শীতের ছড়া
আধুনিক বিপ্লবের প্রধান তাত্ত্বিক ভ্লাদিমির লেনিনের মতে পুরোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকে আছে পুঁজিবাদী শ্রেণি ও সরকারি আমলাদের ষড়যন্ত্রে। নিজেদের স্বার্থ জিইয়ে রাখতে এরা রাষ্ট্র নামক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে। আর এর ফলে নানাবিধ উপায়ে শোষণের শিকার হয় সাধারণ নাগরিক। সরকার ও সাধারণের মধ্যে বৈষম্যের দেয়াল তৈরি হয়। এতে সুবিধা ভোগ করে বিশেষশ্রেণি।
ক্ষমতাসীন মহল যখন পুরোনো কায়দায় দেশ শাসনে ব্যর্থ হয় এবং দেশের মানুষ সাবেকি কায়দা মেনে নিতে অস্বীকার করে, তখনই সৃষ্টি হয় বৈপ্লবিক পরিস্থিতি। প্রতিটি নাগরিক বিদ্রোহ, প্রতিটি গণ–আন্দোলন, প্রতিটি বিপ্লবের প্রধান কারণ বৈষম্য।
অতিসম্প্রতি গণ আন্দোলন দেখেছে বাংলাদেশ। ছাত্র-জনতার বিদ্রোহের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। দেশের দায়িত্ব নিয়েছে ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকার। তবে একদিনের আন্দোলন বা সংগ্রামে এ পরিবর্তন আসেনি।
কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে নিরীহ ছাত্র-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল এ অভ্যুত্থান। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে খড়গহস্ত হয়েছিল সরকার। দমন-পীড়ন আর প্রাণহানীর মধ্য দিয়ে এসেছে এ পটপরিবর্তন। শহর থেকে গ্রাম, সারাদেশে লেগেছিল রাজনীতির উত্তাল হাওয়া। সব-ই আমাদের জানা।
তবুও মানুষ তো বিস্মৃতিপরায়ণ, তাই ইতিহাস লিখে রাখতে হয়। নইলে নদীর মতো পলি জমে ইতিহাস চাপা পড়ে যায়। অতিরঞ্জন বা বিরোধীদের হস্তক্ষেপে-ও বিকৃত হতে পারে। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে সেই সময়কে মলাটবন্দি করেছেন লেখক ও সাংবাদিক মেসবাহ য়াযাদ।
পেশাগত কারণে এই আন্দোলনকে তিনি পাখির চোখে দেখেছেন। সশরীরে উপস্থিত ছিলেন রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া এলাকাগুলোতে। প্রতিবেদন সংগ্রহ করতে গিয়ে ঝুলিতে পুরেছেন সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভের কারণ। আর সেসবই লিখে রেখেছেন তিনি তার 'চব্বিশের বাংলাদেশ' গ্রন্থে।
কোটা আন্দোলনের প্রথমের দিনগুলো থেকে শুরু হয়েছে এই দিনলিপি। ১৪ই জুলাই থেকে ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত এর ব্যাপ্তিকাল। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন রোজকার রোজনামাচা। প্রসঙ্গত উঠে এসেছে বৃটিশ শাসনামল, ১৯৫২, ৬৯, ৭১, ৭৫, ৯০, ২০১৩, ২০১৮ সালের ঘটনাপ্রবাহ। শুধু আন্দোলন আর সরকার পরিবর্তন-ই নয়। অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়কার অরাজকতাও উঠে এসেছে এই বইয়ে। লিপিবদ্ধ আছে আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের গ্রেপ্তারজনিত তথ্য-ও।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সাম্প্রতিক সময়ে যে বৃহৎ ইতিহাসের স্বাক্ষী আমরা সকলেই সেই ইতিহাস কিনে পড়ার কী আছে? খুবই নিরীহ প্রশ্ন! উত্তরের প্রয়োজনে ফিরে যাই উপরে বলা কথাতেই, মানুষ বড়-ই বিস্মৃতিপরায়ণ। পাঁচ, দশ বা পনের বছর পর আজকের ইতিহাস আর এমন নির্ভেজাল থাকবে না। সেসময়ে পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক তথ্য জানাতে এই বইটি সংগ্রহে রাখা উচিৎ। সেই সাথে আন্দোলন চলাকালে নেটওয়ার্ক পরিষেবা বন্ধ থাকায় সব তথ্য সাধারণের জানার কথা নয়। রাজধানী ঢাকা থেকে অনেকদূরের জেলা বা মফস্বল শহরের মানুষের পক্ষে তাই সঠিক সংবাদ জানা সম্ভব-ও হয়নি। প্রকৃতঅর্থে কী ঘটেছিল তখন ঢাকায় জানতে হলে পড়া দরকার 'চব্বিশের বাংলাদেশ'।