কবি আবুবকর সিদ্দিকের সাথে দেখা হয়েছিলো



স্বপন দত্ত
কবি আবুবকর সিদ্দিকী

কবি আবুবকর সিদ্দিকী

  • Font increase
  • Font Decrease

[কবি আবুবকর সিদ্দিকী অনন্তের পথে যাত্রা করলেন কিছুকাল আগে তাঁকে নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। শ্রদ্ধার্ঘ্য রূপে লেখাটির পুনরুল্লেখ করছি আজ।

২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ „ চট্টগ্রাম ]

কবি আবুবকর সিদ্দিকের সাথে কখন পরিচয় হয়েছিলো, সন-তারিখ মনে নেই। সম্ভবত সেটি ঘটেছিলো গত শতকের শেষের দিকে কিংবা চলতি শতকের শুরুর দশকে। বহুকাল আগেরই স্মৃতি।

প্রথম আলাপে উচ্ছ্বসিত আবেগে বলছিলেন এদেশের পাহাড়ী জনপদের বাসিন্দাদের অতি আন্তরিক আতিথেয়তার নানান কাহিনী-কথা। সদ্য তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরে শহর চট্টগ্রামে এসেছেন। পরিচিত কারো কাছে আমাদের, অর্থাৎ "স্পার্ক জেনারেশন"-এর সদস্যদের কারো সাথে কিছুক্ষণের দেখা-সাক্ষাৎ ও আড্ডায়-আলাপে বসা যায় কিনা, তার খোঁজ-খবর করছিলেন। কে যে সেদিন কবি আবুবকর সিদ্দিকের সাথে কবি আবসার হাবীবের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলো, আজ তা এতোকাল পরে মনে পড়ে না। কিন্তু ভাবি, সে সংযোগটা হয়ে ভালোই হয়েছিলো।

ততদিনে, স্পার্ক জেনারেশনের সদস্যরা পেশার সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতিতে, এই স্পার্ক জেনারেশন চট্টগ্রাম থেকে এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী এক প্রতিবাদী সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা করেছিলো। সেই প্রতিবাদী সাহিত্য আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র ঠেকানোর লক্ষ্যে জাগরণের ডাক ছিলো কিনা, তা বোঝার জন্যে কবি আবসার হাবীব ও আমার সাথে দীর্ঘক্ষণ প্রশ্নাতুর হয়েই, আবসারের দেউড়ি ঘরের চিলে-কামরায় কবি আবুবকর সিদ্দিক একটি মগ্ন অপরাহ্ন থেকে শুরু করে  অতিক্রান্ত সন্ধ্যাউত্তীর্ণ কাল পর্যন্ত অতিবাহিত করেন। স্পার্ক জেনারেশানের  বিভিন্ন প্রকাশনা, লিফলেট সাহিত্য, পোস্টার সাহিত্য এবং 'সম্পাদক' প্রকাশনীর নানাবিধ প্রকাশনা কাণ্ডগুলোকে পরখ করে দেখতে দেখতে, এসবই লেখক তৈরির 'কৌশলের খেলা বলে'  মন্তব্য করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক কবি আবুবকর সিদ্দিক "স্পার্ক জেনারেশান"-এর লেখক তৈরির কৌশলটি যে যথার্থই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা তাঁর এ ধরনের  প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা গিয়েছিলো।

এদেশের কিছু বাছাইকরা কবিকে নিয়ে 'সম্পাদক'  প্রকাশনী "স্বনির্বাচিত" প্রকাশ করেছিলো। কাব্য সংগ্রহটি দেখে আবুবকর সিদ্দিক বেশ চমৎকৃত হয়েই বলেছিলেন, এই সংগ্রহশালায় সম্ভবত আমার কবিতা আর কাব্যভাবনাও থাকতে পারতো। বল্লাম, পারতো থাকতে। কিন্তু, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভালো ভালো কবি-লেখকেরা প্রচার পান না বলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে যায়। আবুবকর সিদ্দিক বই থেকে মুখ তুলে তাকান। তারপর বল্লেন, তা ঠিকই বলেছেন। সে কথা থাক, শিল্পী মুর্তজা বশীর কিন্তু লেখকদের ছবির স্কেচগুলো রেখাচিত্রের টানে আকর্ষণীয়ই করেছেন। তবে, একটি বিষয় লক্ষ্য করছি, তা হচ্ছে সব স্কেচেই তিনি একই স্বাক্ষর দেন নি। তাই না ? কিন্তু কোনো ? বল্লাম, আপনার দৃষ্টি এড়ায় নি দেখছি। স্বাক্ষরের পার্থক্যটা সর্ব সাধারণ্যে খোলাসা করা যাবে না। শিল্পীর বারণ আছে। আসলেই, কাহিনীটা কিছুটা নাজুকই।

