মনের ঘূর্ণি থেকে
ক্যানভাস থেকে ভেসে আসা আলো
লোকটা সত্যি উন্মাদ। আশেপাশের ছেলেদের উস্কানি দেন যাতে তারা মহিলাদের ছোঁওয়ার চেষ্টা করে, বিরক্ত করে। সবাই চাইছে লোকটাকে কোথাও আটকে রাখা হোক।—কার সম্পর্কে বলা হচ্ছে এমন কথা? বলা হচ্ছে বরিনেজের এক ধর্ম-প্রচারক ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ সম্পর্কে। ঠিক ধরেছেন ইনিই সেই পৃথিবীবিখ্যাত শিল্পী যার ছবির দিকে মানুষ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে। শিল্প ও শিল্পী এর মধ্যস্থ যে সেতু, সেই সেতু জটিলভাবে শক্তিশালী, তার মধ্যস্থ মর্মার্থ স্বয়ং শিল্পীও নির্ধারণ করতে পারে না। ঐ জটিলতার কোনো এক স্ফুরণ কি আত্মহত্যার চেষ্টা?
হতেও পারে নাও হতে পারে। মাত্র ৪৬ বছরে আত্মহত্যা করেছিলেন যে কবি অ্যান সেক্সটন তিনি নিজেই তো বলেছিলেন, “যদিও প্রায়শই আমি ক্ষ্যাপামি করি, আমি যে ক্ষ্যাপাটে তাও আমি জানি তারপরেও ওর বিরুদ্ধে লড়ে যাই—কারণ এর থেকে কিছু জন্মায় না এবং তুমি মাঝখান থেকে এর ভেতরে শামুকের মতো বেড়ে উঠতে থাকো।” ১৮৯০ সালের ভ্যান গঘের সেই বিখ্যাত পেন্টিং “WHEAT FIELD WITH CROWS” (Oil on canvas) যা কিনা জুলাই মাসেই আঁকা আর সেই মাসের ২৯ তারিখেই সেই ছবির প্রসঙ্গ সরাসরি যেন ফিরে আসে। একেই কি বলে শিল্পের নিজস্ব অলৌকিকতা যার বিবরণে মাহাত্ম্য কখনো নির্ধারণ করা যায় না!
দিনটি ছিল রবিবার, ভিনসেন্ট রাত ন’টায় যন্ত্রণায় কুঁকড়ে হাঁটতে হাঁটতে উঠে গিয়েছিলেন নিজের বিছানায়। তার বুকে ছিল একটি গুলির ক্ষত। ভিনসেন্ট সেদিন গম খেতের দিকেই গিয়েছিলেন, যে ছবি তিনি আগেই এঁকেছিলেন। দুপুরের দিকে নিজেকে গুলি করার চেষ্টা করেন বুকের কাছে, তারপর ফিরে এসে দুদিন বেঁচে ছিলেন। এমনটাই জানিয়েছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী রাভো কন্যা আদেলিন। আর্থার গুস্তাভ রাভোর কাছেই শেষজীবনে থেকেছিলেন ভ্যান গঘ। অনেকে বলেন তার অসংলগ্ন ব্যবহারের কারণে তাকে অন্য কেউও গুলি করতে পারে কিন্তু গম খেতের ঐ ছবিটি? শিল্পীর অন্তরাত্মা প্রহেলিকায় পূর্ণ, তাকে জানা অতো সহজ নয়। এই ছেলেটি কিশোর বয়সে লাঠি দিয়ে নিজেকেই মারত যদি তার মনে হতো সে কোনো ভুল চিন্তা করেছে। এই মানুষটিই শুঁয়োপোকাকে গাছে তুলে রেখে আসতেন। আন্তন কারসেমেকার্স (ভ্যান গঘের পরিচিত) জানাচ্ছেন অপূর্ব দৃশ্যের দিকে হাত দুটো ফ্রেমের মতো করে দাঁড়িয়েছেন ভ্যান গঘ। অস্থিরতায় আপ্লুত ছিলেন যেন এখুনি এই দৃশ্যটি চলে যাবে!
