পিটার শ্লেমিল : এক ছায়াহীন মানুষের কাহিনী



এনামুল রেজা
আডেলবার্ট ফন শামিসো ও তাঁর বই

আডেলবার্ট ফন শামিসো ও তাঁর বই

  • Font increase
  • Font Decrease

বইয়ের দোকানে লক্ষ্য ঠিক করে খুব কমই গিয়েছি আমি। সুযোগ পেলেই বাংলামোটোর হয়ে শাহবাগ বা নিউমার্কেট এরিয়ার গ্রন্থবিতানগুলোতে এত ঢুঁ মারা হয়, প্রত্যেকবার লক্ষ্য ঠিক করে রাখা সম্ভব না আসলে। এই ব্যাপারটার মধ্যে চাপা উত্তেজনা আছে। অপ্রত্যাশিতভাবে এমন কিছু বই একেকবার হাতে চলে এসেছে, সেসব পাঠান্তে আমি আমার নিরুদ্দেশ ওইসব ভ্রমণকে গোপনে ধন্যবাদ জানিয়েছি।

এভাবেই কোনো এক গ্রীষ্মের দুপুরে ছোট্ট বইটার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। শেলফে ঘুমিয়ে ছিল। হাতে তুলে নিতেই যেন সে জেগে উঠল করতলে, আঙুলের ফাঁকে। বিড়বিড় করলাম, ‘অদ্ভুত তো, ছায়া হারিয়ে ফেলা এক লোকের গল্প। নাম ‘ছায়াবিহীন’। ক্লাসিকের মর্যাদা পাওয়া এক জার্মান নভেলা পিটার শ্লেমিল (Peter Schlemihl)। লেখক আডেলবার্ট ফন শামিসো। ইংরেজি অনুবাদ থেকে সেটি বাংলায় নামিয়েছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়।

আকারে ছোট হলেও উপন্যাসিকাটির বিষয়বস্তুকে কেন জানি না, খুবই ভারী বলে মনে হলো আমার। কিন্তু ফাউস্তিয়ান কিংবদন্তির নেশাধরানো আমন্ত্রণ খুব বেশিদিন এড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না। এক উইকেন্ডের রাতে বইটা নিয়ে বসে গেলাম।

আমাদের নায়ক পিটার শ্লেমিল জাহাজে চেপে নতুন এক শহরে হাজির হয়েছে যেখানে সে তার ভাগ্যকে বাজিয়ে দেখতে চায়। সম্বল সামান্য একটা ব্যাগ, অল্প কিছু অর্থ। ভাঙাচোরা সস্তার একটা সরাইখানায় সে আশ্রয় নিল।

খুঁজে পেতে যার সন্ধান সে বের করতে চাইল, তিনি শহরটির অন্যতম ধনী ব্যক্তি মিঃ জন। শহর থেকে একটু দূরে এক জমকালো বাড়ি আর পাহাড়ী গোলাপবাগানে লোকটিকে খুঁজে পেল পিটার। মান্যগণ্য পুরুষেরা মিঃ জনকে ধন্য ধন্য করছে। সুন্দরীরা তার সঙ্গ পাবার জন্য আকুল। এসবের মাঝখানে নিজেকে খুবই বেচারা, অসহায় আর অনাহুত মনে হলো তার। কিন্তু মিঃ জন হতাশ করলেন না, যেহেতু তার সম্পদের কোনো কমতি নেই, আশ্বাস দিলেন যে পিটারের ব্যাপারটা দেখবেন তিনি।

আরো পড়ুন ➥ প্রেম ও পুরুষের পৃথিবীতে

এই ধনী লোকদের আসরের মাঝখানেই ধূসর কোট পরা লম্বা এক লোককে ঘুরে বেড়াতে দেখল পিটার শ্লেমিল। ব্যাখ্যার অযোগ্য তার ক্ষমতা, সন্দেহজনক তার আনুগত্য ও বিনয়। যে যা চাইছে, নিজের কোটের পকেট থেকে সে জিনিসটাই নিমেষে তাকে বের করে দিচ্ছে লোকটা। সামান্য একটা কোটের পকেট থেকে এত কিছু কিভাবে বের হচ্ছে, পিটার ভেবে বের করতে পারল না। এক সময় ব্যাপারটা তার সহ্যের সীমানা ছাড়িয়ে গেলে ওখান থেকে সরে পড়াই বুদ্ধিমানে কাজ মনে হলো। আর তখনই সেই রহস্যময় লোক আচমকা পথ আঁটকে দাঁড়াল, ব্যাপারটা যেন এরকম, ‘আরে যাচ্ছেন কোথায়? আপনার সঙ্গেই তো আমার আসল কারবার।’

কী এই আসল কারবার?

লোকটি পিটারকে বলল যে তার ছায়াটি বড় চমৎকার, অমূল্য। এমন নিখুঁত ছায়া পৃথিবীতে খুব অল্প মানুষেরই হয়। পিটার যদি ছায়াটি বিক্রি করতে রাজি থাকে, খুব যোগ্য বিনিময় দিতে রাজি আছে সে। এই কথা বলে কোটের পকেট থেকে সে বের করল এমন এক থলি, যা থেকে অনিঃশেষ স্বর্ণমুদ্রা বের হয়।

দরিদ্র্য পিটার শ্লেমিল হতভম্ব হয়ে গেল এই কাণ্ড দেখে। একটা সামান্য বিনিময়ে ওই অসম্ভব ঐশ্বর্যের খনি? কিছুক্ষণ দোটানায় ভুগলেও লোকটির প্রস্তাবে সে রাজি হয়ে গেল। বিক্রি করে দিল নিজের ছায়া।

এই ঘটনার পর থেকেই আসলে শুরু হলো তার জীবনের এক ভয়ঙ্কর দুর্দশাগ্রস্ত আর অস্তিত্ব সংকটে ধুকে ধুকে কাটাবার পর্ব। শ্লেমিল শব্দটা হিব্রু, এর অর্থ হলো হতভাগ্য। যে লোকের ছায়াই নেই, সে কিভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারে?

শুরুতেই বলেছি, এই গল্পের উৎসবিন্দু হচ্ছে ফাউস্তিয়ান কিংবদন্তি। ফাউস্ত ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক বিখ্যাত মানুষ। কিন্তু জ্ঞানের অসীম তৃষ্ণা মিটছিল না তার। সুতরাং, শয়তান এসে তাকে দেখা দিল আর দিল বিচিত্র এক প্রস্তাব। ফাউস্ত শয়তানকে নিজের আত্মা বিক্রি করলেন, বিনিময়ে পেলেন পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান আর অফুরান ধনসম্পত্তি।

এই এক জার্মান উপকথা গোটা ইউরোপে দারুণ প্রভাব বিস্তার করে আছে চিরকাল। ক্রিস্টোফার মারলো থেকে গ্যেটে থেকে টোমাস মান, ফাউস্তের ট্র্যাজেডি নানাভাবেই রিক্রিয়েট হয়েছে সাহিত্যে। আরো হয়তো হবে এবং হচ্ছেও।

