“পাঠক যেটুকু মনে রাখে তার জন্য দু’ চারখানা ভালো লেখাই যথেষ্ট” - সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়



Tanim Kabir
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

গল্পকার ও গদ্যকার ইশরাত তানিয়া সম্পাদিত সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ স্থান পেয়েছে বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দশজন নারী লেখকের সাক্ষাৎকার। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরার স্বতন্ত্র নারীস্বরকে দুইমলাটে চিহ্নিত করার এই প্রয়াস লক্ষণীয়। বিশেষ করে সাক্ষাৎকার প্রদানকারী প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। কথাও বলেছেন ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে, উত্তর দিয়েছেন নারীবাদ, রাজনীতি, সমাজ-রাষ্ট্র, লেখালেখির দায় এবং প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি বহুবিদ গভীর ও অত্যাবশ্যকীয় প্রশ্নের। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নাসরীন জাহান, পাপড়ি রহমান, আনোয়ারা সৈয়দ হক, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃপ্তি সান্ত্রা, ঝুমুর পাণ্ডে, রাশিদা সুলতানা, মঞ্জু দাসসহ বাংলার চারটি ভূখণ্ডের প্রতিনিধিত্বশীল সব নাম।

সমসাময়িক বাংলার নারী লেখকদের শক্তিমত্তা ও বহুবিচিত্রতার সাক্ষ্যদলিল—ব্যতিক্রমী এই সংকলনটির গুরুত্ব বিবেচনায় এখানকার দুটি আংশিক ও একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ করছে বার্তা২৪। এতে নারী লেখকদের ভাবনাবলয়ের পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে তাদের কাজ সম্পর্কে আরো সিরিয়াস এবং নতুন পাঠকদের বিস্তারিতভাবে জানার আগ্রহ তৈরি হবে। এখন থেকে প্রকাশিত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের ‘অনলাইন কনটেন্ট শেয়ারিং প্লাটফর্ম’ হিসেবেও কাজ করবে বার্তা। আজ থাকছে কথাসাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার।

সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়

সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৭৪, ২৩ নভেম্বর। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শাহরুখ আর আমি’। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অনেক অবগাহন’। ২০০৪-এর ডিসেম্বরে দেশ পত্রিকায় ‘শঙ্খিনী’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এছাড়া ‘প্যান্টি’, ‘রুহ’, ‘যোগিনী’, ‘ঘাট’, ‘সম্মোহন’, ‘ফাঁকি’, ‘কড়িখেলা’, ‘হাওয়ায় হাওয়ায়’, ‘যখন বিকেল’, ‘কালা ঘোড়া’, ‘গুপ্তধন’, ‘মরিয়ম মেয়েরা’, ‘গলনাঙ্ক’, ‘নিভাননী উপত্যকা’ ইত্যাদি উপন্যাস লিখেছেন। প্রায় ৬০-এর ওপর ছোট-বড় গল্প লিখেছেন। দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন এবিপি আনন্দতে। লিখেছেন অসংখ্য ফিচার, ফিল্ম রিভিউ, পোস্ট এডিট, কাভার স্টোরি। প্যান্টি, রুহ, যোগিনী, সম্মোহন ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে Penguin, HarperCollins এবং ইউকে বেইসড পাবলিশিং হাউজ Tilted Axis Press থেকে। যোগিনীর জন্য পেয়েছেন ২০১৭ ইন্টারন্যাশনাল পেন ট্রান্সলেশান এওয়ার্ড। বেশ কিছুকাল লন্ডনে বসবাস করেছেন। এবং ভারত ও বিদেশের অনেক সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে গেছেন। স্বামী আছে। একটি ছেলে আছে। শখ বলতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অধ্যয়ন ও এই মহাবিশ্বে মানুষের উপলব্ধিগুলোকে জানা ও বোঝা।


