শীতের ছড়া
নামজাদা প্রকাশক পেঙ্গুইন বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য সুপরিচিত। এই সংস্থার আগ্রহ সামাজিক বা মানবিক বিদ্যার বিভিন্ন শাখার চেয়ে সাহিত্যের প্রতি সর্বাধিক। ‘পেঙ্গুইন ক্লাসিকস’ নামের সিরিজ প্রকাশনায় গল্প, কবিতা, উপন্যাস স্থান পায়। এই সিরিজ থেকে সদ্য প্রকাশ পেয়েছে অরুণাভ সিংহ সম্পাদিত ‘দ্য পেঙ্গুইন বুক অব বেঙ্গলি শর্ট স্টোরিজ়’। এতে সাঁইত্রিশটি গল্প রয়েছে, যার মধ্যে বত্রিশটিই সম্পাদক অরুণাভ সিংহের নিজের অনুবাদ।
সঙ্কলনটিতে লেখক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্পাদক কী রীতি অবলম্বন করেছেন তা উল্লেখ করেননি। গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কোন নীতি অবলম্বন করেছেন, জানাননি। তবে এ কথা বলেছেন যে, তার ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভর করে সঙ্কলনটি তৈরি। তিনি গল্পকার নির্বাচনে বিশেষ নতুন কিছু খোঁজার চেষ্টা করেননি।
শুরুতে সম্পাদক অরুণাভ সিংহ একটি সংক্ষিপ্ত হলেও তথ্যসমৃদ্ধ ভূমিকায় উনিশ শতকের সামাজিক আন্দোলন, বিশ শতকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, গান্ধীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন, সশস্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন, মার্ক্সবাদী সাহিত্যের প্রসার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও দেশভাগের প্রসঙ্গ অল্প কথায় আলোচনা করেছেন। এই সব ঘটনার কারণে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংসারের অনেক কিছুই আমূল পরিবর্তিত হয়েছিল। দেশভাগের কারণে বাঙালির রাজনৈতিক মানচিত্রই বদলে ছিন্নমূল মানুষের স্রোত বন্যার মতো ধেয়ে আসে দুই খণ্ডে। এই সঙ্কলনে দেশভাগ-পরবর্তী ওপার-বাংলার গল্পকে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন এবং সত্তর দশকের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার প্রসঙ্গ আছে। রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের কথাও।
বর্তমান সঙ্কলনটি কোনও বিশেষ সময়পর্বের গল্প নিয়ে নয়, বিশেষ কোনও গল্প আন্দোলন ঘিরেও নয়। এটি এ-যাবৎ প্রকাশিত বাংলা গল্পের মধ্য থেকে নির্বাচিত এক সঙ্কলন। প্রতিটি সঙ্কলনেরই কিছু ভালো ও মন্দ দিক থাকে। থাকে কিছু সীমাবদ্ধতা। যদিও সঙ্কলনটির আলোচনায় (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ অক্টোবর ২০২৪) রামকুমার মুখোপাধ্যায় শিরোনাম দিয়েছেন ‘বাঙালির রূপান্তরিত মনের কথা’, তথাপি তা সমগ্র বাঙালির ‘মনের কথা’ নয়। সম্পাদকের অবস্থানগত কারণে তিনি পশ্চিমবঙ্গের গল্পগুলোর প্রতি যতটুকু মনোযোগী হতে পেরেছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ততটুকু নন। এ কারণেই প্রশ্ন উঠে, কেন বাংলাদেশের বিষয় পশ্চিমবঙ্গে এবং পশ্চিমবঙ্গের বিষয় বাংলাদেশে উপেক্ষিত (দ্রষ্টব্য: অমিতাভ ভট্টশালী, বিবিসি বাংলা, কলকাতা, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেন পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে-সিনেমায় উপেক্ষিত’)।
শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে-পূর্ববঙ্গে ব্যবধান, ঘটিতে-বাঙ্গালে দ্বন্দ্ব, অবস্থানগত কারণে পূর্বের ব্যাপারে পশ্চিমের উন্নাসিকতা, এসব অবশ্য পুরানো ইতিহাস, তবে সাতচল্লিশ এসে সেই পার্থক্যটাকে আরও গভীর ও অনতিক্রম্য করে দিয়েছিল।’ অশোক মিত্র, একসময়ে যিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী শাসনামলে দীর্ঘকাল অত্যন্ত সফল অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন; তিনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন, 'একজন দু'জন পণ্ডিতপ্রবর এমনও দাবী করেছেন, প্রেসিডেন্সি কলেজই বাংলা, বাংলাই প্রেসিডেন্সি কলেজ। ইত্যকার দাবি আসলে একধরনের কূপমণ্ডূকতা, পৃথিবীকে জানবার চেনবার বোঝবার জন্মগত অক্ষমতা। মাত্র ক'দিন আগে এক বাংলা দৈনিকের রবিবাসরীয় বিভাগে 'মানুষ গড়বার কারিগর' শিরোনামে এক মস্ত প্রবন্ধ ফাঁদা হয়েছিল। শিক্ষকদের তালিকায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রায় অনুল্লেখিত, অনুচ্চারিত অমিয় দাশগুপ্ত মশাইয়ের নামও। (অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক হিসেবে অসাধারণ ছিলেন অমিয় দাশগুপ্তও। প্রফেসর দাসগুপ্ত এক সময়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যান। শেষ জীবনটা তার কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তাকে চিনতে চায় নি, উপেক্ষাই করেছে।)
সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রায় পঁচিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন; তার বৈজ্ঞানিক প্রতিভার স্ফূরণ ও বিকিরণ ঢাকাতেই। ১৯৪৫ সালের পরে অবশ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছিলেন বছর পাঁচ-ছয়ের জন্য, তারপর শান্তিনিকেতনে, জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে বৃত হওয়া, রাজ্যসভার সদস্য হওয়া। কিন্তু হলে কী হয়, সেই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে একবার জাত খুইয়েছিলেন, তা আর পুনর্জয় করতে পারলেন না। কলকাতার বিজ্ঞজনের কাছে তাঁর স্থান মেঘনাদ সাহার অনেকটাই নীচে।' (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, নভেম্বর ৭, ২০২২, ‘সাতচল্লিশ পশ্চিমবঙ্গ-পূর্ববঙ্গ পার্থক্যটাকে অনতিক্রম্য করে দিয়েছিল‘, ডেইলি স্টার বাংলা)।
সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তার মধ্যে ধর্ম, অঞ্চল, রাজনীতি ও জাতীয়তার ভিত্তিতে নানা বৃত্তে পৃথক করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সামাজিক উৎসব আচার-অনুষ্ঠান রীতিনীতির মধ্যে কিছু মিল থাকলেও বিস্তর পার্থক্য বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির এবং সেই পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলায় কথা বললেও ভাষারীতি এবং শব্দ চয়নে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। বহু ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস এমনকি পোশাক-আসাকও নির্ভর করে মানুষের ধর্ম বিশ্বাস এবং আঞ্চলিক, সাংস্কৃতিক বা স্থানিক অবস্থানের উপর। আবার একই জাতিগোষ্ঠীর একজন মানুষের জীবনসংগ্রাম, যাপন প্রক্রিয়ার ধারাক্রমে ইতিহাসবোধ, মনন ও চেতনার মধ্যে পার্থক্য হয়ে থাকে। দৈনন্দিনতার সঙ্গে যুক্ত সকল বোধ বিশ্বাস ছায়া ফেলে ব্যক্তিজীবনে। অলক্ষে এসবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানুষটির মানসজগতের বিভিন্ন পর্যায়। পার্থক্য দেখা দেয় তাদের রুচি, মেজাজ ও মানসিকতার মধ্যেও।