আরো পড়ুন ➥ সিয়েরভা মারিয়ার স্মৃতি

কিন্তু পিটার শ্লেমিল পড়তে গিয়ে মনে হলো, নিজের আত্মজৈবনিক হতাশাকে ধরে রাখতে শামিসো কি ফাউস্তের চেয়ে জবর কোনো টুলস আর খুঁজে পেতেন? সেই অমোঘ নিয়তির মতো বই পড়তে পড়তে লেখকের ব্যক্তিজীবনে ডুব মারার বিরক্তিকর স্বভাবটা মুহূর্তেই আমাকে আচ্ছন্ন করল। সব লেখকের ক্ষেত্রে এমনটা না হলেও রচনায় লেখকের নিজস্ব যাপনের কিছু কিছু ছায়া তো থেকেই যায়, এমনকি অন্যদের জীবনকে নিজের জীবনের মতো করে গল্প তৈরির ক্ষমতাও থাকে একজন শক্তিমান রচয়িতার।

পিটার শ্লেমিল পড়তে গিয়ে এই দুটি ব্যাপারই আবিষ্কার করলাম। পিটার একজন বাস্তব মানুষ, আর আডেলবার্ট ফন শামিসোকে মূলত নিজের দুর্ভাগ্যের কাহিনী সে শোনাচ্ছে, এমন কয়েকটা দৃশ্য আছে গল্পটিতে। এমনকি পিটারের স্বপ্নে ফন শামিসোকেও আমি দেখতে পাই, কাচের জানালার ওপাশে শামিসোর টেবিলে একটা বই এবং নিশ্চিতভাবেই বইটা গ্যেটের লেখা ফাউস্ট।

আডেলবার্ট ফন শামিসো এক এরিস্টোক্র্যাট ফরাসি পরিবারের সন্তান ছিলেন। ফরাসি বিপ্লব চলছে যখন, ১৭৯০ সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে বালক শামিসোকে পাড়ি জমাতে হইয়েছিল জার্মানিতে। ফরাসি হয়েও জার্মানিতে বসবাস আর জার্মানিতে থেকেও তারা যে ফরাসি, এই ব্যাপারটা তিনি কখনোই মেনে নিতে পারতেন না।

এমনকি সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে ১৭৯৮ সালে নিজের জন্মভূমি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আশ্রয়দাতা জার্মানের পক্ষ হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছিল তাকে। যদিও জার্মানির লোকজন তাকে নিজেদের মানুষ হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছিল, শামিসো ভাবতেন যার দেশ নেই, তার কি কোনো অস্তিত্ব আছে? জাতীয়তাবাদের এক গর্বোদ্ধত যুগে তার সাবকনশাসে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যাওয়াটাকে ভয়ানক এক ক্ষত হিসেবেই অনুমান করা যায়। পৃথিবীর সকল মানুষই কোনো না কোনো দেশের নাগরিক, আর এই দেশ ধারণাটি তাকে পৃথিবী থেকে বড় দূরে সরিয়ে দেয়। তার মনে সংকট তৈরি করে। এমনকি দেশের মাঝে যে ছোট ছোট দেশ, সেসব স্থানে বেঁচে-বর্তে থাকা লোকজনও এ সংকট থেকে মুক্তি পায় না।

পিটার শ্লেমিলের ছায়াহীনতাকে মূলত লেখকের বিপন্ন অস্তিত্বের রূপকই মনে হয় আমার। আমি পড়িও সেটা ধরে নিয়েই। অর্থবিত্তের অভাব না থাকলেও সমাজ যখন দেখে শ্লেমিলের ছায়া নেই, তখনই তাকে আর মেনে নিতে পারে না। তার জীবন হয়ে ওঠে একজন পলাতকের জীবন। দিনের আলো যে ভয় পায়, রাতের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া মানুষের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে চায় না। প্রতি মুহূর্তে আত্মপীড়ায় নিজেকে সে রক্তাক্ত করে।

এই দুর্দশার মধ্যেও শ্লেমিল কিন্তু খুঁজতে থাকে সেই ধূসর কোট পরা লোকটিকে। সে এই করুণ জীবন থেকে পরিত্রাণ চায়, অনিঃশেষ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে লাভ কি যদি তার ছায়াই না থাকে? বহুদিন পার হলে অবশেষে লোকটি আসেও। তবে নতুন এক প্রস্তাব নিয়ে। নিজের বহু মূল্যবান ছায়াটি পিটার ফেরত পেতে পারে, কিন্তু এবার বিনিময় হিসেবে লোকটি চায় তার আত্মা।

এবার সে কী করবে? ফাউস্টের মতো সেও কি তার আত্মা বিক্রি করে দেবে? যেন চাইলেই ফ্রান্সের নাগরিকত্ব ফিরে পাবেন লেখক শামিসো, কিন্তু এতদিন যে দেশ তাকে আশ্রয় দিল, তার সঙ্গে করতে হবে বেঈমানী!

বইটির ন্যারেটিভ খুবই সমান্তরাল। একটা মোক্ষম শুরু এবং অভাবনীয় সমাপ্তি আছে। সেই সমাপ্তি উন্মুক্ত। যেন আরো বিচিত্র সব অভিযানে অংশ নেবার জন্য পাঠককে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। লেখক ও বৃক্ষবিদ ফন শামিসো তার কাহিনীতে যে কল্পনা ও উপকথার মিশেল ঘটিয়েছেন, তাকে জাদুবাস্তবতার আদিকাণ্ড হিসেবেও ধরে নেওয়া যায়।

নিজে সমাজের যেই অংশের প্রতিনিধি ছিলেন, তাদের সম্পর্কে শামিসোর মনোভাব স্বস্তিকর কিছু ছিল না, তিনি ভাবতেন এরা সবাই মূলত শয়তানের কারবারি, আর সাধারণ মানুষেরাও যে ধনীদের স্তুতি করত তা কেবলমাত্র সম্পদের লোভেই। শহুরে মানুষের এই দুই শ্রেণী কেউ কাউকে বিলং করে না কিন্তু একে অন্যকে ছাড়া টিকতেও পারে না, এ ব্যাপারটিকেও বিদ্রুপের কাঁটায় তিনি হয়তো বিদ্ধ করতে চেয়েছেন।

তবে এভাবে না দেখে, এমনকি যে পাঠক শামিসোকে চেনেন না একদম, কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই পিটার শ্লেমিলকে পড়ে নিতে পারেন।

অন্ধকার থেকে আলোয় উঠে আসতে চাওয়া জীবনের এক অপূর্ব গল্প এটি। যেখানে আছে শয়তানের ধোঁকা, ফরচুনেটাসের থলি যার ভিতরে হাত গলিয়ে দিলেই মেলে মুঠো মুঠো সোনার মোহর, আজব পাখির বাসা যা মাথায় দিলে মানুষ অদৃশ্য হয়ে যায়, সপ্তসিন্ধু জুতো যা পায়ে দিলে অনবরত ঘুরে বেড়ানো যায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চোখের পলকেই। আর চূড়ান্তভাবে আছে অশুভের বিরুদ্ধে মানবাত্মার সেই চিরায়ত যুদ্ধের কথা, যে যুদ্ধে জিতে গেলেই মুক্তি মিলতে পারে, হেরে যায় শয়তান, আত্মার যেই মুক্তির কাছে পৃথিবীর সমস্ত ধন-সম্পদ তুচ্ছ। কিন্তু এই জিতে যাওয়াটা কি সম্ভব?