ইশরাত তানিয়া: উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে বিষয়, কাঠামো, চরিত্র নির্মাণ, ভাষার বিশেষ গঠন (কন্সট্রাকশান) এবং প্রকাশভঙ্গি এসবের কোনটিকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়? নিজস্ব কোনো নির্মাণকৌশল ব্যবহার করেন কি? 
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: নির্মাণ কৌশল বলতে ফর্ম। আলাদা করে ভেবে এগোই না। উপন্যাসটাই দাবি আদায় করে নেয়। যেমন প্যান্টি উপন্যাসটা মাথায় এসেইছিল স্বপ্নের ভেতর। ওইভাবেই উঠে লিখতে শুরু করি। পরে অধ্যায়গুলোর ওই জাক্সট্রাপোজিশান অনেকটা ভেবে করা। মনে হয়েছিল জীবনে তো কোনো কিছুর কনটিনিউটি নেই। ঘটনার কনটিনিইউটি তো থাকে না। অনেকটা কোর্টের ডেট পরার মতো। একটা ডেট পড়ার পর আর একটা ডেট কবে পড়বে কেউ জানে না। আবার রুহ উপন্যাসে প্রটাগনিস্টকে দুটো খুব কন্ট্রাডিকটোরি সত্তায় ভাগ করেছি যেটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। এছাড়া ভাষাটা তো অনেক ভেবেচিন্তে করতে হয়। গদ্যের স্টাইলটা ভীষণ ভেবে নিয়ে করি। তবে মডার্ন বাংলা গদ্য নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা আছে। আমি সেভাবেই শব্দকে অ্যাপ্লাই করি। কিন্তু ধরা যাক আমার গুপ্তধন উপন্যাসটার সময়কাল ৬০-এর দশক। সেখানে ন্যারেটিভটা সেই সময়টাকেই ধরে, ডায়লগও তাই। ফলে পুরোটাই খুব সতর্ক প্রক্ষেপণ। এবং আমার মনে হয় আমার এমন কোনো লেখা নেই যা পাঠক পড়ে বলবে যে লেখক লিখতে হতো তাই লিখেছে। আমি মোটামুটি নিজেকে ধরে রেখেই লিখেছি যা লিখেছি এযাবৎকাল।

ইশরাত তানিয়া: এখন কোনো উপন্যাস লিখছেন? বা নতুন উপন্যাস লেখার ব্যাপারে কিছু ভাবছেন? এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: সারাক্ষণ লেখার কথা ভাবি। মাঝে মাঝে মনে হয় মাথার মধ্যে এই চিন্তার বিজবিজি কোনো পাগলামি নয় তো? এটা এত বেড়ে গেছে যে আজকাল একটু সংশয় হয়। ভাবছি অনেক। লিখছি নগণ্য পরিমাণ। কেন? কারণ কী? জানি না। টায়ার্ড? মনে হয় আমি একটু জীবনটা বাঁচতেও চাই। লেখার জন্য বাঁচতে চাই না। বাঁচলাম লিখলাম দেখলাম ভুলে গেলাম উড়িয়ে দিলাম এরকম হোক। সুচিত্রা