কবি আবুবকর সিদ্দিকের সাথে দেখা হয়েছিলো
[কবি আবুবকর সিদ্দিকী অনন্তের পথে যাত্রা করলেন কিছুকাল আগে তাঁকে নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। শ্রদ্ধার্ঘ্য রূপে লেখাটির পুনরুল্লেখ করছি আজ।
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ „ চট্টগ্রাম ]
কবি আবুবকর সিদ্দিকের সাথে কখন পরিচয় হয়েছিলো, সন-তারিখ মনে নেই। সম্ভবত সেটি ঘটেছিলো গত শতকের শেষের দিকে কিংবা চলতি শতকের শুরুর দশকে। বহুকাল আগেরই স্মৃতি।
প্রথম আলাপে উচ্ছ্বসিত আবেগে বলছিলেন এদেশের পাহাড়ী জনপদের বাসিন্দাদের অতি আন্তরিক আতিথেয়তার নানান কাহিনী-কথা। সদ্য তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরে শহর চট্টগ্রামে এসেছেন। পরিচিত কারো কাছে আমাদের, অর্থাৎ "স্পার্ক জেনারেশন"-এর সদস্যদের কারো সাথে কিছুক্ষণের দেখা-সাক্ষাৎ ও আড্ডায়-আলাপে বসা যায় কিনা, তার খোঁজ-খবর করছিলেন। কে যে সেদিন কবি আবুবকর সিদ্দিকের সাথে কবি আবসার হাবীবের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলো, আজ তা এতোকাল পরে মনে পড়ে না। কিন্তু ভাবি, সে সংযোগটা হয়ে ভালোই হয়েছিলো।
ততদিনে, স্পার্ক জেনারেশনের সদস্যরা পেশার সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতিতে, এই স্পার্ক জেনারেশন চট্টগ্রাম থেকে এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী এক প্রতিবাদী সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা করেছিলো। সেই প্রতিবাদী সাহিত্য আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র ঠেকানোর লক্ষ্যে জাগরণের ডাক ছিলো কিনা, তা বোঝার জন্যে কবি আবসার হাবীব ও আমার সাথে দীর্ঘক্ষণ প্রশ্নাতুর হয়েই, আবসারের দেউড়ি ঘরের চিলে-কামরায় কবি আবুবকর সিদ্দিক একটি মগ্ন অপরাহ্ন থেকে শুরু করে অতিক্রান্ত সন্ধ্যাউত্তীর্ণ কাল পর্যন্ত অতিবাহিত করেন। স্পার্ক জেনারেশানের বিভিন্ন প্রকাশনা, লিফলেট সাহিত্য, পোস্টার সাহিত্য এবং 'সম্পাদক' প্রকাশনীর নানাবিধ প্রকাশনা কাণ্ডগুলোকে পরখ করে দেখতে দেখতে, এসবই লেখক তৈরির 'কৌশলের খেলা বলে' মন্তব্য করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক কবি আবুবকর সিদ্দিক "স্পার্ক জেনারেশান"-এর লেখক তৈরির কৌশলটি যে যথার্থই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা তাঁর এ ধরনের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা গিয়েছিলো।
এদেশের কিছু বাছাইকরা কবিকে নিয়ে 'সম্পাদক' প্রকাশনী "স্বনির্বাচিত" প্রকাশ করেছিলো। কাব্য সংগ্রহটি দেখে আবুবকর সিদ্দিক বেশ চমৎকৃত হয়েই বলেছিলেন, এই সংগ্রহশালায় সম্ভবত আমার কবিতা আর কাব্যভাবনাও থাকতে পারতো। বল্লাম, পারতো থাকতে। কিন্তু, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভালো ভালো কবি-লেখকেরা প্রচার পান না বলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে যায়। আবুবকর সিদ্দিক বই থেকে মুখ তুলে তাকান। তারপর বল্লেন, তা ঠিকই বলেছেন। সে কথা থাক, শিল্পী মুর্তজা বশীর কিন্তু লেখকদের ছবির স্কেচগুলো রেখাচিত্রের টানে আকর্ষণীয়ই করেছেন। তবে, একটি বিষয় লক্ষ্য করছি, তা হচ্ছে সব স্কেচেই তিনি একই স্বাক্ষর দেন নি। তাই না ? কিন্তু কোনো ? বল্লাম, আপনার দৃষ্টি এড়ায় নি দেখছি। স্বাক্ষরের পার্থক্যটা সর্ব সাধারণ্যে খোলাসা করা যাবে না। শিল্পীর বারণ আছে। আসলেই, কাহিনীটা কিছুটা নাজুকই।
এভাবে কথার পিঠে কথা বলতে বলতে অনেক ধরনের আলাপই হয়েছিলো। তিনি কতোটুকু বাম-ভাবনায় তাঁর নোঙর ফেলে চলছেন, সেই প্রশ্নটিও উঠে এসেছিলো। আমাদের তৎকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক, সম্প্রদায়িক আর সাংস্কৃতিক গতিপ্রকৃতির নিয়ে মত বিনিময়ে ঐকমত্যের সিঁড়ি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তা সত্ত্বেও, আলাপে-আলোচনায় কোথাও-না কোথাও ভাবনায় আর উপলব্ধির ক্ষেত্রেও কিছু কিছু ব্যাখ্যার ভিন্নতা প্রকাশ ও সমঝোতা সৃষ্টির সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা।