কতভাবেই না একটা বই লেখা যেতে পারে, আর বিচিত্র পাঠক কতভাবেই না সে বইটি পড়তে পারেন।

   

পাক বেতারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য বেশী সময় দাবি মুজিবের



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম
পাক বেতারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য বেশী সময় দাবি মুজিবের

পাক বেতারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য বেশী সময় দাবি মুজিবের

  • Font increase
  • Font Decrease

 

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ঊনসত্তুরের উত্তাল দিনগুলিতে স্বৈরশাসক আয়ুব খান একের পর এক বিরোধীদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন, যদিও তাতে তাঁর ক্ষমতায় থাকার পথ সুগম হয়নি। সেই সময়কার ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর খবরে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের খবর গুরুত্বের সঙ্গে স্থান করে নেয়। বিশেষ করে আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডর খবর গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসে। তেমনি একটি খবর (২১ মার্চ ২০২৩) প্রকাশ করে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা।

ঢাকার দ্য মর্নিং নিউজ’কে উদ্ধৃত করে দৈনিকটি ‘পাক বেতারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য বেশী সময় দাবি’ শীর্ষক খবর প্রকাশ করে। খবরে বলা হয়, ‘ঢাকার মরনিং নিউজ-এর খবরে প্রকাশ, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য অধিক সময় ধার্য করার দাবি জানিয়েছেন।’

বার্তা সংস্থা ‘ইউ এন আই’ এর বরাতে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘শেখ বলেন যে, বিদেশী সংস্কৃতির ধুয়া তুলা রবীন্দ্র সংগীত বাতিল করা চলবে না। রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলার কবি নন, তিনি সারা বিশ্বের।’

এতে আরও বলা হয়, ‘শেখ প্রশ্ন করেন যে, আমরা যদি শেকসপীয়র, হাফিজ, মারকস এবং লেনিনের গ্রন্থ পড়তে পারি তবে কেন রবীন্দ্র সাহিত্য পড়তে পারব না? জ্ঞান লাভের জন্যই লোকে এইসব বই পড়েন।’

পাশেই ‘ইউ এন আই’ এর বরাতে সিঙ্গেল কলামে ‘রেডিও পাকিস্তান স্বায়ত্তশাসিত করপোরেশন হচ্ছে’ শীর্ষক আরেকটি খবর। খবরে বলা হয়, ‘ রেডিও পাকিস্তান ১ জুলাই থেকে স্বায়ত্তশাসিত করপোরেশনে পরিণত হবে কাল রাওয়ালপিন্ডিতে ঘোষণা করা হয়েছে।’

সামরিক শাসক আইয়ুব খানের নতজানু হওয়ার খবর জানিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রেসিডেন্ট আয়ুব খাঁর মন্ত্রিসভা আজ এই সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত করে বিরোধীপক্ষের আরও একটি দাবি মেনে নেওয়া হল। বিরোধিপক্ষ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দাবি করে আসছিল।’

(চলবে...)

;

ধর্মের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস জানা যাবে যে গ্রন্থে



অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

অধ্যাপক ড. মোঃ মোজাম্মেল হক রচিত ‘ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ:  প্রারম্ভকাল থেকে ১৫০০ প্রাক সাধারণ অব্দ পর্যন্ত’ গ্রন্থটি ধর্ম সম্পর্কে জানার এক অসাধারণ স্মারক গ্রন্থ। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সভ্যতার যুগ অবধি ধর্মের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে এনেছেন লেখক, যা শিক্ষার্থী থেকে বোদ্ধা পাঠক-সবার জন্যই হবে সুখপাঠ্য। ধর্ম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান সীমিত। পৃথিবীব্যাপী মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ভিন্নতা আছে। ভিন্নতা আছে জাতীয়তার ক্ষেত্রেও। এই জাতীয়তা এবং ধর্মীয় ভিন্নতা মানুষে মানুষে ভিন্নতা সৃষ্টি করেছে। এই ধর্মীয়বোধের আচার-আচরণ কোথা থেকে কখন শুরু হয়, এ গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে।

বলা হয়ে থাকে যে, সভ্যতা যুগের পূর্বেও ধর্ম ছিল। তবে সেই ধর্ম ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। মূখ্যত জীবন-মৃত্যু নিয়েই ছিল মানুষের ভাবনা। গ্রন্থটির সার-সংক্ষেপে বলা হয়, মানুষ মৃত্যুর পরে পুনরায় জীবিত হয়ে নতুন এক জগতে বসবাস করে-এমন সাধারণ ভাবনাই ছিল প্রাগৈতিহাসিক মানুষের বিশ্বাসে। প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা এই জাগতিক জগতের মতো পরজগত সম্পর্কে কল্পনা করতো। এই কারণেই মৃত ব্যক্তির সাথে জাগতিক জগতের খাবার ও প্রয়োজনীয় হাতিয়ার প্রদান করা হতো, যাতে মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে  নতুন অথচ একই রূপ জগতে বিচরণ করে তার জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।

পরজগত সম্পর্কে মানুষের এই সাদামাটা বিশ্বাস সভ্যতার সময়ে এসে আমুল পরিবর্তন হয়। এই সময়ে মানুষের কল্যাণের ক্ষেত্রে জাগতিক পৃথিবীতে বিরাজমান গ্রহ-নক্ষত্রগুলোকে অধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়। এবং প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর দেবত্ব আরোপ করা হয়। এই গ্রহ নক্ষত্রগুলোর অনুকম্পায় সফল সফল উৎপাদন ও অনাবিল আনন্দঘন জীবন-যাচনের নানারূপ কাহিনী সৃষ্টি করে গ্রহ নক্ষত্রের ওপর মানুষের বিশ্বাসকে আরও অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলা হয়। সে সময়ে মিথ তৈরি হয় যে, জাগতিক পৃথিবীর মালিক হচ্ছেন ঈশ্বর। এবং রাজা বা ফারাওগণ হচ্ছেন কোনো না কোনো গ্রহ-নক্ষত্রের পুত্র। ফলে ভূমি ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠী রাজা বা ফারাও কে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের পুত্র মনে করে উৎপাদিত ফসলের অংশ উপঢৌকন অথবা রাজস্ব হিসেবে প্রদান করে পুণ্য অর্জন করতো। অন্যদিকে, রাজা বা ফারাও যে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতিনিধি/পুত্র সে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতীক হিসেবে প্রতীমা তৈরি করে মন্দিরে স্থাপন করতো।

মিথের নিগূঢ় অর্থের আলোকে মন্দিরে দেবতার উদ্দেশ্যে রাজা বা ফারাও প্রাত্যহিত, পাক্ষিক, মাসিক ও বাৎসরিক পুজা-পার্বণ এবং উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রাষ্ট্রীয় জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ রেখে রাজ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতো। রাজাদের এরূপ কর্মকা-ের কারণেই সভ্যতার যুগে ধর্মীয় চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপে আবির্ভূত হয়েছিল- যা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে। সভ্যতার যুগে মূর্তি, পূজা ও মন্দির কেন্দ্রিক সমাজ ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় অতিষ্ঠ হয়ে কতিপয় জনগোষ্ঠী সভ্যতার যুগের শেষের দিকের বিমূর্ত মতবাদ প্রচার করেিেছল। পৌত্তলিকতার বিপরীতে এই মতবাদের মূল বিষয় ছিল বহু দেবদেবীর পরিবর্তে এক ঈশ^র মতবাদ। এবং ঐকান্তিক সাধনা, ধ্যান, ত্যাগ, তিতিক্ষা প্রভৃতির মাধ্যমে মুািক্ত লাভ বা ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করা । প্রাক সাধারণ অব্দে পশ্চিম এশিয়ার হিব্রু মতবাদ, পারস্যের  জোরাস্ট্রার মতবাদ, ভারতের জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম এগুলোর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

