মনের ঘূর্ণি থেকে
রণজিৎ দাশের কবিতা
প্রান্তিকতাকে পেরিয়ে কবিতার মুহূর্তের মধ্যে ঢুকে গেলে, হাঁটা শুরু করলে যে সমস্ত আক্রমণ পুরো গ্রাস করে নেয় সেখানে নতজানু হতে হয়, আসলে সচেতন মানুষের মানবিক স্তর অতিক্রম করেই সে আক্রান্ত হয়, সচেতন পরাবর্তের ওপরে যখন সে চলে যায় তার আর ব্যবচ্ছেদ হয় না। ব্যক্তিসাপেক্ষ অনুভূতিকে ধরেই ভীষণভাবে ভালোলাগার কবি রণজিৎ দাশের কবিতা প্রসঙ্গে আসব। কবি রণজিৎ দাশ প্রসঙ্গে শ্রদ্ধাবনত বা বিনীত হওয়ার প্রাকমুহূর্তে যেটা সত্য তা হলো, তিনি আমার কাছে এমন একজন কবি, যার কবিতা বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে উঠে বসতে হয়! কবিতা এসে বলে আমার ভেতরে ঢোকো, আমি তোমাদের সংলগ্ন যাপনের শিকড় বুনে দিচ্ছি, আরো ভেতরে ঢোকো, পাখির একনেত্র দৃষ্টির মতো কবিতার ভেতর দিয়ে নিজেকে ভক্ষণ করিয়ে নিতে পারি, তাঁর কবিতা আমার কাছে এভাবেই প্রতিভাত হয়।
কবিতা তার আকাঙ্ক্ষায় সেই মনোযোগকে ভেতরে নিয়ে নেয়। সবচেয়ে বেশি তাঁর কবিতার যে অভিব্যক্তি শরীরে, মনে জার্ক দেয় তা হলো দৃঢ়তা, যে চয়ন বিহ্বল করে তোলে সেই যেন বিহ্বলতাকে থাপ্পড় মেরে সোজা তাকাতে সাহায্য করে। অভয়ারণ্যের ঠিক কোর এরিয়া যেখানে নিষেধ ও আকর্ষণ একমাত্রিক সেখানেই যেন সমস্ত ভ্রমণ বিলাসিতা সত্যের মুখে এসে চেতন থেকে অবচেতন সমস্ত অন্ধকারকে নাড়িয়ে দেয়।
কবি বলছেন, “মানুষ দুর্বোধ্য প্রাণী। কখনো সাপের মুখে/ কখনো ব্যাঙের মুখে চুমু খায়; বেহালা বাজায়।/ —কবিতা দুর্বোধ্য হলে তবু সে কেন যে ক্ষেপে যায়!” (মানুষ দুর্বোধ্য প্রাণী, কাব্যগ্রন্থঃ সমুদ্র সংলাপ)
হ্যাঁ এটি সেই সত্যিকারে জার্ক বা ঝাঁকুনি। ঝাঁকুনির আগে ও পরে মনে হতে পারে দর্শন, দ্রষ্টার ভাব ও গতি, অনুকূলে-প্রতিকূলে ক্রিয়াশীলভাবে বদলায় কিন্তু দৃঢ়তার যদি নিজস্ব নাবিক ভঙ্গিমা থাকে তার দিক তার কাঠামোকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। তাৎক্ষণিকের দর্শন সর্বজনীনের মতো সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। একটি জীবন একটি জোর প্রত্যাশা করে—দর্শনও বদলায় কিন্তু জোর প্রান্তিকতাকেও যুগপোযোগীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