চমৎকার একজন কবি-মানুষের সাথে সেদিন মিলেছিলাম আমরা। আমাদের পরস্পরকে চিনেছিলাম। তাতে জানাও হয়েছে অনেকটাই। বুঝেছিলাম মানুষেরা তাদের সব ধরনের প্রতিকূলতার বিপক্ষে নিজ নিজ বোধকে সম্বল করেই দাঁড়ায় ও নিজেকে পরিচালিত করে। ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেকেই একা। যূথবদ্ধতার অবয়ব গঠন করলে তা শুধু উদ্যম ও প্রেরণার জোগান দেয় মাত্র। লেখকদের একাই হাঁটতে হয়। যূথবদ্ধ আন্দোলন পরিবেশই গড়ে দেয়।
কবি আবুবকর সিদ্দিক কেবল কবিতাই লিখে গেছেন, তা নয়। বেশ কিছু গণসঙ্গীতও রচনা করেছেন। এবং সেগুলো এক সময়ে বহুল পরিমানে গীতও হয়েছে। বাংলাসাহিত্যে আবু বকর সিদ্দিক একজন স্মরণে রাখার মতোই কবি। তাঁর বেশকিছু কাব্যগ্রন্থ আছে। ১৯৬৯ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "ধবল দুধের স্বরগ্রামে" প্রকাশিত হয়। তাঁর এই একটি বই-ই আমি পড়েছি। সেকালে ঘোর বামপন্থার সাথে ওতোপ্রোত ভাবে সংযুক্তির কারণে বইটি দ্রুতই আমার হাতে এসে পৌঁছয়। পরে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আবু বকর সিদ্দিকের কবিতা পেলেই তাঁকে অনুভব করার চেষ্টা করেছি।
১৯৩৪ সালের ১৯শে আগস্ট তাঁর জন্ম। বাগেরহাটে তাঁর পৈতৃক নিবাস বলেই জানা যায়। গাঙ্গেয় বদ্বীপের, আমাদের এই বঙ্গভূমির ৮৭টি পূর্ণ ঋতুচক্রকে তিনি তাঁর জীবনকালে ধারণ করে আছেন। বয়ঃভারাক্রান্ত হওয়ার ফলে আগের মতো সৃষ্টিশীলতায় তিনি এখন আর বিশেষ সমর্থ নন।
নিজেদের বসবাসের ভিটেবাড়ি হারানোর এক ধরনের বেদনা দেখেছি আবুবকর সিদ্দিকের মনের ভেতরে। তা প্রকাশ পেয়েছে আমাদের সাথে সেদিনের আড্ডায়। তাঁর হৃদয়ের এক কোণায় ওই বেদনার ভার বড়ো ভারী হয়ে রয়েছে। ১৯৪৭-এর দেশভাগ, পশ্চিমবঙ্গের কোনো এক গৃহকোণ থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করেছে। পরিণত বয়সে স্মৃতির বসতবাড়িটি দেখতে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। গ্রামদর্শন শেষে বাড়িটিও দর্শন করেন। সেই সময়ে ওই বাড়িতে বসবাসকারীকে অনুরোধ করে গৃহ অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন। খানিকটা ছুঁয়ে এসেছেন নিজের বাল্যস্মৃতিকে। আবুবকর সিদ্দিক লক্ষ করেছেন তা্র সাথে কয়েকজন সঙ্গীসাথী হোমরা-চোমরা ব্যক্তিবর্গ থাকায় ঘরের মালিক শঙ্কা বোধ করেছেন, না-জানি গৃহ মালিকানা-না কোনোদিন ছেড়ে দিতে হয়! আসলে, কোনো অনুষ্ঠানের অতিথি হয়েই তিনি হয়তো সেই এলাকার কাছাকাছি গিয়েছিলেন। ছেলেবেলাকার পূর্ব অবস্থানের স্মৃতির বিষয়টি ব্যক্ত করেছিলেন আয়োজক কর্মকর্তাবৃন্দের কাছে। তাঁরাই হয়তো পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন।
আমাদের কাছেও এ সমস্ত কথার ঝুড়ি তিনিই খুলে ধরেছিলেন, সেই একদিনের আলাপে, আড্ডায়। তখনই মন হয়েছিলো তাঁর জন্ম বুঝি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে। পরে শুনি যে তাঁর জন্মস্থান বাগেরহাটে। ইতিহাস কতো কথাই-না বলে! তাই, হতে পারে সবকিছুই। সন্তানের জন্ম পিতার কর্মস্থলের বাড়িতেও হতে পরে। আদি বাস অন্য কোথাও হলে সেখানেও জন্ম হতে পারে। কিংবা আদি বাসস্থানে জন্ম নেওয়ার পর পিতার কর্মস্থলে গিয়ে বসবাসও হতে পারে। কবি আবুবকর সিদ্দিক আবেগাপ্লুত হয়ে স্মৃতির বসতবাড়ি পুন-দর্শনের গল্পই করেন আমাদের কাছে।
সে রাতে কবি আবসার হাবীবের বাসায় নৈশ আহারে ক্ষণিকের অতিথি হয়েই বিদায় নেন কবি আবুবকর সিদ্দিক। তারপর আর দেখা হয় নাই।