এভাবে কথার পিঠে কথা বলতে বলতে অনেক ধরনের আলাপই হয়েছিলো। তিনি কতোটুকু বাম-ভাবনায় তাঁর নোঙর ফেলে চলছেন, সেই প্রশ্নটিও উঠে এসেছিলো। আমাদের তৎকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক, সম্প্রদায়িক আর সাংস্কৃতিক গতিপ্রকৃতির নিয়ে মত বিনিময়ে ঐকমত্যের সিঁড়ি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তা সত্ত্বেও, আলাপে-আলোচনায় কোথাও-না কোথাও ভাবনায় আর উপলব্ধির ক্ষেত্রেও কিছু কিছু ব্যাখ্যার ভিন্নতা প্রকাশ ও সমঝোতা সৃষ্টির  সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা।

চমৎকার একজন কবি-মানুষের সাথে সেদিন মিলেছিলাম আমরা। আমাদের পরস্পরকে চিনেছিলাম। তাতে জানাও হয়েছে অনেকটাই। বুঝেছিলাম মানুষেরা তাদের সব ধরনের প্রতিকূলতার বিপক্ষে নিজ নিজ বোধকে সম্বল করেই দাঁড়ায় ও নিজেকে পরিচালিত করে। ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেকেই একা। যূথবদ্ধতার অবয়ব গঠন করলে তা শুধু উদ্যম ও প্রেরণার জোগান দেয় মাত্র। লেখকদের একাই হাঁটতে হয়। যূথবদ্ধ আন্দোলন পরিবেশই গড়ে দেয়।

কবি আবুবকর সিদ্দিক কেবল কবিতাই লিখে গেছেন, তা নয়। বেশ কিছু গণসঙ্গীতও রচনা করেছেন। এবং সেগুলো এক সময়ে বহুল পরিমানে গীতও হয়েছে। বাংলাসাহিত্যে আবু বকর সিদ্দিক একজন স্মরণে রাখার মতোই কবি। তাঁর বেশকিছু কাব্যগ্রন্থ আছে। ১৯৬৯ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "ধবল দুধের স্বরগ্রামে" প্রকাশিত হয়। তাঁর এই একটি বই-ই আমি পড়েছি। সেকালে ঘোর বামপন্থার সাথে ওতোপ্রোত ভাবে সংযুক্তির কারণে বইটি দ্রুতই আমার হাতে এসে পৌঁছয়। পরে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আবু বকর সিদ্দিকের কবিতা পেলেই তাঁকে অনুভব করার চেষ্টা করেছি।

১৯৩৪ সালের ১৯শে আগস্ট তাঁর জন্ম। বাগেরহাটে তাঁর পৈতৃক নিবাস বলেই জানা যায়। গাঙ্গেয় বদ্বীপের, আমাদের এই বঙ্গভূমির ৮৭টি পূর্ণ ঋতুচক্রকে তিনি তাঁর জীবনকালে ধারণ করে আছেন। বয়ঃভারাক্রান্ত হওয়ার ফলে আগের মতো সৃষ্টিশীলতায় তিনি এখন আর বিশেষ সমর্থ নন।

নিজেদের বসবাসের ভিটেবাড়ি হারানোর এক ধরনের বেদনা দেখেছি আবুবকর সিদ্দিকের মনের ভেতরে। তা প্রকাশ পেয়েছে আমাদের সাথে সেদিনের আড্ডায়। তাঁর হৃদয়ের এক কোণায় ওই বেদনার ভার বড়ো ভারী হয়ে রয়েছে। ১৯৪৭-এর দেশভাগ, পশ্চিমবঙ্গের কোনো এক গৃহকোণ থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করেছে। পরিণত বয়সে স্মৃতির বসতবাড়িটি দেখতে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। গ্রামদর্শন শেষে বাড়িটিও দর্শন করেন। সেই  সময়ে ওই বাড়িতে বসবাসকারীকে অনুরোধ করে গৃহ অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন। খানিকটা ছুঁয়ে এসেছেন নিজের বাল্যস্মৃতিকে। আবুবকর সিদ্দিক লক্ষ করেছেন তা্র সাথে কয়েকজন সঙ্গীসাথী হোমরা-চোমরা ব্যক্তিবর্গ থাকায় ঘরের মালিক শঙ্কা বোধ করেছেন, না-জানি গৃহ মালিকানা-না কোনোদিন ছেড়ে দিতে হয়! আসলে, কোনো অনুষ্ঠানের অতিথি হয়েই  তিনি হয়তো সেই এলাকার কাছাকাছি গিয়েছিলেন। ছেলেবেলাকার পূর্ব অবস্থানের স্মৃতির বিষয়টি ব্যক্ত করেছিলেন আয়োজক কর্মকর্তাবৃন্দের কাছে। তাঁরাই হয়তো পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন।