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়, বিশেষ করে ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকে কেন্দ্র করে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মলেনের পর— সবাই আ.লীগ, ছাত্রলীগ, জামায়াত, বিএনপি, মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার, কোটা, পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী, কারফিউর মধ্যেই ঘুরে ঘুরে পাক খেতে থাকে।
এসময়ের গল্পের পেছনের গল্প, মানুষের গল্প, অমানুষের গল্প, ক্ষমতার গল্প, অক্ষমতার গল্প, সাধারণের গল্প, অসাধারণের গল্প— একজন মাঠের সংবাদকর্মী হিসেবে অভিজ্ঞতার গল্পকে,সময়ের একটি প্রামান্য দলিল মলাটবন্দি করার প্রয়াসই এই গ্রন্থ।
এটি সময়ের একটি প্রামান্য দলিল।
'চব্বিশের বাংলাদেশ' প্রকাশ করেছে- সাহিত্যদেশ। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী বিপুল শাহ।
পাওয়া যাচ্ছে: পিবিএস বুকশপ, শান্তিনগর, ঢাকা, পলল প্রকাশনী, আজিজ মার্কেট, ঢাকা, বিশ্বরঙ, যমুনা ফিউচার পার্ক, ঢাকা।
অনলাইনে: রকমারি ডটকম, বইবাজার ডটকম, বইফেরী ডটকম, পিবিএস বুকশপ, রিডচেইন ডটকম, দূরবীন, বুক এক্সপ্রেস, বইপোকা, প্রথমা ডট কম, বইয়ের দুনিয়া ডটকম, বইসদাই ডটকম, বইপ্রহর, বাতিঘর ডটকম-এ।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকা ছয় মহাকাশচারীর কাটানো একটি দিনকে নিয়ে লেখা ‘অরবিটাল’ বইয়ের জন্য যুক্তরাজ্যের লেখক সামান্থা হার্ভে ২০২৪ সালের বুকার পুরস্কার জিতেছেন।
মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) বিচারক প্যানেলের চেয়ারপারসন এডমুন্ড ডে ওয়াল ঘোষণা করেন, বিচারকদের সর্বসম্মতিক্রমে হার্ভেকে বুকার পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
মহাকাশকেন্দ্রে ছয় নভোচারীর এক দিনের কাটানো জীবন নিয়ে লেখা ‘অরবিটাল’ উপন্যাসটিতে পৃথিবী থেকে মহাকাশকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে।
উপন্যাসটি’র কাহিনি অনুসারে, ছয় নভোচারীর মধ্যে দুজন পুরুষ ও চারজন নারী। তারা মহাকাশে একত্রিত হয়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন। এছাড়া আবহাওয়ার পরিবর্তন, সীমানা, টাইম জোনের জটিলতা এবং মহাকাশের সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করেন।
বিচারক এডমুন্ড ডে ওয়াল উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেন, অরবিটাল উপন্যাসটি একটি ক্ষতবিক্ষত পৃথিবীর গল্প। যেখানে মহাকাশচারীরা পৃথিবীর পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির প্রতি গভীর মনোযোগ দেয়। নিজেদের পৃথিবী থেকে অনেক দূরে, তাদের অস্তিত্বকে নতুনভাবে উপলব্ধি করেন।
এডমুন্ড ডে ওয়াল বলেন, উপন্যাসে প্রত্যেকেই একটি বিষয়বস্তু আবার কেউই বিষয়বস্তু নয়।
পুরস্কার পাওয়ার পর এক বক্তব্যে সামান্থা হার্ভে বলেন, যেসব মানুষ পৃথিবীর পক্ষে কথা বলে, অন্য মানুষের মর্যাদা, অন্য প্রাণের পক্ষে কথা বলেন এবং যেসব মানুষ শান্তি প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার থাকেন ও কাজ করেন, তাদের সবার জন্য তিনি পুরস্কারের ৫০ হাজার পাউন্ড অর্থ উৎসর্গ করছেন।