ভট্টাচার্য হাত ভেঙে কষ্ট পাচ্ছেন, লিখতে পারছেন না, এক আঙুলে টাইপ করে করে লিখছেন, এত লেখার চাপ। তার মধ্যে বিষম খেয়ে মরে গেলেন। ইস! একটু রেস্ট দরকার ছিল মানুষটার। একটু আরাম দরকার ছিল। কিন্তু পাঠক পাঠক করে সেটা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলেন। সেই পাঠক তাঁকে কতটুকু স্মরণ করে? কতটা মিস করে? পাঠক তো কারো নয়। পাঠক যেটুকু মনে রাখে তার জন্য দু চারখানা ভালো লেখাই যথেষ্ট। প্রাণ হাতে করে, মরিয়া হয়ে লেখার প্রয়োজন নেই। একমাত্র টাকার প্রয়োজন থাকলে ওরকম করে লেখা উচিত। আমরা ভাবি পাঠক পাঠক। পাঠক একটা অবিরল স্রোত, একটা চৈতন্যের স্রোত। এই স্রোতের খিদের সঙ্গে লেখক পাল্লা দিতে পারে নাকি? কারণ লেখক ওয়ান ম্যান আর্মি। লেখকের থেকে একা, নিঃসঙ্গ, অসহায় কেউ হয় না। আমাদের মধ্যে, মানুষের সভ্যতার মধ্যে একটা দর্শন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে কর্মবীর হতে হবে। যে অনেক কাজ করছে সেই আর কী সঠিক পথে আছে। আমার মনে হয় কাজ কম করা উচিত। উই নিড টু স্লো ডাউন। এটা একটা এমন মানসিক অবস্থা যা মানুষকে আরো তলিয়ে ভাবতে সাহায্য করবে যে আমাদের রিপু আর প্রবৃত্তিকে আমরা কী করে উন্নত করব। এই যে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়, কোথায় এগোনোর কথা বলা হয় আমি বুঝি না। ক্রমশ তো সভ্যতারই প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে। পৃথিবীতে মৌমাছি এত কমে গেছে যে এক্সটিঙ্কট হওয়ার মুখে। আর সেটা হলেই মানুষ শেষ। আইনস্টাইন বলে গেছেন কবে, মৌমাছিরা না থাকলে মানুষ ৪ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এখন আমাদের দরকার জঙ্গল, দরকার সরল সাদাসিধে জীবনে ফিরে যাওয়া। এই সব কথাই এখন বলতে হবে। আমার এখন আর এত অহঙ্কার হয় না এই সভ্যতা নিয়ে।
এই সব কারণে আমি অনেক লেখা মনে মনে লিখে ফেলি। অনেক লেখা বাতিল করি। আপাতত এত লেখা মাথায় আছে হয়তো একটা দুটো লিখব তার মধ্যে থেকে। কিন্তু আমার একটা বাতিক হলো আমি কী লিখছি সেটা কাউকে কখনো বলি না। আমার লেখার কোনো প্লট হয় না। একটা জার্নি হয়। শেষ মুহূর্তে অব্দি আমি জানতে পারি না কী লিখছি।


