পিটার বিকসেলের গল্প
স্মৃতিধর মানুষ
আমি একজনকে জানতাম যার সব ট্রেনের সময়সূচি মুখস্থ ছিল, তাকে একটিমাত্র জিনিস চরম আনন্দ দিত তা হচ্ছে ট্রেন। তার সময়টুকু সে রেলস্টেশনে কাটাত আর ট্রেন আসতে ও ছেড়ে যেতে দেখত। বগিগুলোর দিকে, ইঞ্জিনের শক্তির দিকে, বড়-বড় চাকাগুলোর দিকে অবাক হয়ে একনজরে তাকিয়ে থাকত আর টিকেট চেকারদের দিকে, স্টেশনের কর্মচারীদের দিকে—যারা চলতি ট্রেনে হুট করে লাফ দিয়ে উঠে যেতে পারে তাদের দিকেও বিস্ময় চোখে তাকিয়ে থাকত।
প্রত্যেকটা ট্রেন তার চিরচেনা, জানত ট্রেনটি কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাবে আর কখন কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, সেখান থেকে ট্রেনটি আবার কখন ছাড়বে আর সেই ট্রেন কখন এসে পৌঁছবে।
সে বগিগুলোর নাম্বার জানত, জানত কবে কোন ট্রেন চলে, তাতে খাবার বগি আছে কিনা, ট্রেন অন্য যাত্রীদের তুলতে কোন কোন স্টেশনে থামবে আর কোন কোন স্টেশনে থামবে না। সে জানত কোন কোন ট্রেনে ডাক বিভাগের বগিগুলো থাকে, মিডলটন, এ্যাবারগাভেনি, ওটন-আন্ডার-এজ্ কিংবা ওরকম কোথাও যেতে চাইলে আপনার কত টাকা দামের টিকেট লাগবে।
সে কখনো সুরাখানায় যেত না, যেত না সিনেমা দেখতে। কোথাও বেড়াতে যেত না, তার ছিল না কোনো বাইসাইকেল, রেডিও, টেলিভিশন। দৈনিক পত্রিকা বা কোনো বইও কখনো পড়ত না, আর যদি কখনো তার কাছে চিঠি আসত সে হয়তো তাও পড়ে দেখত না।
এসবের জন্য তার সময় কোথায়—যেহেতু সারাদিনই সে স্টেশনে কাটাত, আর যখন ট্রেনের সময়সূচি বদলাত, মে আর অক্টোবরে, তখন হয়তো তাকে কয়েক সপ্তাহের জন্য স্টেশনে দেখা যেত না৷
ওই সময়টাতে সে বাসায় টেবিলে বসে বসে নতুন সময়সূচির আগাপাছতলা মুখস্থ করে নিত, অদল-বদলগুলোর নোট নিত আর সব জেনেশুনে তার মন খুশিতে ভরে উঠত।
এরকমও হতো—কেউ তাকে ট্রেন ছাড়ার সময় জিজ্ঞেস করল, তখনই তার সমস্ত চেহারা নুরানি আলোর মতো ঝলমল করে উঠত, আর সে সওয়াল করত লোকটি কোথায় যেতে চায়। তবে যে তাকে ওরকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে, তার ট্রেন মিস হবে নিশ্চিত, কারণ সওয়ালকারীকে সে সহজে যেতে দিত না। শুধু যে সে ট্রেনের সময়সূচি বলে ক্ষান্ত হবে ব্যাপার এরকমও না। সবিস্তারে জানাত, কটা কামরা আছে, কোন কোন স্টেশনে গিয়ে এ ট্রেন থেকে নেমে অন্য আরো ট্রেন ধরা যাবে, সমস্ত ট্রেনের সময়সূচি; সুন্দর করে বুঝিয়ে বলত। এ ট্রেনে করে কিভাবে প্যারিস অব্দি যাওয়া যায়, কোথায় ট্রেন বদলাতে হবে আর কখন গিয়ে পৌঁছবে আর সে একটুও বুঝতে চাইত না যে এসব জানতে লোকজন আগ্রহী কিনা। কিন্তু কেউ যখন তার সব জ্ঞান জাহির করার আগেই তার থেকে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা দিত তখন সে তাদের চরম গালিগালাজ করত আর চেঁচিয়ে বলত—ট্রেন সম্পর্কে তুমি কতটা জানো।