আমাদের কাছেও এ সমস্ত কথার ঝুড়ি তিনিই খুলে ধরেছিলেন, সেই একদিনের আলাপে, আড্ডায়। তখনই মন হয়েছিলো তাঁর জন্ম বুঝি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে। পরে শুনি যে তাঁর জন্মস্থান বাগেরহাটে। ইতিহাস কতো কথাই-না বলে! তাই, হতে পারে সবকিছুই। সন্তানের জন্ম পিতার কর্মস্থলের বাড়িতেও হতে পরে। আদি বাস অন্য কোথাও হলে সেখানেও জন্ম হতে পারে। কিংবা আদি বাসস্থানে জন্ম নেওয়ার পর পিতার কর্মস্থলে গিয়ে বসবাসও হতে পারে। কবি আবুবকর সিদ্দিক আবেগাপ্লুত  হয়ে স্মৃতির বসতবাড়ি পুন-দর্শনের গল্পই করেন আমাদের কাছে।

সে রাতে কবি আবসার হাবীবের বাসায় নৈশ আহারে ক্ষণিকের অতিথি হয়েই বিদায় নেন কবি আবুবকর সিদ্দিক। তারপর আর দেখা হয় নাই।

   

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সময়ের লড়াকু বুদ্ধিজীবী



আজফার হোসেন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আজীবন বিরাজমান নিপীড়ক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে গেছেন। আর ওই ব্যবস্থাকে বদলানোর স্বার্থেই, অর্থাৎ মানুষের মুক্তির স্বার্থেই তিনি তাঁর লড়াকু প্রশ্ন ও চিন্তাকে অন্যের কাছে নিয়ে গেছেন ক্লান্তিহীনভাবে। আমি মনে করি, এটাই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর কাজে-চিন্তায় শুধু চিন্তাই থাকে না, প্রশ্ন কেবল প্রশ্নেই থাকে না, সেগুলো হয়ে ওঠে মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের হাতিয়ারও।

২৩ জুন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৯তম জন্মদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে তিনি ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। প্রথমে তাঁকে দেখেছি দূর থেকে, তারপর দেখেছি শ্রেণিকক্ষে, যেখানে তাঁর একেকটি বক্তৃতাকে মনে হতো একেকটি মহাকাব্যিক ঘটনা, যার সম্পূর্ণ তাৎপর্য বুঝে ওঠার ক্ষমতা তখনো অর্জন না করলেও পরিষ্কার বুঝতাম যে আমার এই অসাধারণ বাগ্মী শিক্ষক শুধুই বলেন না, দেখানও। আর বিষয়কে একই সঙ্গে সহজ ও সুন্দর করে উপস্থাপনও করেন, যেখানে তাঁর নিজস্বতা সব সময় স্পষ্ট হয়ে থাকে। দেশে ও বিদেশে আমি নিজেই ইংরেজি সাহিত্য পড়েছি এবং পড়িয়েছি। অবশ্যই বলতে হবে যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো মনীষাসম্পন্ন ও প্রতিভাবান ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক খুব কম দেখেছি। কিন্তু এখানে শুধু শিক্ষক হিসেবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রশংসা করা আমার উদ্দেশ্য নয়; বরং তাঁর কাজের সমগ্রকে বিবেচনায় রেখেই এই রচনার সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাঁর বিশাল কর্মকা-ের দু-একটি তাৎপর্য সামনে আনতে চাই।

ইংরেজি সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষক তো বটেই, তিনি একাধারে সংস্কৃতি সমালোচক, সমাজ বিশ্লেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক, ইতিহাসবেত্তা, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, কলামিস্ট, সম্পাদক, অ্যাকটিভিস্ট, সংগঠক। এমনকি তিনি কিশোরদের জন্য গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখেছেন বিস্তর। তাদের জন্য বিদেশি সাহিত্য থেকে অনুবাদও করেছেন। তাঁর বইয়ের সংখ্যা একশত ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে তাঁর অসংখ্য অসংকলিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ-রচনা। অর্থাৎ প্রায় সারা জীবন তিনি ক্লান্তিহীনভাবে লিখে চলেছেন। তাঁর অপ্রতিরোধ্য লেখনীশক্তি তাঁর তারুণ্যকে চিহ্নিত করে রেখেছে এই বয়সেও।