“সাহিত্যকে আমি দুই বাংলায় ভাগ করতে আগ্রহী নই”
- রাশিদা সুলতানা


ইশরাত তানিয়া: একজন লেখকের পাঠকের কাছে পৌঁছানো কতটা জরুরি? কমলকুমার মজুমদার বা সুবিমল মিশ্রের কথা যদি বলি, ওনারা কিন্তু সেভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারেননি। আবার শরৎচন্দ্র, মানিক, বিভূতি, সুনীল পৌঁছে গেছেন। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত জানতে চাইছি ।
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: যদিও প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে, আমার মনে হয় লেখকের পাঠকের কাছে পৌঁছানোর একটা প্রধান শর্ত রিড্যাবিলিটি। লেখক প্রধানত কমিউনিকেট করার ইচ্ছে থেকেই লিখতে আসেন। নইলে তো মনে মনে কথা বললেও হয়ে যেত। আবার নিজের উপলব্ধিগুলোও কখনো কখনো ফেডেড হয়ে যায়। আমি যে একটা কোনো বড় সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম জীবন সম্পর্কে, সেটা অনেক সময় গুলিয়ে যেতে পারে। তাই সেই অনুভব ও উপলব্ধির শৃঙ্গগুলিকে লিখে রাখতে হয়, আবার কিভাবে আমি সেই উপলব্ধিতে পৌঁছলাম তার জার্নিটাও লিখে রাখতে হয়, নইলে পরে মনে হতে পারে যে আমি এখানে কোথা থেকে এসে উঠলাম? তাই মনে মনে ভেবে ফেলতে পারলেই হয় না, এমনকি মানুষ ডায়রি লেখেও এই জায়গা থেকে। লেখার প্রয়োজন আছে। কোথাও গিয়ে আমার মনে হয় ইতিহাসও সাহিত্যের অঙ্গ। ব্যক্তির ইতিহাস লিখে না রাখলে বৃহৎ ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে না। সেখানেই সাহিত্য ইতিহাসকে জমি দেয়। ফিকশন তাই। লেখার প্রয়োজন তৈরি হয় কারণ এই অর্জিত জ্ঞান, তথ্য, আবেগের যাত্রাপথ সবই অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হয়। এটাই প্রত্যাশা একজন লেখকের। সেখানে রিড্যাবিলিটির একটা প্রয়োজন তো থাকেই। কিন্তু কমলকুমারের মতো লেখকরা হলেন লেখকদের লেখক। একজন অভিভাবক যেন। তাঁকে পাঠ করতে হলে এক ধরনের গভীর অভিনিবেশ ও চর্চা দরকার পাঠকের। একটা জেদ থাকতে হয়। সবার জন্য সবকিছু নয়। আবার এরকম হয়েছে, অনেক কালোত্তীর্ণ লেখকের ক্ষেত্রে ঘটেছে যে তাঁর সময়ে তাঁকে কেউ গ্রহণ করেনি, বুঝতে পারেনি। কাফকা তার জীবিত অবস্থায় কোনোদিন গৃহীত হননি। কিটস্-এর ক্ষেত্রেও এরকম ঘটেছে। সমকাল ঠোঁট উল্টেছে। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দকে বুঝতে পারেননি। গুরুত্ব দিতে চাননি। রবীন্দ্রনাথ তার মগ্নচেতনাকে সব সময়ই সাবলিমেট করেছেন ঐশ্বরিক চৈতন্যে। সভ্যতার উন্নতির কথা ভেবে গেছেন। এটা একটা কনশাস প্রচেষ্টা। জীবনানন্দ সেখানে ইতিহাসের অন্ধকারে পর্যটন করেছেন। তিনি মানুষের আরো গভীর অন্তঃপ্রকৃতির কথা লিখেছেন। মানুষের অবচেতনকে ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে ধরেছেন। জীবনানন্দ এভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু মূল কথাটা একই। লেখকের এই ফুটপ্রিন্ট, এই পার্টিসিপেশান। নিম অন্নপূর্ণা বা সতীত্ব কি রাখব অপর্ণা কিংবা হার্বাট এসব লেখা চিরকাল সিরিয়াস পাঠককে ভাবাবে, পাঠকের মননে নানা ক্রিয়াবিক্রিয়া ঘটাবে। নবারুণ ভট্টাচার্যের নামও এখানে নিতে হয়। আমি এই রাইটার/ অ্যান্টি-রাইটার এর মধ্যে যেতে চাই না। পাঠকের সংখ্যা দিয়ে লেখকের বিচার হয় না।