সে নিজে কিন্তু কখনো ট্রেনে চড়েনি। ট্রেনে চড়ার কোনো মানেই হয় না, সে বলত, ট্রেন কখন পৌঁছবে আর ছাড়বে তা তো সে আগেভাগেই জানে।
সে বলত, শুধু তারাই ট্রেনে চড়ে যাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল। যদি তাদের প্রখর স্মৃতিশক্তি থাকত তারা আমার মতো ট্রেন কখন কোথায় পৌঁছবে তার সময়সূচি মনে রাখত। তাহলেই এ সময়টা জানার জন্য অযথা ট্রেনে চড়ার কোনো দরকারই হতো না। আমি তাকে একবার বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম এই বলে যে, কিন্তু এমন লোকও আছে যারা ভ্রমণ উপভোগ করে, ট্রেনে ঘুরতে তাদের ভালো লাগে, জানালা দিয়ে আশেপাশের দৃশ্য দেখতে, অন্য কোনো ট্রেন যাওয়ার দৃশ্য—এসব দেখতে পছন্দ করে।
এ কথা শুনে সে রাগান্বিত হলো, সে ভেবেছিল আমি বুঝি তার সাথে মশকরা করেছি। সে বলল, এ কথা তো তুমি মিয়া ট্রেনের সময়সূচিতেই পড়তে পারো, তুমি জানো যে তুমি মার্লো, মিডেনহেড হয়ে যাবে, টয়ফর্ড, টাইলহার্স্ট, প্যাঙবর্জ তোমার পথে পড়বে। আমি বলেছিলাম, হয়তো লোকেদের ট্রেনে চড়তে হয় এ দরকারে যে, তাদের কোথাও যেতে হয়। সে বলেছিল, এ কথা মোটেও সত্য না। প্রায় প্রত্যেকেই তাড়াতাড়ি বা দেরিতে হলেও ফিরে আসে যেখান থেকে তারা রওনা করেছিল। এরকমও লোক আছে যারা রোজ সকালে ট্রেনে বের হয় আর সন্ধ্যাবেলা আগের জায়গায় ফিরে আসে—এটাই প্রমাণ করে তাদের স্মৃতিশক্তি কত বাজে। আর এ কথা বলে সে স্টেশনের লোকদের উদ্দেশ্যে যা মুখে আসে তা-ই বলতে শুরু করল। সবাইকে উদ্দেশ্য করে সে চেঁচিয়ে বলেছিল, আপনারা সব বোকা, আপনাদের একটা কিচ্ছুও মনে থাকে না। চেঁচিয়ে সে আরো বলছিল, আপনারা প্যাঙবর্জ পেরিয়ে যাবেন আর সে ভেবেছিল এতেই বুঝি সকলের ট্রেনে চড়ার স্বাদ মিটে যাবে। চেঁচিয়ে বলছিল, আপনারা দুনিয়ার সেরা বোকা, আপনারা গতকালও ট্রেনে চড়ছিলেন। আর যখন লোকে তার কথা শুনে হাসাহাসি করছিল, সে লোকদের টানাটানি করে ট্রেনের কামরা থেকে নামানোর চেষ্টা করছিল, কাকুতি-মিনতি করে বলছিল, তারা যেন আর ট্রেনে না চড়ে।
সে জোরে জোরে চেঁচিয়ে বলছিল, আমি সব বুঝিয়ে বলছি। আপনারা দুইটা সাতাইশে প্যাঙবর্জ পার হবেন, আমি জানি আপনারা পার হবেন, আপনারা দেইখেন। আপনারা হুদাই টাকা-পয়সা অপচয় করছেন, রাস্তায় ঢালছেন, অথচ সময়সূচিই যেখানে আপনাদের সব জানান দিচ্ছে।