গ্রন্থটিতে অধ্যায় রয়েছে তিনটি। এগুলো হলো প্রাগৈতিহাসিক মানুষের বিশ্বাস, মিশরীয় অঞ্চলের ধর্ম বিশ্বাস, মেসোপটেমীয় অঞ্চলের ধর্ম। গ্রন্থটির শুরুতে মুখবন্ধে সুদূর অতীত থেকেই ধর্ম মানুষকে জীবন চলার পথ ও পাথেয় দেখিয়েছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। রাষ্ট্র ও সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষা করেছে এবং মানুষের চিন্ত-ভাবনায় সততা ও পরিশুদ্ধতা আনয়ন করেছে। ধর্মের যে বর্তমান রূপ, অতীতে তা ছিল না। অতীতের ভাবনাগুলোকে কেবলই বিশ্বাস হিসেবে ভাবা যেতে পারে। সেখানে মানুষের মধ্যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ভাবনা ছিল কী-না নিরূপণ করা যায়নি। আবার ঈশ্বর সর্বজান্তা, সর্বত্র বিরজমান, এমন বক্তব্যও প্রচারিত হয়নি। মানুষের বিশ্বাসে তখন কেবলই ছিল প্রকৃতি ও তাদের চারপাশে বিরজমান বিশ্ব-ভ্রমান্ডের আকাশ, বাতাস, গ্রহ নক্ষত্র প্রভৃতি। মানুষ এগুলোকে মঙ্গলময় হিসেবে ভাবতো। কারণ এগুলো কোনো না কোনোভাবে মানুষের জীবন চলার  পথকে সহজ ও সুগম করে তুলেছিল। ফলে এগুলো ছিল তাদের কাছে মঙ্গলময়ী দেব অথবা দেবী এবং এদের আর্শীবাদ ও অনুকম্পা পাওয়ার প্রত্যাশায় মানুষ তাঁদেরকে অর্ঘ্য প্রদান করতো।

হিন্দু নর-নারীরা বিয়ের সময় সাতপাক ঘুরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সাতবার ঘুর্ণনের পিছনে বিশ্বাস হচ্ছে যে, সদ্য বিবাহিত এই নর-নারী যেন বারবার পুনর্জন্ম নিয়ে একে অপরকে খুঁজে পায় এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। প্রাগৈতিহাসিক সময়ে পুনর্জন্ম বিশ্বাসের ধারা এমন ছিল না। তখনকার মানুষ বিশ্বাস করতো যে, মানুষ মৃত্যুর পর অন্য এক জগতে পুনরাায় জেগে উঠে এবং সেই নতুন জগতেই সে তার জীবন ও জীবিকা পরিচালনা করে থাকে। মৃত ব্যক্তি জেগে উঠে যেন কিছু খেয়ে পুনরায় শিকারে বের হতে পারে, এই বিশ্বাসের কারণে তখনতকার মানুষেরা শবের সাথে কিছু খাবার ও শিকারের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় হাতিয়ার, কবরে উপঢৌকন হিসেবে প্রদান করতো।

মানুষের এই সাধারণ বিশ্বাসগুলোই ক্রমশ বিবর্তিত ও পরিশিলিত হয়ে সভ্যতার যুগে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই সময়ে পৌত্তলিকতাবাদের বিকাশ ঘটে, গ্রহ-নক্ষত্র কেন্দ্রিক দেব-দেবীর সৃষ্টি হয়, দেব-দেবীরদের মধ্যে সমন্বয় ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তাদেরকে একটি পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ করা হয় এবং তাঁদের মহিমা ব্যক্ত করার জন্য অসংখ্য মিথের জন্ম দেয়া হয়। সভ্যতার যুগে আরও লক্ষ করা যায় যে , মিথের অবয়বে এই সময়ে পূজার নিমিত্ত দেব-দেবীর প্রতীকৃতি তৈরি মন্দিরের পরিসীমায় বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীই ছিল মন্দিরে স্থাপিত দেব- দেবীর ভক্ত।

মিশর ও মেসোপটেমীয়ার ধর্মগুলো ছিল অঞ্চল ভিত্তিক (নীলনদ ও দজলা ফোরাত নদীর অববাহিকা কেন্দ্রিক)। সেই তুলনায় ঐতিহাসিক যুগের ধর্মগুলো কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ না থেকে বৃহত্তর অঞ্চলে বিস্তৃত হয়েছিল, যেমন, মানিবাদ, জরথুষ্ট্র মতবাদ, বৌদ্ধ মতবাদ প্রভৃতি। এগুলো ছিল সার্বজনীন ধর্ম এবং এগুলোরর অন্তর্নিহিত বক্তব্য বা মতবাদ সকল অঞ্চলের চিন্তা, চেতনা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে প্রচারিত হয়েছিল। অঞ্চলভিত্তিক ধর্মের পরিবর্তে সার্বজনীন ধর্মের সূচনা হওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনেও পরিবর্তন আসে। যেমন রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ সাম্রাজ্য কেন্দ্রিক ব্যবস্থার প্রচলন হয়। দারিয়ূসের নেতৃত্বে গড়ে উঠা পারস্য সাম্রাজ্য এর জলন্ত উদাহরণ।

ধর্মের ক্রমবিবর্তন ধারাটি অত্যন্ত জটিল। এ গ্রন্থে সাধারণ পাঠকের বুঝার সুবিধার্থে অত্যন্ত সহজ করে এটি আলোচনাটি করা হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সভ্যতার যুগ পর্যন্ত ধর্ম-বিশ্বাসগুলোকে এই গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে। গ্রন্থটির প্রচ্ছদে মিশরীয় মিথের ওগডোডদের সহায়তায় ‘আতুম/রা’দেবতার উত্থান তুলে ধরা হয়েছে। প্রচ্ছদটি এঁকেছেন অসীম চন্দ্র রায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে সেন্টার ফল আরকোলজি এ্যান্ড হেরিটেজ রিসার্চ সেন্টার। গ্রন্থটির মূল্য ৩৫০ টাকা। তবে শিক্ষার্থীরা ১৫০ টাকায় এ গ্রন্থটি কিনতে পারবে। গ্রন্থটি ধর্ম সমন্ধে জানতে আগ্রহী পাঠকের কাছে সমাদৃত বলে বিশ্বাস করি।

লেখক: সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

;

কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত



নাজমুল হাসান
কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত

কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩২৮ সালের অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র ২২ বৎসর ৬ মাস বয়সে আড্ডার ফাঁকে একটুখানি সময়ের মধ্যে ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ কবিতাটি গানের সুরে রচনা করেন। 'ভাঙার গান' শিরোনামেই কবিতাটি 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার ২০ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ অনুযায়ী বাংলা পৌষ-মাঘ ১৩২৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতা হলেও এটি ছিল মূলত একটি বিদ্রোহাত্মক গান; কবিতাটির শিরোনামের মধ্যেই সেটি প্রকাশ পেয়েছে।

১৯২৪ সালের আগস্ট মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩৩১ সালে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার আষাঢ়-শ্রাবণ সংখ্যায় কবিতাটির সাথে আরও ১০টি কবিতা যোগ করে মোট ১১টি কবিতা নিয়ে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের দুই মাস পর ১১ নভেম্বর ১৯২৪ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত শাসনাধীন বঙ্গীয় সরকার গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। ব্রিটিশ সরকার আর কখনো এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। ফলে পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতে গ্রন্থটি আর প্রকাশিত হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