“আমাদের শরীরে প্রতিটি ফুটোয়/ জেগে আছে ঈশ্বরের চোখ/ ভিতরে চক্রান্ত, চাঁদ, নিহত বন্ধুর রক্ত, ক্রিমি, কীট, উলঙ্গ রাক্ষস/ ভিতরে মুখোশ, জুয়া, নাচ, মদ, বেশ্যাদের হাসি/ তিনি দেখছেন, ঠিক যেভাবে বালক তার/ পিতৃঘাতকের সঙ্গে নিজের মায়ের/ অবৈধ সঙ্গমদৃশ্য দেখে” (ঈশ্বরের চোখ, কাব্যগ্রন্থঃ ঈশ্বরের চোখ)
কীর্ণধর্ম থেকে প্রেক্ষকের দৃষ্টি, সমস্ত সমাজ বৈষম্যতে একক ধ্রুবকে বসে আছেন ঈশ্বর অপারগ হয়ে, তেমনি সে নিরুপায় বালক তার মায়ের সঙ্গে পিতৃঘাতকের সঙ্গম দৃশ্য দেখছে—এ এক সহ্যাতীত সহ্যের ইতিহাস, সম্মোহনের বাস্তবতাকে চেপে ধরে ছিবড়ে করা। কবির অনুভব বিন্দুর আতিথেয়তা ধরে সম্মোহনকে অতিক্রম করে, কবি জীবনগ্রাহী হয়ে পাঠকের একান্ত হয়ে ওঠেন। একদিকে জল ফুঁসে ওঠে বলে, সে ভাসিয়ে দিতে চাইলে তাকে রহিত করি, অন্যদিকে জল খরা দিলে তাকে আদর আলিঙ্গনে ডাকি। অতএব জলের কোনো ধর্ম থাকলেও, ব্যবহারকারীর আতিশয্যে তার ধর্ম নিরূপিত হতে থাকে, এখানেও সেই দৃঢ়তার অভিমুখ ধরে ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠি।
পিয়ানো কবিতার প্রথম লাইনে কবি বলছেন—
“তোমার শরীর, আমি জানি,এক গভীর পিয়ানো”
শেষ লাইনে কবি বলছেন
“তোমার শরীর, আমি জানি, এক বিলুপ্ত পিয়ানো”
যেখানে নশ্বরকে বিলীন হতে দেখলেন, জানলেন নশ্বর তবু হাতড়ালেন অত্যাশ্চর্যের জন্য, চমকের জন্য, অথচ নশ্বর—এর স্থিতিস্থাপকতায় দাঁড়িয়ে কবি বললেন, “অন্ধঘড়িনির্মাতার ভাই আমি, তুমি কি তা জানো?” কবি/ দ্রষ্টা/ প্রেক্ষক দেখলেন ভঙ্গুর বাস্তব, ফুটিয়ে তুললেন চিত্রবিচিত্রতার দৃঢ়তায়। কবি আবার ‘ইচ্ছা’ কবিতায় বলছেন রাত্রিদিন চুমু খাব, বুকে জাপটে, মুখ থেকে মুখে/ ভরে দেবো অক্সিজেন, মধু, মদ, সিংহীর কামনা/ আমার কঙ্কালটিকে দুহাতে জড়িয়ে রেখে,/ তুমি থাকবে অনন্ত যৌবনা!
প্রেম এইখানে সর্বকালীন মুহূর্তজয়ী হতে চাইছে অর্থাৎ জীবন তার ইচ্ছা ও মুহূর্তমাফিক এক তাৎক্ষণিকের অভিঘাত সহ্য করে বড় হতে থাকে।
‘সামুদ্রিক পরামর্শ’ কবিতায় কবি বলছেন, “সমুদ্রে যেও না তুমি, যদি না সঙ্গে থাকে/ কোনো শক্ত সমর্থ যুবতী”। উপরিউক্ত একই কবিতায় কবি আবার বলছেন, “সমুদ্রে যেও না তুমি, সঙ্গে নিয়ে/ কোনো শক্ত-সমর্থ যুবতী”। আবার শেষে, “তবুও সমুদ্রে যেও, সঙ্গে নিয়ে একটি শক্ত-সমর্থ যুবতী/ সন্ধ্যাবেলা চাঁদ উঠলে বিনীত প্রস্তাব দিও, পেয়ে যাবে/ চুম্বন, সম্মতি!”