ইশরাত তানিয়া: রিডার রেসপন্স থিওরি নিয়ে আপনার মত কী?
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: এটা একটা খুব ভালো প্রশ্ন। ইফ দেয়ার ইজ নো রিডার দেয়ার ইজ নো রাইটার। সাহিত্যের প্রতি, একটা ক্রিটিক্যাল লেখার প্রতি পাঠকের অ্যাপ্রোচটা একটা বিরাট বড় ব্যাপার। এটা একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। আমি একটা পদ রান্না করলাম। অনেকগুলো সিক্রেট ফ্লেভার মেশালাম তাতে। এবার একটা দশজনের গ্রুপ এক সঙ্গে বসে সেই পদটা ভাগাভাগি করে খেলাম। আমরা খেলাম নিঃশব্দে। কোনো মুখভঙ্গি করলাম না। কোনো ভাব প্রকাশ করলাম না। এবং উঠে চলে গেলাম যে যার রাস্তায়। এবার এই যে রান্নাটা তার কী হবে। সেটা রান্না হলো খাওয়া হলো তার কোনো চিহ্ন থাকবে না। কিন্তু যদি ভাব বিনিময় হতো, আহঃ, বাহ, কী ভালো, এটা কী, ওটা কী, খেতে খেতে এটা ওটা মনে পড়ল ইত্যাদি যদি ওইখানে ঘটত তাহলে এই খাবারটা তার আস্বাদসহ শেষ হয়েও ঝুলে থাকত কোথাও। সেই ঝুলে থাকা একটা অনন্ত সম্ভাবনা। এই অ্যাপ্রোচটা বাদ দিলে খাবার থাকবে, আস্বাদ থাকবে না। অতএব লেখক লেখে, পাঠক পড়ে, এবং তারপর তার রিডিং এক্সপিরিয়েন্স বহুধাবিভক্ত হয়ে এমন বৃহত্তর ডিসকোর্স তৈরি করে যা সাহিত্যের জন্য একান্ত অপরিহার্য। এবং অনেক বড় একটা সময়ের ব্যবধানে এই ডিসকোর্স কিন্তু মূল লেখার ভেতর জুড়ে যায়। এর উদাহরণস্বরূপ আমরা মহাকাব্যগুলোর কথা বলতে পারি। এই কারণেই মহাকাব্যগুলো এত হাজার বছর পরও বহমান। জেমস জয়েসের ইউলিসিস পড়ার একটা কমিউনিটি আছে। সেই কমিউনিটিতে মানুষ আসে, এক সঙ্গে ইউলিসিস পড়ে, যে যার মতো করে সেই পাঠে কনট্রিবিউট করে। পরবর্তীতে সেই কনট্রিবিউশন আবার পাঠের অংশ হয়ে যায়। আমি কলকাতায় এরকম স্টাডি সার্কেলে গেছি। আমি বিদেশে বুক ক্লাব দেখেছি। ব্রুকলিনে গত বছর আমার অ্যাবান্ডন উপন্যাসটা একটা বুক ক্লাব এক মাস ধরে পড়েছে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় কতগুলো বইপড়ার গ্রুপ। তারা এক্সটেনসিভলি লেখক এবং লেখকের রচনা নিয়ে আলোচনা করে। খুব দরকারি। যে কারণে উম্বার্তো ইকো না পড়লে আমি তো আনা কারেনিনাকে এত ভালো করে বুঝতে পারতাম না। স্টাডি সার্কেল ছাড়া আমি তো জয়েসকে বুঝতে পারতাম না। এই প্রসঙ্গে উম্বার্তো ইকোর একটা উক্তি মনে পড়ছে—আমরা একটা বই এই জন্য পড়ি না যে, তাতে যা লেখা আছে আমরা সেটাই বিশ্বাস করে নেব। আমরা একটা বই এই জন্য পড়ি যাতে আরেকটা বই পড়ার জন্য আমাদের মনটা আবার অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। অনেকটাই অ্যারিস্টোটল যা বলছেন তারই প্রতিধ্বনি।


