‘বইয়ের ওপর ট্যাক্স দুই দেশেরই প্রত্যাহার করা উচিত’
বাংলাদেশ ও ভারতের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনকে আরও নিবিড় করতে বই আদান-প্রদানের ওপর বসানো ট্যাক্স দুই দেশেরই প্রত্যাহার করা উচিত বলে মনে করেন বর্ষিয়ান খ্যাতিমান সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে অখণ্ড বাংলা সাহিত্যের বিকাশে পাইরেসি বন্ধ করারও জোর দাবি জানান তিনি।
সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ব্রিটিশ ভারতের অধুনা পূর্ববঙ্গে (বর্তমানে বাংলাদেশের ময়মনসিংহে) জন্ম (২ নভেম্বর, ১৯৩৫) নিলেও ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে ভারতেই স্থায়ী হন। ৬ দশকের বেশি সময় ধরে সাহিত্য সাধনায় তিনি বাংলা কথাসাহিত্যকে এক ঈর্ষণীয় উচ্চতায় আসীন করতে সক্ষম হয়েছেন।
বিষয় ও চরিত্র বৈচিত্রে এবং বিপুলতার কারণে শীর্ষেন্দ মুখোপাধ্যায়ের জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য কয়েক প্রজন্মের কল্পলোকের এক অনিবার্য ক্যানভাস হয়ে উঠেছে। সেকারণেই হয়ত তাঁর সাহিত্যকর্ম অগণন পাঠকের মনে ঝড় তোলার সঙ্গে সেলুলয়েডের পর্দাও কাঁপিয়েছে সমানভাবে। নব্বই ছুঁই ছুঁই প্রবাদপ্রতিম এই সাহিত্যিকের মুখোমুখি হয়েছিল বার্তা২৪.কম।
সংক্ষিপ্ত, তবে আবেগঘন একান্ত এই সাক্ষাৎকারে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সমকালীন বাংলা সাহিত্য নিয়ে তাঁর অভিব্যক্তি তুলে ধরেছেন। কলকাতার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ঋত্তিক মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বার্তা২৪.কম’র পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।
বার্তা২৪.কম: বাংলা সাহিত্যের যে গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে, তার নিরিখে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রবাহ নিয়ে আপনি কতখানি আশাবাদী?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: এখন থ্রিলারধর্মী লেখা বেশি লেখা হচ্ছে। আমি নৈরাশ্যবাদী একেবারেই নই, খুবই আশাবাদী মানুষ আমি। এই সময়ে বাংলাদেশেও যারা লিখেছেন, শক্তিশালী লেখক তারা। নেচারলি, আমাদের দিনকাল তো শেষ হয়ে এল, আমরা তো আর বেশি দিন লিখতে পারব না। সম্ভবও না। এখন সম্ভাবনাময় নতুন লেখক যারা (দুই বাংলাতেই)..বাংলা সাহিত্যকে আমরা একটা তো ধরি না-দুই অংশকে নিয়েই ধরি। বাংলাদেশের অনেক নতুন নতুন ছেলে-মেয়েরা ভালো লিখেছেন..দেখা যাক।
বার্তা২৪.কম: বাংলাদেশে অমর একুশে গ্রন্থ মেলা কিংবা পশ্চিমবঙ্গের বই মেলাকে ঘিরে প্রচুর বই প্রকাশিত হচ্ছে। এর প্রভাব কতখানি আছে বলে আপনি মনে করেন…
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: বই মেলা তো এখন দু’খানেই হচ্ছে। এর প্রচুর ইমপ্যাক্ট আছে। প্রথম বই মেলা যখন শুরু হয় ৪৭ বছর আগে তখন তো লোকই আসতো না, কয়েকজন লোক ঘুরে বেড়াত, লোকের কোন ধারণাই ছিল না। ধীরে ধীরে এখন যে জায়গায় বই মেলা পৌছেছে, এই বইমেলার (ঢাকায় অমর একুশে গ্রন্থমেলা) প্রভাবে প্রচুর বইমেলা হচ্ছে, যেহেতু বাংলাদেশ মাতৃভাষাকেন্দ্রিক একটি দেশ, বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক দেশ; সেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে-ফলে একুশে বইমেলা ছাড়াও অন্যান্য বই মেলাও হয় সেখানে। বইপ্রকাশও বেড়েছে, পাঠকও বেড়েছে।
বার্তা২৪.কম: ১৯৪৭ সালের দেশভাগের যে ক্ষত এবং পরবর্বতীতে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাভাষি মানুষদের, সর্বোপিরি বাঙালীর স্বাধীন সার্বভৌম যে রাষ্ট্রের উন্মেষ হলো; ধীরে ধীরে দু’দেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের জায়গাটি ক্রমেই ক্ষীণ হয়েছে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: সম্পর্কটা রাজনৈতিকভাবে রাখলে হবে না। রাজনৈতিক সম্পর্কটা মাথা থেকে তাড়াতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক..সাহিত্যের সম্পর্ক-এটাকে বড় করে দেখতে হবে। বাঙালির মধ্যে সেই মেলবন্ধনটা আছে কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্তরে তো নানা রকম… ব্যাপার রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশে ও ভারতের আরেকটা ব্যাপার আছে তা হচ্ছে, মৌলবাদী শক্তির যে মাত্রাটা দেখছি তা আবার বিপজ্জনক। মৌলবাদিতা দুই দেশের জন্যই বিপদ। এসব বিষয়গুলোকে যদি বাদ রাখা যায় তবে সাংস্কৃতিক সম্পর্কটা ভালোই এগুবে। বইয়ের আদান-প্রদানটা আরও বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। পাইরেসির একটা উৎপাত আছে, আমাদের সব বই ওখানে পাইরেসি হয়ে যাচ্ছে, ফলে মুশকিল-আমরা সেখান থেকে কোন রয়েলটি পাচ্ছি না। কিন্তু বই ওখানে সবাই পেয়ে যাচ্ছে। এটা একটা দুঃখের ব্যাপার । বইয়ের আদান-প্রদানের ওপর যে ট্যাক্স বসানো হয়েছে সেটা দুই দেশেই উঠিয়ে দেওয়াই উচিত।
বার্তা২৪.কম: আপনার অগণিত পাঠক বাংলাদেশে, তাও আবার কয়েক দশক ধরে। তাদের উদ্দেশ্যে আপনার কি বলার আছে-
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: বাংলাদেশে আমার পাঠকের যে সংখ্যা তা এখানকার চেয়ে (পশ্চিমবঙ্গ) ৫-৬ গুণ বেশি। যদিও পাইরেসি হয়ে যাওয়ায় আমরা রয়েলটি পাই না কিন্তু এই অগণন পাঠকের বিষয়টি আমাকে আনন্দ দেয়। তাদের প্রতি আমার অফুরান শুভেচ্ছা রইল।
বার্তা২৪.কম: বাংলাদেশে আপনার শেকড়। আবার কবে যাচ্ছেন…
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: এখন বয়স হয়ে গেছে, গেলেও ভেবে চিন্তে যেতে হবে। বাংলাদেশে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে, তা আমাকে খুব ব্যাকুল করে। দেশভাগের ক্ষত আমি এখনও বহন করছি।
বার্তা২৪.কম: অন্নদাশঙ্কর রায় কবি নজরুলকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘ভাগ হয়নিক নজরুল’। আপনার ক্ষেত্রেও তো সেটি প্রযোজ্য-আপনার বিপুল পাঠকের কাছেও তো আপনাকে ভাগ করা যানি…
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: সেটাই আমার ভাগ্য…