কাউন্টার স্ট্রেনের মতো ক্রিসক্রস খেলছে সময় তাঁর কবিতায় অথচ জীবনের গঠন তাই দাবি করছে এইভাবে ক্রমশ কবিতা এত দৃঢ় হচ্ছে যে সে পাঠকের স্থিতিহীন সময় আয়নার সামনে প্রগাঢ় হয়ে উঠছে, তাকিয়ে দেখছে এই তো আমি, আমিই আমার অর্ন্তযামী! এখানে প্রতি সময়, যাপনের নিয়মাবলী, উপাদান, সারবত্তা, প্রেম ও যা কিছু মুখর ও অনুভূতিশীল তারা সূত্র প্রতিষ্ঠা করে, সমস্ত সূত্রের মতোই সূত্র সূত্রকে ভাঙ্গে—কবি এই সময়ের মূর্ছনাকে দক্ষভাবে তুলে ধরেছেন, আমার কাছে কবি রণজিৎ দাশের কবিতা চূড়ান্ত ব্যাপ্তিময় অথচ তাঁর কবিতার কাঠামো একটি যারপরনাই সংসক্তি ও আসঞ্জনের পূর্ণ গঠনে গঠিত।
ক্রোমোজোম থেকে প্রাণবিন্দু, রস থেকে রসাতল সব কিছুর মধ্যে লুকিয়ে আছে ক্রিসক্রস, এই ক্রিসক্রস না থাকলে জীবনের অতৃপ্তি হারিয়ে যায়, আর জীবন শেষ হতে থাকে, পাওয়া আর না পাওয়া, বোঝা আর না বোঝা, ত্বরণ ও মন্দন মিলনকে, সম্পর্ককে, প্রাপ্তিকে ত্বরান্বিত করে—এই অনুভবের দৃঢ়তা থেকে কবি রণজিৎ দাশ।
“দেখেছি শিল্পের ভিক্ষা, ফুটপাতে, গুমোট সন্ধ্যায়/ রঙিন খড়িতে আঁকা কালীর বিশাল স্তনে ছড়ানো মুদ্রায়।/ দেখেছি সে শিল্পীকেও, উদাসী, ভ্রূক্ষেপহীন,হাতে নীল চক/ পথের কুকুর আর আকাশের সন্ধ্যাতারা—এই তার নীরব দর্শক।” (ভিক্ষা,কাব্যগ্রন্থঃ ঈশ্বরের চোখ)
প্রতিটি ভিক্ষার মধ্যে লুকিয়ে থাকে চরম ব্যর্থতার হাসাহাসি। একটা দীর্ঘ না পাওয়া ক্ষুদ্র পাওয়ার দিকে যেন সর্বস্ব দিয়ে ডাকতে চায়, শ্রোতারা বেশিরভাগ বধির, যারা প্রকৃত শ্রোতা তারা অপারগ, দু-একটা ব্যতিক্রমের আশায় ভিক্ষা/ শিল্প চলতেই থাকে—উপরিউক্ত কবিতাটির প্রতিটা সংশ্লেষ যেন গলায় আটকে থাকা যন্ত্রণার দৃঢ়তাকে বোঝায়, একটি মুহূর্তজয়ী মুহূর্ত থেকে অনন্তের দিকে ধাবিত হচ্ছে কবির বার্তা। কবি লিখছেন, ‘মেট্রো রেল’ কবিতায়—
“স্নানরত যুবতীর/ অবচেতনের মতো/ সুন্দর এই সুড়ঙ্গ”
“সূর্য ও সংযমহীন/ বাসস্টপের বিষণ্ন প্রতীক্ষা হীন/ এই পাতালপথ, তেত্রিশ মিনিটে/ লজ্জা থেকে লিবিডো-অব্দি যাবে।”—লজ্জা থেকে লিবিডো, তেত্রিশ মিনিট, বাসস্টপের প্রতীক্ষাহীন, অবচেতনের মতো সুড়ঙ্গ কী তীব্র ব্যঞ্জনায় মাধ্যমহীন মাধ্যমের পথ, সংহারের পূর্ব পথ—লজ্জা থেকে লিবিডো অবধি, শুরু থেকে গন্তব্য অবধি কী দ্রুত অপেক্ষাহীন পর্যায়বৃত্তি। গমন আর অবগাহনের মধ্যসময়—যান্ত্রিক রূপকময় শরীরী প্রেম, যেখানে সময়ের দূরত্ব এত গরীব যে কিছুই সম্পূর্ণ হয় না! এ কি কেবলই দর্শন! এটি একটি ঘর্ষণ, একটি ঝাঁকুনি, সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোর গেঁড়ি-গুঁগলি আবেদন নয়, এখানে দৃঢ়তা স্থায়িত্ব একপ্রকারেই আদর ও অপমান করে কম্পিত করে দিয়ে, চমকিয়ে অস্তিত্বসচেতন করে। শিল্পী, কবি এঁদের দৃঢ়তার কাছে হেঁট হয়ে যাওয়া মানে আত্মসমর্পণ এবং সেটাই জাগরণের সত্যি।