তখন সে লোকজনদের মারধর করতে শুরু করে দিল, আর বলছিল, যদি আপনারা আমার কথা না শোনেন আপনাদের পিটায়ে শিখাইতে হবে।
স্টেশন মাস্টারের করার কিছুই ছিল না, তাকে বলেছিল, যদি সে ভদ্র-নম্র ব্যবহার না করে তাহলে তাকে আর স্টেশনে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এ কথা শোনার পর সে আঁতকে উঠল, কারণ স্টেশন ছাড়া সে বাঁচবে কী করে, তাই সে একটা টুঁ শব্দও করল না। সারাদিন চুপচাপ বেঞ্চিতে বসে রইল, ট্রেন আসতে আর ছেড়ে যেতে দেখল। কেবল মাঝে-মাঝে নিজেকে নিজে ফিসফিস করে শোনাল কয়েকটা নাম্বার, লোকজনের দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকল, যাদেরকে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।
সত্যি বলতে এখানেই গল্পটা শেষ হওয়ার কথা।
বহু বছর পর স্টেশনে একটা তথ্য কেন্দ্র খোলা হলো। ইউনিফর্ম পরা এক কর্মচারী বসে থাকে কাউন্টারের পেছনে আর সে ট্রেনসংক্রান্ত সমস্ত সওয়ালের জবাব জিজ্ঞেস করা মাত্র দিয়ে দেয়। ব্যাপারটা ট্রেনসংক্রান্ত স্মৃতিধর লোকটার কিছুতেই বিশ্বাস হলো না, সে রোজ নতুন তথ্যকেন্দ্রে যেত আর জিজ্ঞেস করত খুব জটিল জটিল প্রশ্ন—কর্মচারীর এলেম পরীক্ষা করার জন্য। সে সওয়াল করত, গ্রীষ্মের রবিবারে গ্লাসো থেকে চারটা চব্বিশে যে ট্রেন আসে সেটির ইঞ্জিনের মডেল কী? কর্মচারী একটা বই খুলে দেখে তাকে তা বলে দিত। সে সওয়াল করত, ধরেন আমি ৬টা ৫৯ মিনিটে ট্রেনে উঠলে কখন মস্কো পৌঁছব? আর কর্মচারী তাও বলে দিত। তারপর স্মৃতিধর লোকটি বাসায় ফিরে এলো, তার সময়সূচির চার্টগুলি পুড়িয়ে ফেলল আর যা-কিছু সে জানত সব ভুলে গেল। পরের দিন সে কর্মচারীকে সওয়াল করল, স্টেশনের সিঁড়ির ধাপ কয়টা? কর্মচারী বলল, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। তারপর সে স্টেশনের সিঁড়ির ধাপগুলো গুনতে গেল, বারবার গুনে সংখ্যাটা সে স্মৃতিতে গেঁথে রাখল, এখন আর তার স্মৃতিতে ট্রেনের সময়সূচির কোনো হদিশ নেই।
এরপর আর কোনোদিন তাকে স্টেশনে দেখা যায়নি। সে এখন শহরের বাড়ি বাড়ি যায়, সিঁড়ির ধাপগুলো গুনে রাখে আর মুখস্থ করে নেয়। এখন সে এমন সব সংখ্যা জানে যা তামাম দুনিয়ার কোনো বই-পুস্তক-কিতাবে লেখা নেই।
কিন্তু যখন সে শহরের সব সিঁড়িধাপগুলোর সংখ্যা জেনে গেল তখন সে স্টেশনে এলো, একটা টিকেট খরিদ করল। তারপর জীবনে প্রথমবারের মতো সে ট্রেনে চড়ল যাতে সে অন্য শহরে গিয়ে সিঁড়ির ধাপগুলো গুনতে পারে। তারপর আবার অন্য একটা শহরে—এরকম করে সে তামাম দুনিয়ার সমস্ত সিঁড়ির ধাপগুলোর সংখ্যা জেনে নিতে পারে, এটা এরকম কিছু যা কেউই জানে না, কোনো কর্মচারীর হেডম নেই কোনো বই খুলে তা বলে দেয়।