পটভূমি:

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলাকালীন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পাদনায় 'বাঙ্গলার কথা' নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন হেমন্ত কুমার সরকার। ব্রিটিশ বিরোধী এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত সরকার ব্যাপকভাবে তরুণদেরকে গ্রেপ্তার করতে থাকে। 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। ওই সময় 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার হাল ধরেন চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী।

একদিন বাসন্তী দেবী 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি কবিতা লিখে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে দাশ পরিবারের সুকুমাররঞ্জন দাশকে নজরুল ইসলামের কাছে পাঠান। এ সময়ে নজরুল ইসলাম ও কমরেড মুজাফফর আহমদ কলকাতার ৩/৪ সি, তালতলা লেনের একটি বাড়ির নিচ তলায় একই রুমে ভাড়া থাকতেন। 'ভাঙার গান' শীর্ষক এই গানটি সম্পর্কে কমরেড মুজাফফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা'-তে লিখেছেন- "আমার সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রী সুকুমাররঞ্জন দাশ 'বাঙ্গলার কথা'র জন্য একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। সুকুমাররঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম।‌ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা লেখা শুরু ক'রে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাঁর সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল।”

পড়া শেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম কবিতাটি সুকুমাররঞ্জন দাশের হাতে দেন, যা 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাসন্তীদেবীর অনুরোধে পরবর্তীতে নজরুল ইসলাম কবিতাটি সুরারোপ করে সে গানের স্বরলিপিও তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন বলে জানা যায়। ফলে এ গানের সুরকার নজরুল ইসলাম নিজেই। এই কবিতাটি লেখার দুই/তিন সপ্তাহ আগে ওই বাড়িতে থাকার সময়েই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কালজয়ী ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ হুগলী জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় তিনিসহ সেখানে বন্দি থাকা অন্যান্য স্বদেশী আন্দোলনের বন্দিরা একত্রে কোরাস আকারে কাজী নজরুল ইসলামের দেওয়া সুরে সর্বপ্রথম ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি জেলখানার ভিতরেই গেয়েছিলেন।

ব্রিটিশ রাজরোষের কারণে কাজী নজরুলের লেখা যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট ৫টি গ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি। ১৯২২ সালে নজরুল 'ধূমকেতু' নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ধূমকেতু'র দ্বাদশ সংখ্যায় 'আনন্দময়ীর আগমন' নামে নজরুলের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে এই কবিতায় নজরুলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রাজদ্রোহের মামলা হয়। একই বছরের ৮ নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।

দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত নজরুলের বিচার হয়েছিল কলকাতার আলীপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। পরবর্তীতে এ মামলার রায়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। রায় ঘোষণার পরেরদিন তাকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

নজরুল ইসলামকে ২৩ নভেম্বর ১৯২২ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ এই এক বছর জেলে রাখা হয়। জেল-জীবনে কয়েদিদের সঙ্গে কোরাস কণ্ঠে তিনি বহুবার এ গানটি গেয়েছেন। যদিও সে গানের কোনো রেকর্ড নাই। পরবর্তীতে গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া এ গানটি সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া সুরই ছিল নজরুল ইসলামের নিজের করা সুর।

মূলভাব:


‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের জন্য একটি উদ্দীপনামূলক গান। গানটির মাধ্যমে কবি যে দ্রোহের প্রকাশ করেছেন তা হলো—প্রতিবাদ-ধ্বংসের মধ্য দিয়েই জাগ্রত হবে পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার নতুন পতাকা, স্বাধীনতার নতুন সূর্য স্বাধীন জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আলো ছড়াবে। গানটির মাধ্যমে নজরুল তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিপ্লবীদের মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন পরাধীনতার বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার আমিয় বাণী।

কবিতাটির প্রকাশ সংক্রান্ত ইতিহাস:
১. পত্রিকা: বাঙলার কথা, শিরোনাম: ভাঙার গান, ২০ জানুয়ারি, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ, শুক্রবার, ৭ মাঘ ১৩২৮।
২. কাব্যগ্রন্থ: ভাঙার গান, প্রথম সংস্করণ- শ্রাবণ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ, আগস্ট ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ, কবিতার শিরোনাম ‘ভাঙার গান’। দ্বিতীয় সংস্করণ- ন্যাশনাল বুক এজেন্সি লিমিটেড, ১২ বঙ্কিম স্ট্রিট, কলিকাতা- ১২। খ্রিষ্টাব্দ ১৯৪৯ । কবিতার শিরোনাম ‘ভাঙার গান’ (গান) ১। পৃষ্ঠা: ১-২।
৩. নজরুল-রচনাবলী। জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। প্রথম খণ্ড। বাংলা একাডেমি, ঢাকা। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩/মে ২০০৬। ভাঙার গান। গান-১। পৃষ্ঠা: ১৫৯-১৬০।

গানটির রেকর্ড সংক্রান্ত ইতিহাস:
১. Columbia Records- কলাম্বিয়া রেকর্ডস, প্রখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি কলাম্বিয়া’র তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত রেকর্ড। জুন ১৯৪৯, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৫৬, জি.ই. ৭৫০৬। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
২. এইচএমভি (HMV), হিজ মাস্টার’স ভয়েস- His Master's Voice, জানুয়ারি ১৯৫০, পৌষ-মাঘ ১৩৫৬, এন. ৩১১৫২। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
৩. ২০০৬ সালের মার্চ মাস জুড়ে বিবিসি বাংলার শ্রোতারা ভোট দিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কুড়িটি বাংলা গানের যে তালিকা করেছে তার মধ্যে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি ১৬তম।

গানটির চলচ্চিত্রে রূপদান সংক্রান্ত ইতিহাস:

১. চলচ্চিত্র: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। কাহিনীকার- চারুদত্ত। চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক- নির্মল চৌধুরী। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল ন্যাশনাল স্টুডিওর ব্যানারে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর, রবিবার ১১ অগ্রহায়ণ ১৩৫৬। গানটির চলচ্চিত্রের স্বরলিপিকার ও স্বরলিপিতে করেছিলেন- রশিদুন্‌ নবী। নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (বিংশ খণ্ড)। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, পঞ্চম গান। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী ও সহ-শিল্পীবৃন্দ। সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
পর্যায়: বিষয়াঙ্গ- স্বদেশ, সুরাঙ্গ- সামরিক মার্চ, তাল- দ্রুত দাদরা, গ্রহস্বর: সা।
লিঙ্ক: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন https://www.youtube.com/watch?v=F1StxYnf-yU

২. চলচ্চিত্র: জীবন থেকে নেয়া। জহির রায়হান নির্মিত শেষ কাহিনী চিত্র। চলচ্চিত্রটি ১৯৭০ সালের এপ্রিলে মুক্তি পায়। সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীত শিল্পী: খান আতাউর রহমান। শিল্পী: অজিত রায়, খন্দকার ফারুক আহমেদ ও অন্যান্য। চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির এই চলচ্চিত্রকে ‘বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী চলচ্চিত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
লিঙ্ক: জীবন থেকে নেয়া https://www.youtube.com/watch?v=4gOJVlb_9-A

‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ উভয় চলচ্চিত্রেই শিল্পী গিরীন চক্রবর্তী এবং অজিত রায় ও খন্দকার ফারুক আহমেদ গানটিকে কাজী নজরুল ইসলামের সুরে গেয়েছেন। দুটি চলচ্চিত্রের গানের সুরের মধ্যে সামান্য একটু ভিন্নতা থাকলেও উভয় ক্ষেত্রেই গানটির বিপ্লবী মূলভাব ফুটে উঠেছে। চেতনার সাথে মিল রেখে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটিকে বেশি প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। মূল গানটি জেলখানায় বসে কয়েদিরা কোরাস কণ্ঠে গেয়েছিলেন বলে দুটি চলচ্চিত্রেই গানটিকে জেলখানার কয়েদিদের দ্বারা কোরাস কণ্ঠে গাওয়ানো হয়েছে।

কবিতাটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।


ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

এখানে ‘কারা’ মানে কারাগার, তৎকালীন পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতের যে কারাগারে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনরত তরুণ বিপ্লবী বীরদের গ্রেপ্তার করে আটক করে রাখছিল। সেই কারাগারের শক্ত লোহার দরজা তথা লৌহকপাট ভেঙে ফেলে তাকে লোপাট অর্থাৎ ভেঙেচুরে গুড়িয়ে ধূলিসাৎ করে ফেলার আহ্বান জানানো হয়েছে।

‘পূজার বেদী’ হলো যেখানে পূজা করা হয়, সে শ্রদ্ধা-সম্মানের স্থান। পূজার বেদীতে মানুষের মনের গভীর থেকে উঠে আসা পরম ভক্তির আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। কবি এখানে স্বদেশকে পূজার বেদীর সাথে তুলনা করেছেন। যে পূজার বেদীতে ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্য থাকার কথা সে বেদীতে আজ ব্রিটিশ সরকার দ্বারা অত্যাচারিত ভারতের বীর সন্তান, স্বাধীনতাসংগ্রামী, বিপ্লবীদের রক্ত জমাট বেঁধে আছে, সে বেদীতে আজ পরাধীনতার শিকল পরানো। এ বেদী আজ বেদী নেই, একে নির্মমতার পাষাণে পরিণত করা হয়েছে। এ শিকল ভেঙে, জমাটবাঁধা রক্ত সরিয়ে পাষাণময় পূজার বেদীকে মুক্ত করে মায়াময় ও পবিত্র করতে হবে, অর্থাৎ পরাধীন দেশের শোষণ-নির্যাতন থেকে দেশকে মুক্ত-স্বাধীন করে তাকে উপভোগ্য ও আত্মনির্ভর করতে হবে।

ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

ঈশান শব্দের অর্থ শিব, মহাদেব, মহেশ্বর। এর আরেকটা অর্থ উত্তরপূর্ব কোণ। হিন্দুমতে শিব প্রলয়ের দেবতা এবং ধ্বংসের রাজা বা নটরাজ। এখানে কবি ‘তরুণ ঈশান’ বলতে শিবশক্তির প্রলয়ের সাথে তুলনীয় ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামী তরুণ বীর সন্তান ও বিপ্লবীদের বুঝিয়েছেন। ‘প্রলয়’ অর্থ ধ্বংস, ‘বিষাণ’ শব্দের অর্থ শিঙা। ইসলামি মতে ইসরাফিল শিঙায় ফু দিলে যেভাবে পৃথিবীর প্রলয় বা ধ্বংস শুরু হবে সেভাবে পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে তাদের ‘প্রলয় বিষাণ’ বাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদের সক্ষমতাকে কবি প্রলয়ের দেবতা মহাদেবের মহাশক্তির সাথে তুলনা করে তাদেরকে পরাধীনতার শিকল ভাঙতে প্রলয় বিষাণ বাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

‘নিশান’ মানে পতাকা,‘ধ্বংস নিশান’ মানে যে পতাকা ধ্বংসের প্রতীক, ধ্বংসের নির্দেশনা দেয়। ‘প্রাচীর’ অর্থ দেওয়াল, ‘ভেদি’ মানে ভেদ করা বা ভেঙে-ফুড়ে বেরিয়ে আসা। কবি স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে এমনভাবে ‘ধ্বংস নিশান’ বা ধ্বংসের পতাকা ওড়াতে বলেছেন যেন তা স্বাধীনতাকামী সূর্যসন্তানদেরকে যে কারাগারে আটক রেখেছে সে কারাগার ভেদ করে ফুড়ে বেরিয়ে আসে, পরাধীনতার প্রাচীর বা দেওয়াল ভেদ করে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসে। সে পতাকা দেখে যেন সমগ্র পরাধীন ভারতবাসী স্বাধীন-মুক্ত হবার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়।


গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা
মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

‘গাজন’ সনাতনধর্মীদের একটা সামাজিক উৎসবের নাম। চৈত্র মাসের শেষ দিকে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের মিলিত বাজনা বাজিয়ে গাজন উৎসব পালন করা হয়। মিলিত বাদ্যযন্ত্রের বাজনা বাজায় গাজন উৎসবের বাজনা খুব প্রকট হয়। কবি এখানে গাজনের বাজনার মতো প্রবল শব্দে বাজনা বাজিয়ে লড়াইয়ে নেমে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন হওয়ার তীব্র আহ্বান জানিয়েছেন।

কবি এখানে ব্যঙ্গ করে ব্রিটিশ শাসকদের স্বরূপ প্রকাশ করার নিমিত্তে পরাধীন ভারতবাসীকে প্রশ্ন করেছেন—কে মালিক, কে রাজা, কে সাজা দেয়, কে মুক্ত, কে স্বাধীন, কে সত্য? অর্থাৎ ওরা বিদেশি, ভিনদেশি, ওরা আমাদেরকে শাসন করার অধিকার রাখে না। এ দেশ আমাদের, এ দেশের মালিক আমরা, এ দেশের রাজা আমরা, এখানে আমরা মুক্ত-স্বাধীন, এখানে আমাদেরকে কেউ সাজা দেওয়ার অধিকার রাখে না। এখানে আমরাই সত্য, ওই ব্রিটিশরাই এখানে মিথ্যা। ওরা মিথ্যার উপরে দাঁড়িয়ে আমাদের সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করতে পারে না।

হা হা হা পায় যে হাসি,
ভগবান পরবে ফাঁসি!
সর্বনাশী
শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

ভগবান মানে সর্বশক্তিমান, সর্বমুক্তমান, সর্বমালিক মহাশক্তি। কবি এখানে ভগবান বলতে এ দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বীরদের বুঝিয়েছেন। তারাই এ দেশের মালিক। ভগবানকে যেমন বন্দি রাখা অসম্ভব, ভগবানকে যেমন বন্দি করা অসম্ভব, ভগবানকে যেমন বেঁধে রাখা তথা ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব, ভগবানকে যেমন ধ্বংস করা অসম্ভব—তেমনি এ দেশের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বীর, যারা এ দেশের মালিক তাদেরকেও বেঁধে রেখে তথা বন্দি রেখে ফাঁসির দড়ি পরানো অসম্ভব। সুতরাং এই বীরদেরকে জেলে আটকে রেখে তাদের গলায় ফাঁসির দড়ি দেওয়ার যে পায়তারা ব্রিটিশরা করছে তা দেখে কবির হা হা হা কোরে অট্টহাসি পাচ্ছে। কারণ, স্বাধিকারের জন্য যেভাবে প্রতিরোধ-সংগ্রাম চলছে তাতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভগবান অর্থাৎ এ দেশের বিপ্লবী-বীরদেরকে ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব।