কবির ‘কবন্ধ মিথুন’ কবিতাটি পড়ে কবিতার চোরাবালিতে ঢুকে যাচ্ছিলাম—
“যে স্ত্রী-পতঙ্গ তার সঙ্গী পুং-পতঙ্গের/ মুণ্ডচ্ছেদ করে নেয়, অতর্কিতে, সঙ্গমের আগে—/ এবং মিলিত হয় মগজের রাশমুক্ত শুদ্ধ দেহটির সঙ্গে,/ কবন্ধের উন্মুক্ত আগুনে;/ উদ্গীর্ণ মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্ভোগের, বীজনিক্ষেপের/ চূড়ান্ত কম্পনগুলি উপভোগ করে,/ ছিন্নমস্তা উল্লাসের প্রত্যক্ষ বিস্ময় সেই/ পতঙ্গের তৃপ্তি, তার গর্ভ, অবসাদ/ জীবনের ক্ষুদ্র সত্য; কল্পনার অন্তিম প্রবাদ।” (কবন্ধ মিথুন, কাব্যগ্রন্থ- সময়,সবুজ ডাইনি)
একটি তীব্র সত্য ও দৃঢ় শিখনের কবিতা এটি, অশ্রুতপূর্ব এক লেখনী। এক প্রজাতির পতঙ্গের আক্ষরিকই এপ্রকার সঙ্গমরীতি আছে কিন্তু বিষয় হলো এই যে রীতি যাই হোক না কেন এটিই শাশ্বত সত্যি নারী-পুরুষ সৃষ্টি-সঙ্গমে, এক বিন্দুতে সমাহিত দুটি বিপরীত অনুভবের সীমান্ত। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি দুটি ভিন্ন বিন্দু ধরে উঠতে উঠতে যেন গ্রাফের একটি বিন্দুতে মিলিত হলো সেখানেই সৃষ্টি ও বিনাশ যুগপৎ হলো, তৃপ্তি, গর্ভ, অবসাদ—
“গৌতম বুদ্ধকে আমি আর্শীবাদ করি—, জোড়া রাজহাঁস—এই কোমল শিল্পের চাপে যেন তাঁর নির্বাণের মোহ ভেঙে যায়।”(জোড়া রাজহাঁস, কাব্যগ্রন্থ-আমাদের লাজুক কবিতা)
শিল্প, কামনা, লিপ্সা, উৎপাদন ও জন্মরং, সবুজ এগুলো সৃষ্টিপথের মূল কারক, যে সৃষ্টিকে রক্ষার জন্যই কোনো পুরুষ সৃষ্টিপন্থা ত্যাগ করেছেন, কবি তাকে এই বার্তা দিয়ে সমস্ত মহাত্মা কে জুড়ে দিয়েছেন সৃষ্টির কাজে—নারী, মোহ, স্তন সকলের দ্বারা নির্বাণ পরাজিত হোক, সবুজের আরো উৎকৃষ্ট, কচি জন্ম, সৃষ্টিকে স্বপ্নসান্নিধ্যে ভরে দিয়েছেন কবি তাঁর আর্শীবাদের নেপথ্যে। এটি কোনো ভাঙন নয়, সার্বিককে সার্বিক সারবত্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া যেন সৃষ্টির আগমনী ধ্বনিকে জন্মের প্রকৃত সত্য দেখিয়ে দৃঢ় করছেন অধিক ও অনধিকের ফাঁকে গড়ে ওঠা সাযুজ্যকে।
‘আমাদের প্রেম’ কবিতার শেষ দুই পঙক্তি এক ভুক্ত সত্যের সামনে এসে দাঁড় করায়, তবে কি এই খেলুড়ে গাঠনিক মহিমা ধরে ধরে এত গম্ভীর যাপন করছি নাকি করছি না! একটি জাতীয় ঘোরে গিয়ে মিশে যাচ্ছি না তো সেই ‘পারফিউম’ ছবির শেষদৃশ্যের মতো—
“কখনো ভেবেছো, কেন প্রকৃতির সত্যগুলি
দৃশ্যত ভৌতিক, কিন্তু আসলে স্বয়ংসিদ্ধ, আবেগবর্জিত?”
‘বন্দরে কথ্যভাষা’ কাব্যগ্রন্থের ‘রজনীগন্ধা’ কবিতাটি একটি মাধ্যমের উচ্চ বিকিরণ যেন—
“মৃত্যুর পর একটা অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে যায়। শরীর পচতে শুরু করে, বেরুতে
থাকে দুর্গন্ধ। ....