পরিষ্কার যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অনেক এলাকায় বিচরণ করেছেন। তবে বিষয়ের বিবেচনায় তাঁর কাজের বড় এলাকা হচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য। কার্ল মাকর্সের প্রিয় প্রবচন ছিল, ‘যা কিছু মানুষের তা আমার অনাত্মীয় নয়।’ কথাটা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজের ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যবহার করা যাবে। বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেন যে বুদ্ধিজীবী কেবল বিশেষজ্ঞ নন, সব ব্যাপারেই আগ্রহ তাঁর। হ্যাঁ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শুধু বিশেষজ্ঞ নন, চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে তিনি বুদ্ধিজীবী। জোর দিয়েই বলা দরকার তাঁর সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে যে পরিচয় স্পষ্ট হয়ে থাকে, তা হচ্ছে বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর পরিচয়। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিজীবী। আর বুদ্ধিজীবী বলেই তিনি দায়বদ্ধ। সেই দায় দেশের ও দুনিয়ার মেহনতি মানুষের প্রতি, যার পক্ষে তিনি তাঁর চিন্তায় ও কাজে, লেখায় ও কথায়, লড়ে গেছেন আজীবন। এভাবেও বলা যায়, তাঁর লেখা ও লড়াইয়ের মাঝখানে কোনো বিভাজন রেখা নেই।

বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে বিশ শতকের বুদ্ধিজীবীরাই লিখেছেন তাঁদের দায় ও দায়িত্ব নিয়ে। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যাবে ইতালীয় মাকর্সবাদী আন্তোনিও গ্রামসির কথা; আরো বলা যাবে পরবর্তী সময়ের নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড সাঈদের কথা। এঁরা সবাই তাঁদের মতো করেই লড়াকু, প্রতিরোধী, দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবীকে আলাদা করে দেখেছেন বিশেষজ্ঞ ও এমনকি সনাতন বুদ্ধিজীবী থেকে। এই ঐতিহ্যেই আমাদের শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও লিখেছেন বুদ্ধিজীবীর দায় ও দায়িত্ব নিয়ে, তাঁর একাধিক রচনায়। তবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর অসাধারণ প্রবন্ধ ‘বুদ্ধিজীবীদের কাজকর্ম ও দায়দায়িত্ব’। এই প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন যে বুদ্ধিজীবী তিনি, যিনি মানুষের মুক্তির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ বলেই বিরাজমান নিপীড়ক ও আধিপত্যবাদী ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেন সেই ব্যবস্থাকে বদলাবেন বলেই; তিনি ক্ষমতাকে দাঁড় করিয়ে দেন সত্যের মুখোমুখি। শুধু তা-ই নয়, তিনি তাঁর লড়াকু চিন্তাকে অন্যের কাছে পৌঁছে দিতেও সচেষ্ট থাকেন নিরন্তর।

বুদ্ধিজীবী নিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এসব চিন্তা তাঁর নিজের কাজের বেলায়ও খাটে বটে। তিনি আজীবন বিরাজমান নিপীড়ক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে গেছেন। আর ওই ব্যবস্থাকে বদলানোর স্বার্থেই, অর্থাৎ মানুষের মুক্তির স্বার্থেই তিনি তাঁর লড়াকু প্রশ্ন ও চিন্তাকে অন্যের কাছে নিয়ে গেছেন ক্লান্তিহীনভাবে। আমি মনে করি, এটাই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর কাজে চিন্তা শুধু চিন্তাই থাকে না, প্রশ্ন শুধু প্রশ্নই থাকে না, সেগুলো হয়ে ওঠে মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের হাতিয়ারও।

কিন্তু কোন ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী? এখানেও তিনি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেন বিরাজমান ব্যবস্থাকে। বলা দরকার, স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতা শুধু তাঁর অনন্ত পাঠযোগ্য গদ্যের শৈলীগত বৈশিষ্ট্যই নয়, তা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রশ্নও। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজ বারবারই প্রমাণ করে যে শৈলীর প্রশ্নও রাজনৈতিক প্রশ্ন। সরাসরি যাঁরা বিরাজমান ব্যবস্থাকে স্পষ্ট করে চিহ্নিত করতে পারেন না, তাঁরা তো কোনো না কোনোভাবে ওই ব্যবস্থার পক্ষেই অবস্থান নেন। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথার চরকিবাজিতেও যাঁরা সত্য বলতে চান এবং ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করতে চান, তাঁরা আসলে সত্যের প্রতি অবিচারই করেন এবং পরোক্ষভাবে হলেও বিরাজমান ব্যবস্থার পক্ষেই থাকেন। এঁদের বিপরীতে দাঁড়িয়েই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিরাজমান ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করে এসেছেন দীর্ঘসময় ধরেই। এসব ব্যবস্থা হচ্ছে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ/উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পিতৃতন্ত্র/পুরুষতন্ত্র।

