দ্বিশত জন্মবর্ষের শ্রদ্ধা মধুকবি



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
দ্বিশত জন্মবর্ষের শ্রদ্ধা মধুকবি

দ্বিশত জন্মবর্ষের শ্রদ্ধা মধুকবি

  • Font increase
  • Font Decrease

জন্মের (২৫ জানুয়ারি ১৮২৪) দ্বিশতবর্ষে এবং মৃত্যুর (২৯ জুন ১৮৭৩)  ১৫১ বছর পরেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত কবি ও ব্যক্তি হিসেবে বাংলা সাহিত্যের এক ধ্রুপদী চরিত্র এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনের নানা উত্থান-পতনের মতোই তার মৃত্যুও ছিলো গভীর বেদনার। জীবন সায়াহ্নে মধুকবির ব্যথিত দিনলিপি ট্র্যাজিডির নামান্তর। আধুনিকতার উন্মেষের যুগে কবিতা তাকে যশ দিয়েছিল। অন্ন ও প্রতিষ্ঠা দেয়নি। কবির জীবন সায়াহ্নের ব্যথিত দিনলিপি আর জীবন সংগ্রামের পরিণতি ছিল সকরুণ।

১৮৭৩ সালের মার্চ মাস নাগাদ মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। তখন তার অবস্থা বয়সের বেশি বার্ধক্য-কবলিত। জীবন ও মৃত্যুর মাঝখান দিয়ে চলছিলেন তিনি। অভাব-অনটনে স্ত্রী হেনরিয়েটার স্বাস্থ্যও নাজুক অবস্থার সম্মুখীন ও ভঙ্গুর। মাইকেলের অপরিমিত মদ্যপান, চিকিৎসার ধারাবাহিকতায় ছেদ, অমিতচারীতার ফল শরীর সইতে পারেনি। কলকাতার উপান্তে উত্তরপাড়া লাইব্রেরির ওপর তলায় আশ্রয় পেলেন কবি। রইলেন ছয় সপ্তাহ। উত্তরপাড়ায় কবির শরীর-স্বাস্থ্য ও কার্যকলাপের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে তার উচিত ছিলো, পাঠগৃহে নয়, চিকিৎসাস্থল আলিপুরের জেনারেল হাসপাতালে যাওয়া। কারণ, এ সময়ে তিনি এবং হেনরিয়েটা, উভয়েই খুব অসুস্থ ছিলেন।

মাইকেল যখন নিদারুণ অসহায় অবস্থায় উত্তরপাড়ায় বসবাস করছেন, তখন হাওড়ায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বদলি হয়ে আসেন মাইকেল-বন্ধু গৌরদাস বসাক। তিনি এ সময়ে একাধিকবার উত্তরপাড়ায় গিয়ে মাইকেলকে দেখে আসেন। শেষ বার সেখানে তিনি যে দৃশ্য দেখতে পান, স্মৃতিচারণে বলেন:

“মধুকে দেখতে যখন শেষ বার উত্তরপাড়া সাধারণ পাঠাগারের কক্ষে যাই, তখন আমি যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখতে পাই, তা কখনো ভুলতে পারবো না। সে সেখানে গিয়েছিলো হাওয়া বদল করতে। সে তখন বিছানায় তার রোগযন্ত্রণায় হাঁপাচ্ছিলো। মুখ দিয়ে রক্ত চুইয়ে পড়ছিলো। আর তার স্ত্রী তখন দারুণ জ্বরে মেঝেতে পড়েছিলো। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে মধু একটুখানি উঠে বসলো। কেঁদে ফেললো তারপর। তার স্ত্রীর করুণ অবস্থা তার পৌরুষকে আহত করেছিলো। তার নিজের কষ্ট এবং বেদনা সে তোয়াক্কা করেনি। সে যা বললো, তা হলো: ‘afflictions in battalions.’ আমি নুয়ে তার স্ত্রীর নাড়ী এবং কপালে হাত দিয়ে তাঁর উত্তাপ দেখলাম। তিনি তাঁর আঙুল দিয়ে তাঁর স্বামীকে দেখিয়ে দিলেন। তারপর গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নিম্নকণ্ঠে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বললেন: ‘আমাকে দেখতে হবে না, ওঁকে দেখুন, ওঁর পরিচর্যা করুন। মৃত্যুকে আমি পরোয়া করিনে’। ”