তাহলে প্রাণ মূলত এক গোপন সুগন্ধ, যা আজীবন শরীরের ভিতর বাসা বেঁধে
থাকে, এবং মৃত্যুর পর মুহূর্তে শরীরকে ছেড়ে চলে যায়?”
কবিতা কি একটি সূত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইল! হ্যাঁ চাইল, একে দর্শন তো বলতেই পারি, তার চেয়েও যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো সমস্ত জীবন কোন এককের সামনে এসে বসছে বা কবি তাঁকে এনে বসিয়েছেন! এককের সঙ্গে লেগে থাকে রাশি, এখানে গন্ধ রাশি আর একক যেন শরীর, কবি উন্মুক্ত বাস্তবকে আরো খুলে দিচ্ছেন, খুলে দিচ্ছেন নশ্বরতাকে—যেখানে চূড়ান্তরা পরিবর্তনের সামনে এসে হোঁচট খাচ্ছে না কারণ রূপান্তরই সর্বজনীন ও গ্রাহ্য।
‘ছেলেকে বলা রূপকথা’ কবিতায় অতিপ্রাকৃত ভঙ্গিমায় বাস্তবকে রচনা করায় ,কবি ছেলেকে রূপকথা বলার ভঙ্গিমাতে নিজেই আস্ত রূপকথা হয়ে যান যার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে সম্মোহনী নিরুপায় বাস্তবতার ছায়া...
“নার্সকে পছন্দ হলে অর্ধেক অসুখ সেরে যায়
শূন্যতা, ডেটলগন্ধ , ভাতে মাছি—সব ভালো লাগে
পুরোপুরি সেরে উঠলে ডিসচার্জড—
সেই ভয়ে ভয়ে
বাকিটা জীবন তাই
অর্ধেক অসুখ নিয়ে হাসপাতালে থেকে যেতে হয়” (নার্স, কাব্যগ্রন্থঃ জিপসীদের তাঁবু)
একটা গোটা জীবন অনুভূতির দ্বৈত রূপ নিয়ে ভেতরে ক্ষয়ে যায় কেবল আকাঙ্ক্ষার আহ্লাদে। ‘অর্ধেক অসুখ’ এখন দৃঢ়তা, যা সেরে যেতে পারে অর্ধেক মাত্রায় যার জন্য, তারই জন্য অর্ধেক অসুখ নিরাময়হীনভাবে থেকে যায়, উৎস থেকে সমাপ্তি অবধি কবিতাটি মূল সিদ্ধান্তে অটুট, কেবল মাধ্যমে ধাক্কা খেয়ে নিল পাঠকের অস্থিরতায়, জীবনের জৈব বাহুল্যে ও বাস্তবে। এইখানে কবি চূড়ান্তের হয়ে ওঠেন।
কবি জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যে গোপন আকাঙ্ক্ষাগুলি যেন সত্যিই নিঃশব্দে বহন করছেন, তার গঠন এত মজবুত যে তার আওয়াজ হয় না, গতির দৃঢ়তায় বাস্তবের বশবর্তী হতে থাকে, কবি রণজিৎ দাশ আমার কাছে দৃঢ়তার কবি, যার মূর্ছনা থমকাতে সাহায্য করে, ভুক্ত মুহূর্তকে জার্ক দেয়, কারণ এটি পূর্বে ঘটেছে বা ক্রমে ঘটছে অথচ প্রকাশভঙ্গি জানে না সেই অবয়বকে ব্যপ্তি দেন কবি, গতিকে গতির মধ্যে বড় হতে দেন সেখানে ঘটে যায় পর্যায়বৃত্তি , আমার স্বল্প মুহূর্তের কবিতা যাপন যা কেবল ব্যাক্তিগত উপলব্ধি দিয়ে তাই তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র... তাঁকে নিয়ে এ আলোচনা অবশ্যই সম্পূর্ণ নয়! কবিকে আমার শ্রদ্ধা, প্রণাম ও শুভেচ্ছা। তাঁর এই প্রগাঢ় সৃষ্টির ত্বরার প্রতি আরো তাকিয়ে থাকলাম, তাকিয়ে থাকতে বাধ্য, কেবল সে কারণেই...