স্পষ্ট করেই বলা দরকার যে আমাদের সময়ের প্রধান পুঁজিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, উপনিবেশবাদবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও পিতৃতন্ত্রবিরোধী লড়াকু লেখক ও বুদ্ধিজীবীর নাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যিনি মনে করেন যে এসব নিপীড়ন ও শোষণের ব্যবস্থাকে বদলানো ছাড়া এবং সেগুলো থেকে মুক্তি ছাড়া জনগণের মুক্তি সম্ভব নয়। এও স্পষ্ট করে বলা দরকার যে তাঁর প্রায় সব কাজের কেন্দ্রে থাকে জনগণের মুক্তির প্রসঙ্গ, যে কারণে বিপ্লবী রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে অংশগ্রহণ অক্ষুণœ থেকেছে আজীবন। আর এই বিপ্লবী রাজনীতি মানে শুধু বিরাজমান ব্যবস্থাকে বিরোধিতা করা নয়, তার অর্থ পক্ষাবলম্বনও। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্পষ্টত সমাজতন্ত্রের পক্ষে। সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার অটুট থেকেছে আজীবন, যিনি মনে করেন, সত্যিকার গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই। সমাজতন্ত্রী বলে তিনি গণতন্ত্রীও; গণতন্ত্রী বলেই তিনি সমাজতন্ত্রীও।

সমাজতন্ত্র নিয়ে বস্তাপচা ভুল ধারণার আধিপত্যের সময়ে এবং তথাকথিত বামপন্থিদের সুবিধাবাদের এই দুঃসময়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের অনেকের জন্য নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণা। আর যাঁরা সমাজতন্ত্রী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে না চেনে বা সেই পরিচয়কে বাদ দিয়ে তিনি যে কত ভালো শিক্ষক বা কত ভালো লেখক এই প্রশংসায় গদগদ করেন, তাঁরা আসলেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রতি অবিচার করেন বলেই আমি মনে করি। আর গ্রামসির মতোই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর কাজের ভেতর দিয়েই বুঝিয়ে দেন যে আমরা কোন বিষয়ের ওপর জোর দিই আর কোন বিষয়ের ওপর দিই না, কোন বিষয়কে উহ্য রাখি আর কোন বিষয়কে যুক্ত রাখি, তা রাজনৈতিকভাবে বা মতাদর্শিকভাবে মোটেই নিরীহ বা নিরপেক্ষ নয়।


ফিরি জনগণের মুক্তি প্রসঙ্গে, যা আগেই বলা হয়েছে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজের কেন্দ্রীয় বিষয়। শুধু বিষয়ই নয়, নিরিখও বটে। অর্থাৎ জনগণের মুক্তির নিরিখেই তিনি সাহিত্য সমালোচনা করেন, সংস্কৃতিকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেন, সমাজকে বিচার-বিশ্লেষণ করেন, যেমন তা করেন রাজনীতির ও ইতিহাসের পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও। এসব প্রসঙ্গে পরে ফেরা যাবে। তবে ওই প্রশ্নটা এখন তোলা জরুরি : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্য জনগণ কারা? সবাই তো জনগণের নামে কথা বলতে চান। আমাদের শাসক শ্রেণি জনগণের নামে কথা বলে, ব্যবসায়ীরাও জনগণের নামে কথা বলেন, এমনকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও জনগণের নামে কথা বলে থাকে। উদারনৈতিক মানবতাবাদের ঐতিহ্যেও ‘জনগণ’ বা ‘মানুষ’ কথাটা বারবার ফিরে আসে মানবপ্রেমের নামে, যে প্রেম আমরা দেখেছি, বিরাজমান অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক বা অসম শ্রেণি-লিঙ্গ-বর্ণ-জাতি সম্পর্ককে ধোঁয়াশা করে থাকে। বলাই বাহুল্য, এই উদারনৈতিক মানবতাবাদ জনগণের বিপ্লবকে ভয় পায় এবং সে কারণেই তার কোনো সম্ভাবনাকে সে প্রশ্রয় দেয় না।

ঠিক এই ধারার বিপরীতেই ‘জনগণ’কে বা ‘মানুষ’কে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ফাঁকা বুলি হিসেবে না নিয়ে উদারনৈতিকতাকে শুধু তুমুল সমালোচনাই করেন না; তিনি বিভিন্ন রচনায়; বরং জনগণকে বা মানুষকে দেখেন বিরাজমান অসম উৎপাদন-সম্পর্ক ও ক্ষমতা-সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে; তাঁদের দেখেন তিনি শ্রেণি-লিঙ্গ-বর্ণ-জাতির অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের নিরিখে, যাতে সাম্যবাদী বিপ্লবী রাজনীতির স্বার্থেই বিরাজমান অসমতাকে চিহ্নিত করা যায় এবং তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। অন্য কথায়, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্য ‘জনগণ’ বা ‘মানুষ’ তারাই, যারা বাংলাদেশে ও বিশ্বে অধিকাংশ মানুষÑযারা শোষিত ও নিপীড়িত, যারা পুঁজি ও সাম্রাজ্যের সবচেয়ে নির্মম শিকার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই জনগণ হচ্ছে কৃষক, শ্রমিক, নারী, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা। সিরাজুল ইসলাম এঁদের পক্ষেই আজীবন লিখেছেন, বলেছেন, লড়াই করেছেন। কেননা তিনি বুঝে গেছেন এবং বুঝিয়েও দিয়েছেন যে এদের মুক্তি ছাড়া মানবতার সার্বিক মুক্তি সম্ভব নয়।