বাল্যবন্ধুর অন্তিম দশা দেখে গৌরদাস স্বভাবতই বিচলিত বোধ করেন। তিনি তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অবিলম্বে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইলেন। জানা গেলো, পরের দিন, ২০ কিংবা ২১ জুন (১৮৭৩), মধু নিজেই কলকাতা ফেরার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সপরিবারে কবি বজরায় করে নৌপথে নির্ধারিত দিনে অসুস্থ শরীরে নিজ উদ্যোগেই কলকাতা যাত্রা করলেন।

কলকাতায় হেনরিয়েটাকে ওঠানো হলো তার জামাতা উইলিয়াম ওয়াল্টার এভান্স ফ্লয়েডের বাড়িতে, ১১ নম্বর লিন্ডসে স্ট্রিটে; ইংরেজ এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়া লিন্ডসে স্ট্রিট চৌরঙ্গি রোডের সঙ্গে সংযুক্ত। স্ত্রীর সংস্থান হলেও মাইকেলের নিজের ওঠার মতো কোনও জায়গা ছিলো না। উত্তরপাড়ায় যাওয়ার আগেই তিনি তার এন্টালির বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলেন। অগত্যা মাইকেল ঠাঁই নিলেন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে। হাসপাতালটি ছিলো মূলত বিদেশী এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের জন্য সংরক্ষিত। কিছু বিশিষ্টজনের তদবিরে এবং মাইকেলের নিজের সাহেবী পরিচয়ের জন্য তিনি অবশেষে এ হাসপাতালে ভর্তির অনুমতি পেলেন। হাসপাতালে আসার পর প্রথম দিকে শুশ্রুষা এবং ওষুধপত্রের দরুণ তার রোগ লক্ষণের খানিকটা উপশম হয়েছিল। কিন্তু অচিরেই তার স্বাস্থ্য দ্রুত অবনতির দিকে এগিয়ে যায়। যকৃৎ, প্লীহা এবং গলার অসুখে তার দেহ অনেক দিন থেকেই জীর্ণ হয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময় তার যকৃতের সিরোসিস থেকে দেখা দিয়েছিল উদরী রোগ। সেই সঙ্গে হৃদরোগের লক্ষণও স্পষ্ট দেখা দেয়।

বাংলা সাহিত্যের আদিপর্বে একজন ‘সাহেব-কবি’ অকৃপণভাবে মধুভাণ্ডার তৈরি করেছিলেন, যার স্বাদ পুরোপুরিভাবে তার স্বজাতি গ্রহণ করতে অক্ষম হয়েছিল। বরং অবজ্ঞা ও সমালোচনায় ‘জাত-ত্যাগী’ কবিকে ভর্ৎসনা করেছিল। সেই মধুনির্মাতা মধুকবি মারা যাচ্ছেন শুনে আলিপুর হাসপাতালে অনেকের ভিড় দেখা যায়। তার চরম দুরবস্থার খবর শুনেও এতোদিন যারা মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল, তারাও এসে হাজির। রক্তের আত্মীয়তা সত্ত্বেও যারা একদা তাকে ত্যাগ করেছিল, তাদের মনেও হয়তো করুণা বা লোকলজ্জা বা আত্মগ্লানি হানা দিয়েছিল; তারাও এলেন। 

বিপন্ন অবস্থাতেও কবি বেহিসাবী স্বভাবের প্রভাবমুক্ত হতে পারেননি। ধার করে হলেও ব্যয় করার এবং বদান্যতা দেখানোর প্রবণতা তিনি মৃত্যুকালেও ত্যাগ করতে পারেননি। হাসপাতালে তার সঙ্গে একদিন দেখা করতে এসেছিলেন তার এক সময়ের মুন্সি মনিরউদ্দিন। কবির কাছে তার চারশো টাকা পাওনা ছিলো। তারপরেও উল্টো কবি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো টাকা পয়সা আছে কি-না? মনিরউদ্দিন তার কাছে মাত্র দেড় টাকা আছে বলে জানালেন। সেই পয়সাই তিনি চাইলেন। তারপর তা বকশিস হিসাবে দান করলেন তার শুশ্রুষাকারিণী নার্সকে। মৃত্যুকালেও ধার করে বকশিশ দেওয়ার এই আচরণ সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ তার সারা জীবনের অভ্যাসের সঙ্গে।

