্কুলের একদল ছাত্রছাত্রী তাঁর হাতে এক ছাপানো প্রশ্নমালা তুলে দিয়েছিল উত্তর প্রার্থনা করে। তার একটি প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয় কবির সর্বোত্তম গুণ কী? অপর একটিতে জিজ্ঞাসা করা হয় তাঁর সর্বাধিক দোষ কী? একটিমাত্র শব্দে দুটি প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ: Inconsistency অসংগতি?” ফলে আনিসুজ্জামান সংগতি-অসংগতির পরস্পর বিরোধিতার উপসংহার টেনেছেন এই বলে যে, “চেষ্টা করবো নানা রবীন্দ্রনাথের মালাকে-বিশ্লিষ্ট করে নয়-যতটা সম্ভব, অখণ্ডরূপে দেখতে।”
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সমীক্ষায় প্রাসঙ্গিক নানামুখী তথ্যের সমাবেশ যতদূর সম্ভব ঘটানো হলেও শেষ বিচারে তাঁর বহুমাত্রিকতার রূপ ও চরিত্র সুস্পষ্ট অবয়ব লাভ করে। তাঁর রচনাসমূহের মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন অদ্যাবধি আমাদেরকে প্রাণিত ও উদ্দীপ্ত করে। ৮২তম প্রয়াণ দিবসেও তিনি উজ্জ্বলতম। বর্ষাবিধৌত জন্মদিনের মতোই প্রতিটি ২২শে শ্রাবণে বাঙালি ঋদ্ধ ও সিক্ত হয় রবীন্দ্রনাথের বহুমাত্রিক সৃষ্টিসম্ভারে।