কেউ জানাচ্ছেন সে বিপজ্জনক, তাকে মানসিক হাসপাতালে দেওয়া হোক। কেউ বলছেন ছেলেটি সকালে উঠে দুটি রুটি খায় আর এক পেয়ালা কালো চা, সারাক্ষণ শুধু আঁকা আর আঁকা। কেউ দেখছেন, টেবিলভর্তি খাবার তবু তিনি খাচ্ছেন ঐ নিয়মিত খাদ্যাভাসের রুটি আর পনির কারণ তিনি নিজেকে অধিক লাই দিতে চান না। কেউ বলছেন তার ছবি অপূর্ব, তিনি সন্দেহ প্রকাশ করছেন তার সম্পর্কে প্রশংসা শুনে, কারণ তিনি এও জানেন তার ছবি তার সমসাময়িক অনুভব করতে পারবে না। রাস্তার সেই পাশ দিয়ে তিনি হাঁটছেন যে পাশটা অমসৃণ কারণ তিনি বলছেন, “জীবনে মসৃণ পথ বেছে না নেওয়াই ভালো।” বিলাসিতা বলতে ধূমপান, ওটুকুই। গায়ে পুরনো পোশাক, ময়লা টুপি।
ধর্মপ্রচারক থাকাকালীন যেটুকু বাড়তি সুযোগ সুবিধা পেতেন সব গরীব মানুষদের দান করেছিলেন। রং তাকে পাগল করে দিত। তার ঈশ্বর ছিলেন শিল্পী EUGENE DELACROIX। বালজাক(BALZAC) ছিলেন তার প্রিয় লেখক। নিজের ছবি অনেকসময় খুব অল্প দামে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে গ্রহণ করছেন এরকম ক্রেতাকে বিক্রি করে সেই দিয়ে নিজের প্রিয় গল্পের বই কিনেছেন। প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট জায়গা তার সময়ে তাকে ছবির ধর্ষকও বলেছেন। কিছু আসে যায়নি তার! একাত্ম, গভীর মননে ঋদ্ধ একাগ্রচিত্রে শুধু সাধনা করেন ছবির। ছবিকে তিনি কত বুঝতেন, কিভাবে বুঝতেন তার বহু পরে দর্শক বুঝেছেন। তার জীবনে তিনি কিছু পাননি, আশাও করেননি তিনি। তিনি নিজেও বুঝেছেন, যুগকেও সম্যক উপলব্ধি করিয়েছেন “সৃষ্টি” শুরু ও শেষ ও মধ্যের মূল ও চূড়ান্ত মর্ম।
কেন এই নিঃসঙ্গতা তার আজীবনের সঙ্গী হয়েছিল, কেন ঐ রকম মৃত্যুকে বেছে নিয়েছলেন তিনি! তার মর্ম বোঝার আগে তার ছবির গভীরে যেতে হবে আর সেটা মনে হয় সবচেয়ে কঠিন কাজ। কেবল দৃশ্য তার বন্ধু ছিল, এই দৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিত শুধু তার মর্মে ছিল। যত তার পরিচিত, পরিজন, বন্ধুদের কথায় তাকে জানা যায় তার মধ্যে কোথাও তাকে একবিন্দু ছবির প্রসঙ্গ ছাড়া পাওয়া যায় না। তার মৃত্যুও তারই নির্ধারিত যেন। বুকের শেষ যন্ত্রণা নিয়েও পাইপ টেনেছিলেন সুখে, সুখের ধোঁয়া—যে সুখের পথকে সুখ মনেই করেননি তিনি। শুধু রং, তুলি, ড্রয়িং বোর্ড, পেন্সিল এরাই তো বুঝেছিল কে তাদের ওপরে জীবনের সবরকমের মাত্রাকে বুলিয়ে নিচ্ছে। তাই বোধহয় তথাকথিত মানুষের সঙ্গেও তার বাক্যালাপের মুহূর্তরাও গোনা গুণতি। তিনি তো ক্যানভাসের ছিলেন কেবল। তাই অজস্র ছবির মতো ঐ গমখেতের আঁকা ছবির মধ্যেই যেন মিশে গেছিল তার মৃত্যুর নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও গরিমা।