কবি হাসপাতালে ছিলেন সাত অথবা আট দিন। এ সময়ে কিছু চিকিৎসা ও সেবা-যত্ন পেলেও কবি খুব একটা মানসিক শান্তিতে ছিলেন না। পরিবার সম্পর্কে তার দুশ্চিন্তা এবং হেনরিয়েটার স্বাস্থ্য সম্পর্কে তার উদ্বেগ তাকে বিচলিত করে। এরই মাঝে হাসপাতালের শয্যায় শায়িত চরম অসুস্থ কবি এক পুরনো কর্মচারীর মাধ্যমে ২৬ জুন (১৮৭৩) একটি মর্মান্তিক বেদনার খবর পেলেন, স্ত্রী হেনরিয়াটার মৃত্যুর সংবাদ। মাত্র ৩৭ বছর তিন মাস ১৭ দিন বয়সে হেনরিয়েটা মারা গেলেন। হেনরিয়েটা বয়ঃসন্ধিকালে মা মারা যাওয়ার পর থেকে সুখের মুখ কমই দেখেছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিত পরিবেশ ত্যাগ করে তিনি মাদ্রাজ থেকে কলকাতা এসেছিলেন মাইকেলের ভালোবাসার টানে। চার্চে গিয়ে সেই ভালোবাসার কোনো স্বীকৃতি পর্যন্ত তিনি আদায় করেননি।

হেনরিয়েটার প্রয়াণে মৃত্যুপথযাত্রী কবি খুবই মর্মাহত ও বিষণ্ণ হয়েছিলেন। এর ফলে তার অসহায়ত্ব ও যন্ত্রণা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। তিনি খুবই ব্যাকুল হয়ে ওঠেন হেনরিয়েটার শেষকৃত্যের ব্যাপারে। এর জন্যে যে অর্থ, যোগাড়-যন্ত্র লাগবে, তা কোথা থেকে আসবে? তিনি সঞ্চয়ী লোক ছিলেন না। কপর্দকশূন্য অবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যুতে মাইকেল তখন নিজেও মৃত্যু পথযাত্রী। 

এই দিনই অথবা পরের দিন হাসপাতালে শয্যাগত মাইকেলের কাছে স্বজন মনোমোহন ঘোষ আসেন তার সঙ্গে দেখা করতে ও সান্তনা দিতে। কবি তাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন, ঠিকমতো হেনরিয়েটার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়েছে কিনা। মনোমোহন জানালেন, সবই যথারীতি হয়েছে। মাইকেল জানতে চান, বিদ্যাসাগর ও যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এসেছিলেন কিনা। মনোমোহন জানালেন, তাদের খবর দেওয়া সম্ভব হয়নি।  স্ত্রী বিয়োগের ফলে অসহায় কবির সামনে আরেকটি মারাত্মক উদ্বেগের কারণ এসে উপস্থিত হয়: দুই পুত্রের ভবিষ্যৎ চিন্তা। তার পুত্রদের একটির বয়স তখন মাত্র বারো এবং অন্যটির মোটে ছয়।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ধর্ম, বিধি, শাস্ত্র, প্রথা-এর কোনোটিই মান্য করেননি। ধর্মান্তরিত হলেও ধর্মনিষ্ঠ হননি কখনই। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলো না। এমনকি, অসহায় অবস্থায় নিজের মৃত্যুশয্যায় শুয়ে মৃত-স্ত্রীর করুণ-স্মৃতি আর নাবালক সন্তানদের অন্ধকার-ভবিষ্যতকে সামনে নিয়েও মাইকেল ধর্মের প্রতি আস্থাহীনতা প্রদর্শন করলেন। অবস্থা এমন ছিলো যে, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় এবং রেভারেন্ড চন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বরং কবির পারলৌকিক মঙ্গল নিয়ে কবির চেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন। বিশেষত চন্দ্রনাথ কবিকে এ সময়ে বার বার নাকি পরম ত্রাতা যীশু খ্রিস্টের কথা মনে করিয়ে দেন। মাইকেল জীবনীকার গোলাম মুরশিদি মন্তব্য করেন, “পারলৌকিক মঙ্গলের ব্যাপারে তাদের এই উৎকণ্ঠা দিয়ে নিজেদের অজ্ঞাতে তারা কবির প্রতি যথেষ্ট নিষ্ঠুরতা করেন বলেই মনে হয়। ”