ব্রিটিশ শাসকেরা বিপ্লবী-বীর ও স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দেরকে প্রচণ্ড শাস্তি দেওয়ার কথা প্রচার করে মানুষকে বিপ্লব-বিরোধী করার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। তাদের এ চক্রান্তে যাতে মানুষ ভয় পেয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে যায় সে জন্য কবি প্রচণ্ড আস্থার সাথে প্রশ্ন রেখেছেন—বিপ্লবী-বীরদের ফাঁসি দেওয়া যায়, এমন হীন অর্থাৎ নীচ ও জঘন্য তথ্য কে শেখাচ্ছে? কে ছড়াচ্ছে এমন অসম্ভব কথা? অর্থাৎ কবি মানুষকে অভয় দিচ্ছেন যেন ব্রিটিশ শাসকদের এমন চক্রান্তে ভয় পেয়ে বা বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ আন্দোলন থেকে সরে না যায়। কারণ, এই বিপ্লবী স্বাধীনতাকামী শক্তিকে আটকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।


ওরে ও পাগলা ভোলা!
দে রে দে প্রলয় দোলা
গারদগুলা
জোরসে ধরে হেচ্‌কা টানে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

প্রলয় বা ধ্বংসের দেবতা এবং ধ্বংসের মাধ্যমে সৃষ্টির দেবতা দুটোই শিব বা মহাদেব। অর্থাৎ মহাদেব ইচ্ছে করলে যেমন সৃষ্টি করতে পারেন, তেমনি ইচ্ছে করলে আবার প্রলয় বা ধ্বংসও করতে পারেন; এটা নিতান্তই তাঁর খেয়াল। এজন্য শিবকে বলা হয় ‘পাগলা ভোলা’। কবি এখানে জেলখানায় বন্দি স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদেরকে ‘পাগলা ভোলা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কবির মতে ব্রিটিশ সরকার এই পরাধীন ভারতের পুরোটাকেই কারাগার বানিয়ে রেখেছে। ফলে এই কারাগারে বন্দি প্রতিটি মানুষই আসলে ‘পাগলা ভোলা’। পরাধীনতার কারাগারে বন্দি স্বাধীনতাকামী মানুষকে কবি আহ্বান করছেন তাঁরা যেন মহাশক্তিধর ‘পাগলা ভোলা’ তথা মহাদেবের ধ্বংস বা প্রলয় ক্ষমতার মতো ক্ষমতা প্রয়োগ করে পুরো ভারতবর্ষকে দোলা দিয়ে কাঁপিয়ে তাঁদের ক্ষমতার জানান দেয়। তাঁরা যেন এই কারাগার বা গারদের লোহার শিক জোরসে ধরে হেচ্‌কা টান দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে মুক্ত হয়ে আসে।

মার হাঁক হায়দারী হাঁক,
কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক
ডাক ওরে ডাক,
মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

‘হায়দার’ অর্থ শক্তিশালী, তরবারি বা সত্যের তলোয়ার। আব্রাহামিক ধর্মের শেষ নবি হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর আপন চাচাত ভাই ও জামাতা ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর প্রচণ্ড শক্তি ও শৌর্য-বীর্য থাকার কারণে তাকে ‘হায়দার’ বলা হয়। ‘হাঁক’ শব্দের অর্থ হুংকার। কবি ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীকে হজরত আলীর সেই হায়দারী হাঁকের মতো প্রচণ্ড হুংকার দিয়ে ব্রিটিশরাজের ভিত কাঁপিয়ে পদানত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

‘দুন্দুভি ঢাক’ হলো একপ্রকার বৃহৎ ঢাক বা দামামা জাতীয় প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, রণবাদ্যবিশেষ। বন্দি-জীবন আসলে মৃতপ্রায়-জীবন; কবি বন্দিদশাকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন এবং সেই মৃত্যুদশা থেকে জীবনকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশে সজীব হয়ে গৌরবের সাথে বেঁচে থাকার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন এবং সে সাহস সঞ্চার করেছেন।


নাচে ওই কালবোশাখী,
কাটাবি কাল বসে কি?
দে রে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

বাংলা বৈশাখ মাস এবং এর কাছাকাছি মাসগুলোতে যে প্রচণ্ড ঝড় হয় তাকে ‘কালবোশাখী’ বলে। পরাধীন ভারতবাসীর মনের ভিতরে ব্রিটিশবিরোধী যে ভয়ঙ্কর আক্রোশ ক্রমাগত তোলপাড় করে চলেছিল তাকে কবি কালবোশাখীর সাথে তুলনা করেছেন। তিনি মুক্তিকামী দ্রোহী ভারতবাসীকে কালবোশাখীর ভয়ঙ্কর প্রলয় শক্তি নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলছেন, এখন বৃথা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সময় নয়। এভাবে কাল বা সময় হরণ করা খুবই অনুচিত। সময় নষ্ট না করে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার এখনই সময়।

মহাভারতের কাহিনী অনুসারে ভীম হলো পঞ্চপাণ্ডবের দ্বিতীয় পাণ্ডব। ভীম অসম্ভব শক্তিশালী ছিলেন। ভারতবর্ষের বিপ্লবী বীরদের উপরে ব্রিটিশরাজ ভীমের শক্তি প্রয়োগ করে অত্যাচার-নির্যাতন করছে, তাদেরকে গ্রেপ্তার করে ভীমের মতো শক্তিশালী কারাগারে বন্দি করে রাখছে। কবি ভারতবাসীকে আহ্বান করছেন যেন তারা তাদের সংগ্রামী শক্তি প্রয়োগ করে ওই ‘ভীম কারা’ বা শক্ত কারাগারের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়ে তা উপড়ে ফেলে মুক্তি-সংগ্রামীদের মুক্ত করে আনে।

লাথি মার, ভাঙ্গরে তালা!
যত সব বন্দী শালায়-
আগুন-জ্বালা,
-জ্বালা, ফেল উপাড়ি।।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

বল প্রয়োগ করে যারা ভারতবর্ষকে দখল করেছে তাদের কাছ থেকে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য কবি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী নন, তিনি বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করেই অধিকার ছিনিয়ে আনতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বন্দিরা কবে মুক্তি পাবেন অথবা আদৌ পাবেন কি না সে অপেক্ষায় তিনি বসে থাকতে রাজি নন। তিনি জনগণের সম্মিলিত শক্তিকে একত্র করে এখনই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সকল বন্দিশালা বা কারাগার ভেঙে সকল বন্দিকে মুক্ত করতে চান। এই শক্তি প্রয়োগকেই কবি ‘লাথি’র সাথে তুলনা করেছেন এবং মুক্ত হওয়াকে ‘তালা ভাঙা’র সাথে তুলনা করেছেন এবং বলেছেন “লাথি মার ভাঙ্গরে তালা”।