যেহেতু সাহিত্য সমাজেরই দর্পণ, সেহেতু তাতে খুঁটিনাটি দিকগুলো উপস্থাপিত হওয়া আবশ্যক। বিশেষত, কথাসাহিত্যে, গদ্যসাহিত্যে মানুষের যাপন-প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটিও ধরা পড়ে। এতদিনকার বাংলা সাহিত্য-পাঠে দেখা যাবে বাঙালির মনন বাঙালির চেতন বাঙালির জীবন-যাপন সর্বাঙ্গীনভাবে বাংলা ছোটগল্পে যতটা প্রকাশিত হয়েছে ততটা সাহিত্যের অন্য কোনও শাখায় হয়নি। এখানে আর একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে- ছোটগল্পে প্রতিফলিত এই যাপনচিত্রকে যদি ধর্মীয় আধারে চিহ্নিত করা যায় তবে দেখা যাবে হিন্দুজীবন, হিন্দুমননই অধিকমাত্রায় প্রকাশিত। তবে এই সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের রচনার প্রেক্ষিতে। বাংলাদেশের লেখকদের রচনায় স্বভাবতই মুসলিম-জীবন মুসলিম-মানস গুরুত্ব পেয়েছে। ‘মুসলমান’ শব্দটি শুধু ধর্মীয় পরিচয়ে নিঃশেষ নয়, সংস্কৃতিরও একটা অঙ্গ ও প্রেরণা (অরুণ সেন, ‘মুসলমান বাঙালির কণ্ঠস্বর’, ‘কোরক’, বইমেলা ২০১১, পৃ-১৯)।
এই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ধরতে গেলে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করা ছাড়া অন্য পথ নেই। তুলনা ও পর্যালোচনা আসলে মূলে পৌঁছার একটি পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া। যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে একটি অখণ্ড বাঙালির সামগ্রিক রূপ-চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করা সম্ভব সাহিত্যের কাঠামোতে। আর তখনই বিষয়টি শুদ্ধতর অর্থে পরিপূর্ণ বিবেচনায় ‘বাঙালির’ হয়ে উঠবে। তা না হলে সেটা হবে বাংলাদেশের বা পশ্চিমবঙ্গের, সমগ্র বাঙালির নয়। অরুণাভ সিংহ সম্পাদিত ‘দ্য পেঙ্গুইন বুক অব বেঙ্গলি শর্ট স্টোরিজ়’ যতটুকু না বাঙালির, তারচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গের। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে পুরো বাঙালির প্রতিনিধিত্বশীল ছোটগল্প সঙ্কলনের জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, কোনও সম্পাদিত সঙ্কলনই সর্বসম্মত হয় না, হতে পারে না। কিছু না কিছু খুঁত ও বিচ্চুতি থেকেই যায়। একজন সম্পাদক একদিকে দেখেন তো আরেক দিকে শৈথিল্য প্রদর্শন করেন। অতএব, পুরো বাঙালির প্রতিনিধিত্বশীল ছোটগল্প সঙ্কলনের জন্য অন্য কোনও সম্পাদককে এগিয়ে আসতে হবে।
এইতো শীতের শুরু
রিক্ত, নিঃস্ব, আর হাহাকারে ভরা ।
চারদিকে স্তব্ধতা,
রুক্ষ পাতা ঝরা দিনের এইতো শুরু !
বড্ড ক্লান্ত দুপুর, শেষ বিকেলের হতাশা ।
বিষন্ন চারদিক, কোথায় যেন শূন্যতা !!
ঝড়া পাতার মতো দুঃখগুলোও
যদি ঝরে পড়তো এভাবে !
হাহাকার ,নিস্তব্ধতা, ধূ ধূ প্রান্তর
আর ঝরা পাতাগুলো যেন
জানিয়ে দেয় শীতের আগমনী বার্তা ।
হৃদয়ের খুব সূক্ষ্ম গহীনে
হু হু করে ওঠা বেদনার আর্তনাদ
প্রকৃতির সাথে মিলে হয় একাকার ।
মনে করিয়ে দেয় বারবার
এইতো শীতের শুরু !
যেথায় রিক্ত নিঃস্ব আর শুধু হাহাকার !!