২৮ জুন তারিখে সমস্ত আশা-ভরসাহীন, রোগকাতর, বিষণ্ণ কবি যখন কেবলমাত্র মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে আছেন, তেমন সময়ে চন্দ্রনাথের সঙ্গে এসে যুক্ত হন কৃষ্ণমোহন। উদ্দেশ্য: খ্রিস্ট ধর্ম অনুযায়ী কবির শেষ স্বীকারোক্তি আদায় করা। কবি কোনো পাপের কথা স্বীকার করে বিধাতার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, এমন তথ্য কেউ জানেন না। জীবনকে যিনি নিজের ইচ্ছায় যদ্দুর সম্ভব উপভোগ ও অপচয় করেছিলেন, আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে তিনি আকুল হননি। প্রথাগত চিন্তায় এর চেয়ে অধার্মিকতা আর কিছুই হতে পারে না। প্রাচ্যদেশের ধর্মে জীবনভর পাপ করে শেষজীবনে অনুতাপের যে ধারা প্রচলিত রয়েছে, মাইকেল সেটাকেও অস্বীকার করলেন। ধর্মগত বিশ্বাস ও আচরণের এহেন পরিস্থিতিতে কৃষ্ণমোহন এবং চন্দ্রনাথ আশঙ্কা প্রকাশ করে কবিকে জানান যে, তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং তাকে কোথায় সমাধিস্থ করা হবে, তা নিয়ে গোলযোগ দেখা দিতে পারে। এমন আস্থাহীন অবস্থায় মাইকেলের নির্ভীক উত্তর ছিলো:

“মানুষের তৈরি চার্চের আমি ধার ধারিনে। আমি আমার স্রষ্টার কাছে ফিরে যাচ্ছি। তিনিই আমাকে তাঁর সর্বোত্তম বিশ্রামস্থলে লুকিয়ে রাখবেন। আপনারা যেখানে খুশি আমাকে সমাধিস্থ করতে পারেন; আপনাদের দরজার সামনে অথবা গাছ তলায়। আমার কঙ্কালগুলোর শান্তি কেউ যেন ভঙ্গ না করে। আমার কবরের ওপর যেন গজিয়ে ওঠে সবুজ ঘাস। ”

২৯ জুন ১৮৭৩, রোববার, মাইকেলের অন্তিম অবস্থা ঘনিয়ে এলো। তার হিতাকাঙ্ক্ষী এবং সন্তানারা এলেন তাকে শেষ বারের মতো দেখতে। এমন কি, তার যে জ্ঞাতিরা হিন্দু ধর্ম ত্যাগের কারণে তার সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন, তাদের মধ্য থেকে মাত্র একজন এসেছিলেন তাকে দেখতে।

মাইকেলের ক্ষেত্রে মৃত্যুপরবর্তী ধর্মীয় কাজের সমস্যাজনিত আশঙ্কা প্রবলভাবে সত্যে পরিণত হলো। তার মৃত্যুর পর সত্যি সত্যিই তার শেষকৃত্য নিয়ে প্রচণ্ড সমস্যা দেখা দিলো। যদিও মৃত্যুর পর কবি শেষ বিদায়ে লগ্নে সবার মধ্যেই থাকার কথা ক্ষমা ও প্রার্থনা, মাইকেলকে সেটা থেকেও বঞ্চিত করা হলো। কলকাতার তৎকালীন খ্রিস্টান সমাজ তার দীক্ষার ঘটনা নিয়ে ঠিক তিরিশ বছর আগে একদিন মহা হৈচৈ করলেও, মৃত্যুর পর তাকে মাত্র ছয় ফুট জায়গা ছেড়ে দিতেও রাজি হলো না। ইংলিশম্যানের মতো পত্রিকাগুলো তার মৃত্যুর খবর পর্যন্ত ছাপলো না। যদিও সে সপ্তাহে কলকাতায় মোট কয়জন দেশীয় ও খ্রিস্টান মারা যান এবং আগের সপ্তাহের তুলনায় তা বেশি, না কম, সে পরিসংখ্যান নিয়েও পত্রিকাটি আলোচনা করে। মিশনারিদের কাগজ ফেন্ড অব ইন্ডিয়া খুবই সংক্ষেপে তার মৃত্যু সংবাদ ছাপালো। সংবাদটি তার কবি-কৃতীর ধারে-কাছে দিয়েও গেলো না।

নবদীক্ষিত খ্রিস্টান মাইকেলের প্রতি খ্রিস্টান সমাজ যে মনোভাব দেখায়, তা দুঃখজনক এবং তার পূর্বতন স্বজাতি হিন্দু সমাজের কাছ থেকে পাওয়া আঘাতের সঙ্গে তুলনীয়। কবির মৃত্যুতে যে আচরণ করা হয়, তা অভাবনীয় কঠোরতা আর ক্ষুদ্রতার পরিচয় বহন করে। কেননা, মৃত্যুর পরে মৃতের প্রতি এ রকমের রোষের ঘটনা ক্বচিৎ দেখা যায়। যার সঙ্গে মাইকেলের কবিতার মিল না থাকলেও, ব্যক্তিগত জীবনে অনেক মিল লক্ষ্য করা যায়, সেই শার্ল বোদলেয়ারের মৃত্যুর পরেও তার প্রতি অনেকের আক্রোশ প্রকাশ পেয়েছিল।