‘আগুন-জ্বালা,ফেল উপাড়ি’ শব্দগুলি দিয়ে কবি স্বদেশীদেরকে উদ্বুদ্ধ করছেন যেন তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে ব্রিটিশদের সকল অন্যায়, অবিচার, নির্যাতনকে ভারতবর্ষের মাটি থেকে চিরতরে উপড়ে ফেলেন, উচ্ছেদ করেন। এ দেশের মালিক হবে এ দেশেরই জনগণ, এ দেশকে শাসন করবে এ দেশেরই জনপ্রতিনিধি, ভারতবর্ষ হবে বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম শোষণ-নির্যাতনমুক্ত দেশ।

গানটি বিকৃতির ইতিহাস:

রাজা কৃষ্ণ মেনন পরিচালিত, আরএসভিপি মুভিজ এবং রায় কাপুর ফিল্মস প্রযোজিত, ইশান খাট্টার, মৃণাল ঠাকুর, প্রিয়াংশু পাইনুলি ও সোনি রাজদান প্রমুখ অভিনীত ‘পিপ্পা’ ছবিটি ১০ নভেম্বর ২০২৩ সালে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধকে তুলে ধরেছে। ছবিটিতে নজরুলের গান 'কারার ঐ লৌহকপাট'-এর রিমেক করা হয়েছে। অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রাহমানের রিমেক সংস্করণে গানটি গেয়েছেন ভারতীয় গায়ক রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাস, শ্রায়ী পাল, শালিনী মুখার্জি ও দিলাসা চৌধুরী।

এ আর রাহমান বাংলা গান নিয়ে আগেও কাজ করেছেন। ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: আ ফরগটেন হিরো’ সিনেমার জন্য রবীন্দ্রসংগীত ‘একলা চলো রে’-এর সংগীতায়োজন তিনি করেছিলেন। এ ছাড়া ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ গানটির সুরারোপও তিনি নিজের মতো করেছেন। তবে নজরুল সংগীত নিয়ে এটাই তাঁর প্রথম কাজ। দক্ষিণ ভারতীয় এ সুরকার তাঁর রেমিক সংস্করণে ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটির মূল সুরের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট রাখেননি। বিপ্লবী-বিদ্রোহী চেতনার ভাব ও সুরের গানটিকে তিনি লোকগীতির রোমান্টিক ঢংয়ে পরিণত করে নষ্ট করে ফেলেছেন। এমন একটি রুদ্র চেতনার গানকে হত্যা করে তিনি জঘন্য অপরাধ করেছেন যা ক্ষমাহীন।

মূল গানটি কারাগারে মধ্যে গাওয়া হলেও ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ছবিতে দেখানো হয়েছে- ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে আগুন জ্বালিয়ে নাচগান করে রীতিমতো উৎসব করে গানটি গাইছেন। গানটি গাওয়ার মুহূর্তে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। গানটি রচনার প্রেক্ষাপট এবং এর বিপ্লবী চেতনা এমন উত্সবপূর্ণ দৃশ্যের সাথে যায় না।

চলচ্চিত্রে দৃশ্যের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও উদ্দেশ্য বুঝে সেই দৃশ্যের উপযোগী গানের সুর সৃষ্টি করা সুরকারের কাজ। ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানের যে পরিবেশ দেখানো হয়েছে ওই পরিবেশে এই বিপ্লবী গানটি খাটে না। সিনেমার দৃশ্যে নরম সুরে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি গাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে আনন্দরত অবস্থায় দেখানো হয়েছে সেটি মানানসই ও যুতসই হয়নি, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ অসংগতির দায় স্ক্রিপ্টরাইটার ও পরিচালককে বহন করতে হবে। ফলে এ বিকৃতির জন্য এ আর রহমানের সাথে তারাও দোষী।

ভারতীয় গায়ক রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাস, শ্রায়ী পাল, শালিনী মুখার্জি ও দিলাসা চৌধুরী এরা প্রতিষ্ঠিত গায়ক এবং সম্ভবত সবাই বা অধিকাংশই বাঙালি। এই গানের সুর তাদের অজানা থাকার কথা নয়। ফলে এরা সবাইও বিকৃত সুরে গানটি গাওয়ার জন্য অপরাধী।

২০২১ সালে নজরুলের ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের ছেলে কাজী অনির্বাণ ও তাঁর মা কল্যাণী কাজী ‘পিপ্পা’ সিনেমা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গানটি ব্যবহারের লিখিত চুক্তি করেন। চুক্তিনামায় প্রথম সাক্ষী ছিলেন অনির্বাণ কাজী। কাজী অনির্বাণ স্বীকার করেন—মা গানটা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন সুর এবং কথা না বদলে রিক্রিয়েট করার জন্য। মা ওদের বলেছিল, গানটা তৈরি হয়ে গেলে একবার শোনাতে। কিন্তু ওরা তা শোনায়নি। ছবির নির্মাতারা এ দায় এড়াতে পারে না।

উপসংহার:
সব সৃষ্টি কালজয়ী হয় না, সবাই কালজয়ী সৃষ্টি করতে পারে না। যারা কালজয়ী সৃষ্টি করেন তারা তাদের সৃষ্টির সাথে সাথে নিজেরাও কালজয়ী হয়ে অমরত্ব লাভ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম হলেন সেই কালজয়ী স্রষ্টা; তিনি নিজেও অমর, তাঁর সৃষ্টিও অমর। 'ভাঙার গান' শিরোনামে লেখা ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি নজরুলের সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও এক অনন্য সৃষ্টি। এ সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এ আর রহমান রাখে না। অনেকে বলেন—সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ হওয়াটা স্বাভাবিক। কথাটা হয়তো সত্য কিন্তু সৃষ্টিকে ভিন্নভাবে প্রকাশ করা এবং তাকে বিকৃতরূপে প্রকাশ করা এককথা নয়। মানুষ যদি পুরনো সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ সানন্দে গ্রহণ করে তবেই তাকে পরিবর্তন করে প্রকাশ করা হয়, একেই বলে সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ।

‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটির সুর পরিবর্তন বাঙালি গ্রহণ করেনি, এটাকে বিকৃতি হিসেবে নিয়েছে। ফলে এ পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়।

নাজমুল হাসান: লেখক ও চিকিৎসক।

;

কবি সুফিয়া কামালের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নারীমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রদূত জননী সাহসিকাখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামালের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। 

মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির সমস্ত প্রগতিশীল আন্দেলনে ভূমিকা পালনকারী সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের এই দিন (২০ নভেম্বর) সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার ইচ্ছানুযায়ী তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বিকেল ৩টায় বরিশালের শায়েস্তাবাদস্থ রাহাত মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এই আন্দোলনে নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে শিশু সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন।

পাকিস্তান সরকার ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করলে এর প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন এবং তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন।

১৯৭০ সালে তিনি মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণসহ কার্ফু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেন।

সুফিয়া কামালের লেখা কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে- সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, মন ও জীবন, দিওয়ান, অভিযাত্রিক, শান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী ইত্যাদি। ‘কেয়ার কাঁটা’ নামে একটি গল্পগ্রন্থ ছাড়াও তিনি ভ্রমণ কাহিনী, স্মৃতি কথা, শিশুতোষ এবং আত্মজীবনীমূলক রচনাও লিখেছেন। সোভিয়েতের দিনগুলি এবং একাত্তরের ডায়েরী তার অন্যতম ভ্রমণ ও স্মৃতিগ্রন্থ।

সুফিয়া কামাল দেশ-বিদেশের ৫০টিরও বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, সোভিয়েত লেনিন পদক, একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার ও স্বাধীনতা দিবস পদক।

;