মুক্তির বিষয়টা কেন্দ্রীয় বলেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য নিয়ে প্রচুর লিখেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমাদের জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের অর্জনগুলোকে চিহ্নিত করেই অনেকের আগেইÑসেই সত্তরের দশক থেকেই বলে এসেছেন যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অসমাপ্ত। এ কারণে ১৯৯৩ সালে জাহানারা ইমাম এক কথোপকথনে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজ আমাদের দিকনির্দেশনা দেয় এবং আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে। আমরা জানি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তিনটি ঘোষিত নীতি ছিল।

সেগুলো হলো সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সেই প্রথম দিককার বই নিরাশ্রয় গৃহী (১৯৭৪) থেকে শুরু করে তাঁর স্বাধীনতা স্পৃহা ও সাম্যের ভয় (১৯৮৮)-এর ভেতর দিয়ে বিচ্ছিন্নতায় অসম্মতি (২০১৪) পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে মুক্তিযুদ্ধের ওই তিনটি ঘোষিত নীতি কখনো হয়ে উঠেছে সরাসরি বিষয়বস্তু এবং প্রায়ই থেকেছে বিচার-বিবেচনার লিপ্ত নিরিখ। এদিক থেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে একজন সার্বক্ষণিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও গণ্য করা চলে।


সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথমত ও প্রধানত বাংলাদেশের লড়াকু বুদ্ধিজীবী বলেই বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের সমস্যা ও সংগ্রাম তাঁর অসংখ্য রচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পিতৃতন্ত্র ছাড়াও তাঁর প্রিয় বিষয় হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। এখানে তাঁর জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত ধ্যানধারণার বিশদ মূল্যায়ন পরিসরের স্বল্পতার কারণে সম্ভব নয়। তবে অবশ্যই বলা যাবে যে তিনি আমাদের সময়ে জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক। তিনি যেমন ঐতিহাসিক কারণে জাতীয়তাবাদের ভেতরে ক্ষেত্রবিশেষে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও উপনিবেশবাদবিরোধী উপাদান শনাক্ত করেছেন, তেমনি তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদের সমালোচনাও করেছেন, এটা বুঝিয়ে যে সব জাতীয়তাবাদ এক ধরনের নয়।

কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আন্তর্জাতিকতাবাদীও। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীনা বিপ্লব, কিউবার বিপ্লব, ভিয়েতনামের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মুক্তির লড়াইসহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াই নিয়েও লিখেছেন তিনি। প্রমাণ করেছেন যে বিপ্লব ও সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা ব্যতিরেকে বিপ্লবী রাজনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পথ শনাক্ত ও প্রশস্ত করা সম্ভব নয়। তবে শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদ স্পষ্ট হয়ে থাকে, যেমন তা থাকে ইংরেজি সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তাঁর বিস্তর আলোচনায়। এ ক্ষেত্রে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেছেন বটে।

এবার তাঁর কাজের বিষয় নিয়ে আরো কয়েকটা কথা বলে নেওয়া যাক। আগেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে অসংখ্য বিষয় নিয়ে লিখেছেন তিনি। এখানে তাঁর কিছু প্রিয় বিষয়বস্তুর একটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া যেতে পারে এভাবেÑবাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি, সাম্য ও স্বাধীনতা, বামপন্থী রাজনীতি, বিপ্লবী রাজনীতি, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পিতৃতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন, সমাজ ও সংস্কৃতি, শ্রেণি ও সাহিত্য ইত্যাদি।

যদিও বর্তমান রচনার প্রধান বিষয়বস্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাহিত্য সমালোচনা ও সংস্কৃতি সমালোচনা নয়, তবু এ বিষয় নিয়ে দু-একটা কথা না বললেই নয়। তিনি সমান দক্ষতায় বিচরণ করেছেন বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের সমালোচনার এলাকায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি বিশিষ্ট প্রশ্ন তোলার জন্য। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি প্রধান সাহিত্যিকদের নিয়ে তিনি লিখেছেন প্রচুর। লিখেছেন তিনি বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দসহ অসংখ্য লেখককে নিয়ে। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রায় সমান্তরালবিহীন। কিন্তু তিনি আরো বিশিষ্ট এই কারণে যে সাহিত্যিক মহারথীদের বন্দনা করা বা আনুগত্যের সংস্কৃতিতে তিনি সাহিত্যিক এস্টাব্লিশমেন্টকে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন করেছেন সাহস নিয়ে।