‘অরবিটাল’ বইটি ১৩৬ পৃষ্ঠার। এটি বুকারজয়ী দ্বিতীয় সংক্ষিপ্ততম বই। এছাড়া এটি মহাকাশ নিয়ে লেখা প্রথম কোনো বই, যেটি বুকার পুরস্কার জিতেছে।
চলতি বছর বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় হার্ভে ছাড়া আরও চারজনের নাম ছিল। এর মধ্যে মার্কিন লেখক র্যাচেল কুশনার (‘ক্রিয়েশন লেক’ বইয়ের জন্য) এবং কানাডীয় লেখক অ্যান মাইকেলসও (‘হেল্ড’ বইয়ের জন্য) ছিলেন।
নামজাদা প্রকাশক পেঙ্গুইন বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য সুপরিচিত। এই সংস্থার আগ্রহ সামাজিক বা মানবিক বিদ্যার বিভিন্ন শাখার চেয়ে সাহিত্যের প্রতি সর্বাধিক। ‘পেঙ্গুইন ক্লাসিকস’ নামের সিরিজ প্রকাশনায় গল্প, কবিতা, উপন্যাস স্থান পায়। এই সিরিজ থেকে সদ্য প্রকাশ পেয়েছে অরুণাভ সিংহ সম্পাদিত ‘দ্য পেঙ্গুইন বুক অব বেঙ্গলি শর্ট স্টোরিজ়’। এতে সাঁইত্রিশটি গল্প রয়েছে, যার মধ্যে বত্রিশটিই সম্পাদক অরুণাভ সিংহের নিজের অনুবাদ।
সঙ্কলনটিতে লেখক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্পাদক কী রীতি অবলম্বন করেছেন তা উল্লেখ করেননি। গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কোন নীতি অবলম্বন করেছেন, জানাননি। তবে এ কথা বলেছেন যে, তার ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভর করে সঙ্কলনটি তৈরি। তিনি গল্পকার নির্বাচনে বিশেষ নতুন কিছু খোঁজার চেষ্টা করেননি।
শুরুতে সম্পাদক অরুণাভ সিংহ একটি সংক্ষিপ্ত হলেও তথ্যসমৃদ্ধ ভূমিকায় উনিশ শতকের সামাজিক আন্দোলন, বিশ শতকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, গান্ধীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন, সশস্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন, মার্ক্সবাদী সাহিত্যের প্রসার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও দেশভাগের প্রসঙ্গ অল্প কথায় আলোচনা করেছেন। এই সব ঘটনার কারণে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংসারের অনেক কিছুই আমূল পরিবর্তিত হয়েছিল। দেশভাগের কারণে বাঙালির রাজনৈতিক মানচিত্রই বদলে ছিন্নমূল মানুষের স্রোত বন্যার মতো ধেয়ে আসে দুই খণ্ডে। এই সঙ্কলনে দেশভাগ-পরবর্তী ওপার-বাংলার গল্পকে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন এবং সত্তর দশকের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার প্রসঙ্গ আছে। রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের কথাও।
বর্তমান সঙ্কলনটি কোনও বিশেষ সময়পর্বের গল্প নিয়ে নয়, বিশেষ কোনও গল্প আন্দোলন ঘিরেও নয়। এটি এ-যাবৎ প্রকাশিত বাংলা গল্পের মধ্য থেকে নির্বাচিত এক সঙ্কলন। প্রতিটি সঙ্কলনেরই কিছু ভালো ও মন্দ দিক থাকে। থাকে কিছু সীমাবদ্ধতা। যদিও সঙ্কলনটির আলোচনায় (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ অক্টোবর ২০২৪) রামকুমার মুখোপাধ্যায় শিরোনাম দিয়েছেন ‘বাঙালির রূপান্তরিত মনের কথা’, তথাপি তা সমগ্র বাঙালির ‘মনের কথা’ নয়। সম্পাদকের অবস্থানগত কারণে তিনি পশ্চিমবঙ্গের গল্পগুলোর প্রতি যতটুকু মনোযোগী হতে পেরেছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ততটুকু নন। এ কারণেই প্রশ্ন উঠে, কেন বাংলাদেশের বিষয় পশ্চিমবঙ্গে এবং পশ্চিমবঙ্গের বিষয় বাংলাদেশে উপেক্ষিত (দ্রষ্টব্য: অমিতাভ ভট্টশালী, বিবিসি বাংলা, কলকাতা, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেন পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে-সিনেমায় উপেক্ষিত’)।
শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে-পূর্ববঙ্গে ব্যবধান, ঘটিতে-বাঙ্গালে দ্বন্দ্ব, অবস্থানগত কারণে পূর্বের ব্যাপারে পশ্চিমের উন্নাসিকতা, এসব অবশ্য পুরানো ইতিহাস, তবে সাতচল্লিশ এসে সেই পার্থক্যটাকে আরও গভীর ও অনতিক্রম্য করে দিয়েছিল।’ অশোক মিত্র, একসময়ে যিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী শাসনামলে দীর্ঘকাল অত্যন্ত সফল অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন; তিনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন, 'একজন দু'জন পণ্ডিতপ্রবর এমনও দাবী করেছেন, প্রেসিডেন্সি কলেজই বাংলা, বাংলাই প্রেসিডেন্সি কলেজ। ইত্যকার দাবি আসলে একধরনের কূপমণ্ডূকতা, পৃথিবীকে জানবার চেনবার বোঝবার জন্মগত অক্ষমতা। মাত্র ক'দিন আগে এক বাংলা দৈনিকের রবিবাসরীয় বিভাগে 'মানুষ গড়বার কারিগর' শিরোনামে এক মস্ত প্রবন্ধ ফাঁদা হয়েছিল। শিক্ষকদের তালিকায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রায় অনুল্লেখিত, অনুচ্চারিত অমিয় দাশগুপ্ত মশাইয়ের নামও। (অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক হিসেবে অসাধারণ ছিলেন অমিয় দাশগুপ্তও। প্রফেসর দাসগুপ্ত এক সময়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যান। শেষ জীবনটা তার কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তাকে চিনতে চায় নি, উপেক্ষাই করেছে।)
সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রায় পঁচিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন; তার বৈজ্ঞানিক প্রতিভার স্ফূরণ ও বিকিরণ ঢাকাতেই। ১৯৪৫ সালের পরে অবশ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছিলেন বছর পাঁচ-ছয়ের জন্য, তারপর শান্তিনিকেতনে, জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে বৃত হওয়া, রাজ্যসভার সদস্য হওয়া। কিন্তু হলে কী হয়, সেই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে একবার জাত খুইয়েছিলেন, তা আর পুনর্জয় করতে পারলেন না। কলকাতার বিজ্ঞজনের কাছে তাঁর স্থান মেঘনাদ সাহার অনেকটাই নীচে।' (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, নভেম্বর ৭, ২০২২, ‘সাতচল্লিশ পশ্চিমবঙ্গ-পূর্ববঙ্গ পার্থক্যটাকে অনতিক্রম্য করে দিয়েছিল‘, ডেইলি স্টার বাংলা)।
সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তার মধ্যে ধর্ম, অঞ্চল, রাজনীতি ও জাতীয়তার ভিত্তিতে নানা বৃত্তে পৃথক করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সামাজিক উৎসব আচার-অনুষ্ঠান রীতিনীতির মধ্যে কিছু মিল থাকলেও বিস্তর পার্থক্য বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির এবং সেই পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলায় কথা বললেও ভাষারীতি এবং শব্দ চয়নে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। বহু ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস এমনকি পোশাক-আসাকও নির্ভর করে মানুষের ধর্ম বিশ্বাস এবং আঞ্চলিক, সাংস্কৃতিক বা স্থানিক অবস্থানের উপর। আবার একই জাতিগোষ্ঠীর একজন মানুষের জীবনসংগ্রাম, যাপন প্রক্রিয়ার ধারাক্রমে ইতিহাসবোধ, মনন ও চেতনার মধ্যে পার্থক্য হয়ে থাকে। দৈনন্দিনতার সঙ্গে যুক্ত সকল বোধ বিশ্বাস ছায়া ফেলে ব্যক্তিজীবনে। অলক্ষে এসবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানুষটির মানসজগতের বিভিন্ন পর্যায়। পার্থক্য দেখা দেয় তাদের রুচি, মেজাজ ও মানসিকতার মধ্যেও।