জুনের শেষ পাদে দারুণ গ্রীষ্মের সময়ে মাইকেলের মৃত্যু হলেও, খ্রিস্টান সমাজের সৃষ্টি-ছাড়া রোষের দরুণ সেদিন এবং সেদিন রাতে তার মরদেহ পড়ে থাকলো দুর্গন্ধ-ভরা নোংরা মর্গে। কৃষ্ণমোহন ছিলেন কলকাতার খ্রিস্ট ধর্মযাজকদের মধ্যে একজন প্রবীণ সদস্য, যদিও তিনি এ সময়ের অনেক আগে থেকেই সরাসরি ধর্মযাজকের কাজ ছেড়ে দিয়ে বিশপস কলেজে অধ্যাপনা করছিলেন এবং মাইকেল মারা যাওয়ার আগের সময়কালে অধ্যাপনা থেকেও অবসর নিয়েছিলেন, তিনি উদ্বিগ্ন চিত্তে নিজে ছুটে গিয়ে তদবির করলেন লর্ড বিশপ রবার্ট মিলম্যানের কাছে। মিলম্যান এর ছয় বছর আগে বিশপ হয়ে কলকাতায় আসেন। দেশীয়দের এবং স্থানীয় ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের সঙ্গে তার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। তিনি বাংলাসহ বেশ কয়েকটি দেশীয় ভাষাও শিখে নিয়েছিলেন। এমনকি, তিনি নিজে দুই খণ্ডে মাইকেলের প্রিয় কবি ত্যাসোর জীবনীও লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি তার ধর্মযাজকদের মাইকেলের শেষকৃত্যের মতো তাদের ভাষায় ‘বিতর্কিত’ বিষয়ে যোগদানে বাধা দিলেন। এহেন লর্ড বিশপ রবার্ট মিলম্যান মাইকেলের মৃত্যুর পরের দিন সকালেও কবির মৃতদেহ খ্রিস্টানদের গোরস্থানে সমাহিত করার অনুমতি দিলেন না!

অন্যদিকে, মাইকেলের স্বদেশবাসী ও ধর্মগোষ্ঠীর হিন্দু সমাজও তাকে গঙ্গার ঘাটে পোড়াতে আগ্রহী হলো না। সুতরাং আষাঢ় মাসের ভেপসা গরমের মধ্যে মাইকেলের অসহায় মরদেহ মর্গেই পচতে থাকে। স্বধর্ম ও স্বজাতির কাছে ‘সিদ্ধান্তহীন ও আগ্রহরহিত’ মাইকেলের নিঃসঙ্গ ও অভিভাবকহীন মরদেহ তৎকালীন কলিকাতার বাঙালি হিন্দু ও খ্রিস্ট সমাজের কাছে বিতর্কিত ও  কলঙ্কচি‎হ্নস্বরূপ অপাঙতেয় ছিলো, যদিও সেই ঐতিহাসিক মৃতদেহটি বস্তুতপক্ষে বাঙালি হিন্দু ও খ্রিস্ট সমাজের তৎকালীন নানা পশ্চাৎপদতা ও কুসংস্কারের প্রতি তীব্র কটাক্ষই করছিল।

৩০ জুন বিকেলে, মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টারও পরে, কবির মৃতদেহ নিয়ে তার ভক্ত এবং বন্ধু-বান্ধবসহ প্রায় হাজার খানেক মানুষ এগিয়ে যান পার্ক সার্কাসের কাছে লোয়ার সার্কুলার রোডের খ্রিস্টান গোরস্থানের দিকে। সেকালের বিবেচনায় এই লোক সংখ্যা খুব কম নয়। শবানুগমনে কলকাতার বাইরের বহু লোক অংশ নেন; অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিল নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষ। তবে একদা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ নিজের গ্রন্থ উৎসর্গ করে কবি যাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত করেছিলেন, তাদের কেউ এই ভিড়ের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন না। মাইকেল যেখানে চলেছেন, সেই লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থানে মাত্র চার দিন আগে কবিপত্নী হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কবির জন্যে কবর খোঁড়া হয় স্ত্রীর কবরের পাশে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যখন নিশ্চিতভাবে হতে চলেছে, তেমন সময়ে লর্ড বিশপের অনুমতি এসে পেছন-পেছন হাজির হলো। তবে ব্যক্তিগতভাবে কোনো নামকরা পাদ্রী বা ধর্মীয় নেতা তার শেষকৃত্যে এসেছিলেন বলে জানা যায় নি। এমন কি, কৃষ্ণমোহনও নন। অনেক পাদ্রী বরং তাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকেন। চার্চের ব্যুরিয়াল রেজিস্টারে তার নাম পর্যন্ত ওঠানো হলো না। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত চার্চের রেজিস্টারে কবিকে এবং তার স্ত্রী হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করার কোনো তথ্য নেই।