কিন্তু তিনি প্রশ্ন করার জন্যই শুধু প্রশ্ন করেননি। প্রশ্ন করেছেন বঙ্কিমকে, শরৎচন্দ্রকে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে রবীন্দ্রনাথকেও, জনগণের সমষ্টিগত মুক্তির আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের পরিপ্রেক্ষিতেই। ইংরেজি সাহিত্যের সমালোচনার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। যখন ইংরেজির ডাকসাইটে অধ্যাপকরা আইরিশ-ইঙ্গ-মার্কিন আধুনিকতাবাদীদের, অর্থাৎ ইয়েটস, পাউন্ড, এলিয়ট, লরেন্স, জয়েস্ প্রমুখকে বন্দনা করতে ব্যস্ত, ঠিক তখন বিস্ফোরণের আকারে প্রকাশিত হয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বই ‘প্রতিক্রিয়াশীলতা আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে’, যেখানে তিনি অসাধারণ দক্ষতাসহকারে ওই সব সাহিত্যিক মহারথীর ফাঁক ও ফাঁকি চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাঁদের রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক অবস্থানের সমস্যাগুলো চিনিয়ে দেন। হ্যাঁ, তিনি ‘ক্রিটিক’-এর পর ‘ক্রিটিক’ হাজির করেছেন, সেগুলো বাংলাদেশে সাহিত্য সমালোচনার শুধু ‘নতুন দিগন্ত’ই উন্মোচন করেনি, সেগুলো জনগণের মুক্তির সংগ্রামে হাতিয়ার হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।

জনগণের মুক্তির সংগ্রামের স্বার্থেই আমাদের সময়ের অন্যতম প্রধান লড়াকু বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আরো দীর্ঘ জীবন কামনা করি। তাঁকে জানাই লড়াকু অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা তাঁর ৮৯তম জন্মদিনে।

আজফার হোসেন: কবি, লেখক-গবেষক, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক 

;

কোরবানি



শাহেদ শফিক
কোরবানি

কোরবানি

  • Font increase
  • Font Decrease

আমি তো হাজির হে আমার রব
তোমার প্রিয় ঘরে
উজাড় করে দিতে পারি সব
প্রভু তোমার তরে।

নত মনে আজ তোমার চরণে
সঁপেছি এই শীর
তুমি তো মহান, চির অম্লান,
মালিক ধরিত্রীর।

আজ দূর হয়ে যাক মনের পশু
ধুয়ে যাক সব জিদ
জাগ্রত হোক কণ্ঠে সবার
বাজুক তোমার গিদ।

তুমি তো আমায় দিয়েছিলে রব
জগতের সব কিছু।
আমি তো ছুটেছি জীবন জুড়ে
পাপের পিছু পিছু।

কী দিয়ে তোমার, সুধিবো ঋণ
নেই যে কিছু আর
তাই তো প্রভু তোমার সকাসে
ছুটি বারং বার।

আজ দূর হয়ে যাক সব বেধাবেধ
পড়রে কালিমা
হিংসা বিভেদ, ফাসাদ ভুলিয়া
ছড়াক মহিমা।

১৭ জুন ২০২৪।
লন্ডন, যুক্তরাজ্য।

;

কদম



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঋতুটি শরৎ এখন পঞ্জিকার পাতায়।
বর্ষার আমেজ কাটেনি বুঝি, সারাটি আকাশ
কালো করে নামে বৃষ্টি।
একটানা ভিজে শালবন, মহুয়ার কিশলয়। সতেজ হয়-
লতানো পুঁইয়ের ডগা।

এ বর্ষণ দেখার সৌভাগ্য আমার নেই। দূর পরবাসে
বসে আমি ভাবি- আহ, কি সহজেই ভুলে গেলাম, ভুলে গেলাম
প্রিয় ফুল কদমের কথা...!
পড়ার টেবিলে দুটো কদম, আষাঢ় শ্রাবণে তরতাজা দুটো কদম
জিইয়ে রেখেছি কতো-
কাচের বোতলে। ভেজা বাতাসে কদমের হালকা সুবাস।
তিনটে বছর, মাত্র তিনটে বছর
ভুলিয়ে দিলো চব্বিশ বছরের বর্ষার স্মৃতি, যেন চব্বিশ বছর
পরাজিত তিন বছরের পাল্লায়।