যেহেতু সাহিত্য সমাজেরই দর্পণ, সেহেতু তাতে খুঁটিনাটি দিকগুলো উপস্থাপিত হওয়া আবশ্যক। বিশেষত, কথাসাহিত্যে, গদ্যসাহিত্যে মানুষের যাপন-প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটিও ধরা পড়ে। এতদিনকার বাংলা সাহিত্য-পাঠে দেখা যাবে বাঙালির মনন বাঙালির চেতন বাঙালির জীবন-যাপন সর্বাঙ্গীনভাবে বাংলা ছোটগল্পে যতটা প্রকাশিত হয়েছে ততটা সাহিত্যের অন্য কোনও শাখায় হয়নি। এখানে আর একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে- ছোটগল্পে প্রতিফলিত এই যাপনচিত্রকে যদি ধর্মীয় আধারে চিহ্নিত করা যায় তবে দেখা যাবে হিন্দুজীবন, হিন্দুমননই অধিকমাত্রায় প্রকাশিত। তবে এই সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের রচনার প্রেক্ষিতে। বাংলাদেশের লেখকদের রচনায় স্বভাবতই মুসলিম-জীবন মুসলিম-মানস গুরুত্ব পেয়েছে। ‘মুসলমান’ শব্দটি শুধু ধর্মীয় পরিচয়ে নিঃশেষ নয়, সংস্কৃতিরও একটা অঙ্গ ও প্রেরণা (অরুণ সেন, ‘মুসলমান বাঙালির কণ্ঠস্বর’, ‘কোরক’, বইমেলা ২০১১, পৃ-১৯)।
এই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ধরতে গেলে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করা ছাড়া অন্য পথ নেই। তুলনা ও পর্যালোচনা আসলে মূলে পৌঁছার একটি পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া। যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে একটি অখণ্ড বাঙালির সামগ্রিক রূপ-চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করা সম্ভব সাহিত্যের কাঠামোতে। আর তখনই বিষয়টি শুদ্ধতর অর্থে পরিপূর্ণ বিবেচনায় ‘বাঙালির’ হয়ে উঠবে। তা না হলে সেটা হবে বাংলাদেশের বা পশ্চিমবঙ্গের, সমগ্র বাঙালির নয়। অরুণাভ সিংহ সম্পাদিত ‘দ্য পেঙ্গুইন বুক অব বেঙ্গলি শর্ট স্টোরিজ়’ যতটুকু না বাঙালির, তারচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গের। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে পুরো বাঙালির প্রতিনিধিত্বশীল ছোটগল্প সঙ্কলনের জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, কোনও সম্পাদিত সঙ্কলনই সর্বসম্মত হয় না, হতে পারে না। কিছু না কিছু খুঁত ও বিচ্চুতি থেকেই যায়। একজন সম্পাদক একদিকে দেখেন তো আরেক দিকে শৈথিল্য প্রদর্শন করেন। অতএব, পুরো বাঙালির প্রতিনিধিত্বশীল ছোটগল্প সঙ্কলনের জন্য অন্য কোনও সম্পাদককে এগিয়ে আসতে হবে।
এইতো শীতের শুরু
রিক্ত, নিঃস্ব, আর হাহাকারে ভরা ।
চারদিকে স্তব্ধতা,
রুক্ষ পাতা ঝরা দিনের এইতো শুরু !
বড্ড ক্লান্ত দুপুর, শেষ বিকেলের হতাশা ।
বিষন্ন চারদিক, কোথায় যেন শূন্যতা !!
ঝড়া পাতার মতো দুঃখগুলোও
যদি ঝরে পড়তো এভাবে !
হাহাকার ,নিস্তব্ধতা, ধূ ধূ প্রান্তর
আর ঝরা পাতাগুলো যেন
জানিয়ে দেয় শীতের আগমনী বার্তা ।
হৃদয়ের খুব সূক্ষ্ম গহীনে
হু হু করে ওঠা বেদনার আর্তনাদ
প্রকৃতির সাথে মিলে হয় একাকার ।
মনে করিয়ে দেয় বারবার
এইতো শীতের শুরু !
যেথায় রিক্ত নিঃস্ব আর শুধু হাহাকার !!