কলকাতার যে ইংরেজ এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজ বাস করতো, তাদের মধ্যে নীতি, নৈতিকতা ও বিবেক বিসর্জন দিয়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার দৃষ্টান্ত থেকে আরম্ভ করে পরপীড়ন, ব্যভিচার, ধর্মহীনতার দৃষ্টান্ত কিছু কম ছিলো না। তাদের কাউকে সমাধিস্থ করার জন্য কখনই লর্ড বিশপের কাছে ধরনা দিতে হয়নি। মৃত্যুর মতোই পেশাজীবনেও মাইকেল বার বার আক্রান্ত হয়েছিলেন। ব্যারিস্টারি পাশ করার পর, তিনি যখন আইন-ব্যবসা শুরু করার জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন, তখন তাকে গ্রহণ না করার জন্য বিচারকদের মধ্যে প্রবল মনোভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। মাইকেল সম্পর্কে শ্বেতাঙ্গদের এ রকমের বিরূপতার মূল কারণটা কী? বর্ণবাদ? বিদ্বেষ? হিংসা? পরশ্রীকাতরতা?

মাইকেল-জীবনীকার ও বিশেষজ্ঞ গোলাম মুরশিদের গবেষণায় শ্বেতাঙ্গদের মাইকেল-বিদ্বেষের কিছু কারণ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। গোলাম মুরশিদের ধারণা, মাইকেলের বিরুদ্ধে অন্য যেসব অভিযোগই থাক না কেন, তিনি যে শ্বেতাঙ্গিনী বিয়ে করেছিলেন অথবা শ্বেতাঙ্গিনীকে নিয়ে ঘর করেছিলেন, এটাকে শ্বেতাঙ্গরা বিবেচনা করতেন তার অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে। তৎকালে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে কেউ কেউ দেশীয় মহিলাদের বিয়ে করেছিলেন অথবা উপপত্নী রেখেছিলেন। এটা সহ্য করা হলেও, একজন শ্বেতাঙ্গিনীর পাণিপীড়ন করবে এক কালো আদমী, এটা তারা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। ফলে বিশপস কলেজের কাগজপত্রে তার নাম একটি বারও মাইকেল বলে লিখিত হয়নি। সর্বত্র তিনি শুধু মধুসূদন ডাট। একজন কৃষ্ণাঙ্গের একটি ইউরোপীয় বা শ্বেতাঙ্গ নাম তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। লন্ডনে থাকার সময়ে মাইকেল সেখানে যে তীব্র বর্ণবিদ্বেষ লক্ষ্য করেছিলেন, তার অন্যতম কারণ ছিল হেনরিয়েটা। তিনি একজন শ্বেতাঙ্গকে বিবাহ করে, তারপর তাকে পরিত্যাগ করে অন্য একজন শ্বেতাঙ্গিনীকে নিয়ে ঘর করছিলেন, এটাকে লন্ডন বা কলকাতার শ্বেতাঙ্গ বা আধা-শ্বেতাঙ্গ সমাজ আদৌ মেনে নিতে পারেনি; অনুমোদনের তো প্রশ্নই ওঠে না। তাই কবির মরদেহের প্রতিও ছিল তীব্র বিদ্বেষ।

মাইকেলের আমলের সমাজ চরিত্র এবং তার মৃত্যুকালীন দুর্বিনীত চিত্র দ্বিশতবর্ষ পরেও আমাদের পীড়িত ও তাপিত করে মধুকবির জন্য পুঞ্জিভূত বেদনায় এবং ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতার হিংস্রতায়, যা কবির দ্বিশত জন্মবর্ষে প্রতিধ্বনিত্ব করে বিষাদের ইতিবৃত্তে।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;