পরিজন ফোন করে খবর নিতে- ‘কি পাঠাবো বল...?
কাঠালের বিচি ভাজা, চিনে বাদাম, ঝুনা নারকেল
নাকি আমের আচার...?’-ওদের তালিকায়
আমার পছন্দ অনুপস্থিত।

সাহেবদের বিলেতী ফুলের ভীড়ে
ঠাঁই নেই কদমের-
যেমন আছে কাঁদা মাটির সুঁদাগন্ধ ভরা বাংলায়।
ক্যালেণ্ডারের পাতায় দেখি
ফুটফুটে কদমের শ্বেত রেণু বিনিময়, আর অন্তরে অনুভবে
রূপ-রস-গন্ধ।

;

একগুচ্ছ কবিতা



মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

পরাবাস্তবতা-জাদুবাস্তবতা
আপাতদৃষ্টিতে অবাস্তব অথচ বাস্তবের অধিক
অসম্ভব তবু প্রতিনিয়ত সম্ভাবনার শঙ্কা জাগায়
তারই নাম পরাবাস্তবতা
অন্যভাবে বলতে জাদুবাস্তবতা:
যেমন, এই যে আশ্চর্য সকাল
এর কতtটুকু তুমি দেখো
কতটুকু আমি
আর কতটুকু দিগন্তের ওপাশে অদেখার!
জলের উপর একলা মুখ ঝুঁকিয়ে থাকা
শেষবিকেলের মর্মবেদনা জানে
শিরীষ কিংবা কৃষ্ণচূড়ার ভাসমান পাতা
তুমি আর আমি কতটুকু জানি!
অর্থবোধ্য সীমানা পেরিয়ে
আমাদের যাতায়াত নেই
এমন কোনো ঠিকানায়
যার দিক নেই, চিহ্ন নেই, প্রতীক নেই!

সম্পর্ক

প্রিজমের টুকরোয় ছিটকে পড়া আলোয়
অধ্যয়ন করছি সম্পর্ক
সম্পর্কের উত্থান-পতন
বাঁক ও শিহরণ
লগ-ইন বা লগ-আউটে
নিত্য জন্মাচ্ছে নতুন সম্পর্ক
সম্পর্কের বিভিন্ন রং
লিখে লিখে মুছে দিচ্ছে ফেসবুক
সন্তরণশীল সম্পর্ক খেলা করছে
মানুষের জীবনের বহুদূরের ভার্চুয়ালে
সম্পর্ক হয়ে গেছে স্বপ্নময় জগতে
মনকে জাগ্রত রাখার কৌশল

জোনাকি

দূরমনস্ক দার্শনিকতায়
রাতের পথে যারা আসে
তারা যাবে দিগন্তের দিকে
আত্মমগ্ন পথিক-পায়ে।
এইসব পদাতিকের অনেকেই আর ফিরবে না
ফিরে আসবে অন্য কেউ
তার চিন্তা ও গমনের ট্র্যাপিজ ছুঁয়ে
অন্য চেহারায়, অন্য নামে ও অবয়বে।
তারপর
গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে সরল রেখায়
আলোর মশালে জ্বলে উঠবে
অনুভবের অসংখ্য জোনাকি।

নিঃসঙ্গতা

নিঃসঙ্গতা শীতের কুয়াশার মতো প্রগাঢ়
তমসাচারী মৃত পাখির নিঃশব্দ কুহুতান-স্মৃতি
নিহত নদীর শ্যাওলাজড়ানো জলকণা
দাবানল-দগ্ধ বনমর্মর:
মায়ায় মুখ আড়াল করে অনন্য বিমূর্ত বিবরে
নিঃসঙ্গতা কল্পলোকে রঙ মাখে
নীলাভ স্বপ্নের দ্যুতিতে
অস্তিত্বে, অনুভবে, মগ্নচৈতন্যে:
জীবনের স্টেজ অ্যান্ড স্ক্রিনে!

আর্কিওপটেরিক্স

পনেরো কোটি বছরের পাথরশয্যা ছেড়ে তিনি
প্রত্নজীববিদের টেবিলে চলে এলেন:
পক্ষী জীবাশ্ম দেখে প্রশ্ন শুরু হলো পৃথিবীময়
‘ডানার হলেই তাকে পাখি বলতে হবে?‘
তাহলে ‘ফ্লাইং ডাইনোসরস‘ কি?
তাদের শরীরে রয়েছে ডানা, কারো কারো দুই জোড়া!
পাখি, একলা পাখি, ভাবের পাখি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান
বিজ্ঞানী থেকে বিপ্লবী কবিগণ
আর্কিওপটেরিক্স কি পাখির আদি-জননী?

;