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং।
রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) সম্মানজনক এ পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করেছে। তার দারুণ কাব্যময় গদ্যের জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যা ঐতিহাসিক ক্ষতগুলোকে সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরে এবং মানব জীবনের ভঙ্গুরতাকে প্রকাশ করে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক সাহিত্যিক হান কাং।
হান কাংয়ের প্রথম ইংরেজি উপন্যাস 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' সম্পর্কে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সমালোচক ড্যানিয়েল হ্যান মন্তব্য করেছেন, বইটির তিন খণ্ড জুড়ে সমাজের সবচেয়ে অপরিবর্তনশীল কয়েকটি কাঠামোর অসহনীয় চাপ পাঠকমনকে বিচলিত করে তোলে। এই উপাদানগুলো হল চাহিদা ও আচরণ এবং প্রতিষ্ঠানগত কর্মপদ্ধতি, যা একে একে ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়।
২০১৬ সালের আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার প্রাইজ পেয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার এই লেখক । উপন্যাস দ্য ভেজিটেরিয়ান'র জন্য তাকে এই পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়।
হান কাং ১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার শহর গোয়াংজুতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নয় বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে সিউলে চলে আসেন। হ্যান ক্যাং একটি সাহিত্যিক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। তার বাবা একজন স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। তিনি লেখার পাশাপাশি শিল্প ও সঙ্গীতেও নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, যা তার সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়।
বোধহয় বৈরি সময়ে উর্বর মস্তিষ্কে চিন্তারা বেশি করে ভিড় করে। মৌলিক প্রতিভা সে চিন্তাকে ঘনীভূত করে জমাট বাধায়, উপহার দেয় চিন্তা বা কল্পনা করতে না পারা মানুষদের জন্য অভিনব কিছু। সাহিত্যে কবিতার যে শক্তি তা কম কবির লেখনিতেই মূর্ত হয়েছে কালেভদ্রে। কিন্তু মানুষের মুক্তির আকাঙ্খাকে ধারণ করে যে শব্দের সমষ্টি অজস্র পীড়িতের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় সেই তো সার্থক কবিতা। আর তার নির্মাতাই হয়ে উঠেন সার্থক কবি।
কবিতার এই যে মানদণ্ড তাতে একজন হেলাল হাফিজ অনেক আগেই উত্তীর্ণ। ৭ অক্টোবর বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান এই কবির জন্মদিন। কিন্তু কি আশ্চর্য! দুঃখকে নিত্যসহচর করে বেঁচে থাকা অধিকাংশ কবিদের অমোঘ নিয়তি হেলাল হাফিজকেও ছাড়েনি। ১৯৪৮ সালে নেত্রকোণায় জন্ম নেওয়া কবিতার এই বরপুত্র নব্যঔপনিবেশিক শাসকদের রোষানল দেখেছেন। দেখেছেন মুক্তির আকাঙ্খায় উদ্ভাসিত বাঙালি জাতির ব্যগ্রতা।
যৌবনের উদ্দাম দিনে দ্রোহ ও প্রেম-দুই-ই পেয়ে বসেছিল হেলাল হাফিজকে। তাকে অবলম্বন করতেও ছাড়েননি তিনি! সহজ কথায় তিনি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন সবার কথাকে, তাইতো তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন তাঁর সমকালীনতাকে। অন্তত ৫ দশক ধরে বাংলা সাহিত্যে কবিতার এই বরপুত্র সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বার বার প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে এসেছেন। এই সময়েও তাঁর কবিতার ঐশ্বর্য ম্লান হয়নি এতটুকুও! এখানেই তাঁর সার্থকতা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলা সাহিত্যে অপেক্ষাকৃত এক বন্ধ্যা সময়েও মুগ্ধ পাঠকের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে হেলাল হাফিজের শব্দগাঁথা, যা তিনি জীবন অভিজ্ঞতা ও সঞ্চিত বিশ্বাসে ভর করে লিখেছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের তপ্ত আবহের মাঝে। ‘এখন যৌবন যার জুদ্ধে যখন তার শ্রেষ্ঠ সময়’-কবি হেলাল হাফিজের শক্তিশালী শব্দমালা এখনও পথে-প্রান্তরে দেয়ালে উৎকীর্ণ, হয়তবা এই পঙতির চিরকালীন আবেদনময়তার জন্যই।
‘যে জলে আগুন জলে’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে দ্রোহ ও প্রেমের যে আখ্যান কবি সৃষ্টি করেছেন তা কয়েক দশক পরে এখনও পাঠককে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে বললেও অত্যুক্তি হবে-বলা প্রয়োজন আন্দোলিত করে।
২০১৩ সালে সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কবিকে বাংলা একাডেমি পদকে ভূষিত করা হয়। ২০১৯ সালে কবি পাঠকদের উপহার দিয়েছেন ‘বেদনাকে বলেছি কোঁদো না’ কাব্যগ্রন্থ। সঙ্গীহীন ব্যক্তিগত জীবনে কল্পনালোকে ডুবে থাকতেই পছন্দ করেন কবি।
তবে ঘুমন্ত সমাজকে জাগিয়ে তুলতে যে প্রবল শক্তি নিয়ে একজন হেলাল হাফিজ আবির্ভূত হয়েছিলেন তার সামান্যই হয়ত নিতে পেরেছি আমরা। কবিতার শক্তি যে সত্যসুন্দরের আহ্বান নিয়তই জানিয়ে যায় এই সমাজ হয়ত তাকে সর্বাঙ্গীন স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নয়।
তা সত্ত্বেও সত্যসুন্দরের দীপশিখা জ্বেলে যান কবি হেলাল হাফিজ। শুভ জন্মদিন কবি।