“বেশি সতর্কতা, অসতর্কতা লেখার শিল্পগুণ নষ্ট করে”
- নাসরীন জাহান


ইশরাত তানিয়া: পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান আমরা জানি। লেখক সমাজ কি এর বাইরে? একজন নারীর লেখক হতে চাওয়াটা কতটুকু চ্যালেঞ্জিং? এর সমাধানই বা কী?
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: আসলে অনেক মানুষ একটা ডিনায়েলে বাঁচে। আমার মধ্যেও একটা ডিনায়েল আছে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করে গেলাম যে, আসলে আমার যা সাফারিংস সেটা মেয়ে হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে। আর পাঁচটা নারী পুরুষ জীবনে যে দুর্ভোগ সহ্য করে ঘটনাচক্রে আমাকেও সেই রকম অনেক কিছু জীবনে সহ্য করতে হয়েছে। আমার বাবার পুত্র সন্তানের প্রতি একটা অনিচ্ছা ছিল। চাইতেন কন্যা সন্তান হোক। আমার বাবাকে মজা করে খবর দেওয়া হয় যে ছেলে হয়েছে। বাবা খুব আশাহত হয়ে বসে ছিলেন চুপ করে। তখন তাড়াতাড়ি বলা হয় যে—না, মেয়ে জন্মেছে। বাবা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বেরিয়ে যান মেয়েকে দেখতে। এই গল্পটা আমাকে ছোট থেকে বলা হতো। এটা শুনে আমার দুঃখ হতো সেই না হওয়া ছেলেটার প্রতি। যে হলে বাবা তাকে দেখতে যেত না! আবার পুরো গল্পটা একটা স্ট্রেংথ তৈরি করে দিয়েছিল আমার মধ্যে আমাদের সকলের অগোচরে। নিজেকে মূল্যবান ভাবার, ওয়ান্টেড ভাবার এরকম একটা ঘটনা থাকলে একদম ছোট্ট থেকে একটা বিশ্বাস আর নিরাপত্তার বোধ তৈরি হয়ে যায় যেটা পরবর্তী সময় নিজেকে নারী হিসেবে পুরুষের তুলনায় কিছু আলাদা ভাবাটা একেবারে অপ্রয়োজনীয় ভেবে বাতিল হয়ে যায় মন থেকে, চিন্তা থেকে। আমার মামাবাড়ির তরফে এত এত মেয়ে। তাদের খুব কদর ছিল। অনেক বড় অব্দি আমার মামাদের দেখতাম আমার মাসীদের স্নান, খাওয়া, ঘুম, মুখে ক্রিম লাগানো, রাতের দাঁত মাজা, ইসবগুল খাওয়া এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে। “দুপুরে ঘুমোলি না তোরা? খালি গল্প করলি?” এই নিয়ে হয়তো মামা রাগারাগি করলেন। মানে সারাক্ষণ বাড়ির মেয়েদের তোয়াজ করা হতো। যদিও মামারা ছিলেন অতি মধ্যবিত্ত পরিবার। এদিকে আমার বাবার দিকের পরিবার হলো অতি উচ্চবিত্ত, অতিরিক্ত ধনী পরিবার বলতে যা বোঝায় তাই। সেখানেও পরিবারে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। আর মেয়েদের সেই রকম আদর, আবদার। আমরা এতটাই প্যামপারড ছিলাম ভাবা যায় না। এই দুদিকে মেয়েদের এত আস্কারা পেতে দেখে আমার ভেতর পুরুষ বিদ্বেষটা গড়ে ওঠেনি। পরবর্তী জীবনে আই হ্যাড বিন সাব্জেক্টেড টু ভেরিয়াস ইল ট্রিট্মেন্টস বাই মেন। কিন্তু আমি ভাবতে শিখিনি যে এটা তারা করেছে কারণ পুরুষদের মধ্যে এইরকম দোষ থাকে আর তারা পুরুষ। আমি ভেবেছি মানুষ হিসেবে এরা কমপ্যাটিবল নয়, ঠিক নয়, যোগ্য নয়। অ্যান্ড আই মুভড অন ইন মাই লাইফ টু মেক মাই লাইফ বেটার ইন হোয়াটএভার মিন্স, ইউ মাইট সে। কিন্তু এ হলো আমার ব্যক্তিগত জীবনের কথা। প্রফেশনাল জগতে, কাজের জগতে আমাকে পুরুষ দ্বারা হ্যারাসড হতে হয়নি কারণ আই ওয়াজ আ ব্লু আইড গার্ল ইন মাই ওয়ার্ক প্লেস। কেউ আমাকে কখনো বিরক্ত করেনি বা কোনো রকম ডিস্ক্রিমেনেশান বা পলিটিক্স কিছু আমাকে সহ্য করতে হয়নি। আই হ্যাড আ সেইফ করিডোর আর তারপরও যেটুকু এসে পড়েছে সেটা খুব সাট্ল। তার কোনো ইফেক্ট হয় না জীবনের কোথাও। এতসব কিছুর পরও বলব যে, অনেক পুরুষই আত্মসম্মান জিনিসটা বোঝেন না। তাদের আপ ব্রিংগিংয়ের মধ্যে নিজেকে রেস্পেক্ট করা ব্যাপারটা কম। বিশেষত মেয়েদের সামনে প্রায়শই তারা পা থেকে মাথা অব্দি একটা ‘পেনিস’-এ রিডিউসড হয়ে যান। এটা তাদের প্রবলেম। তাদেরই সলভ্ করতে হবে। আমরা মেয়েরা নিজেদের ঘাড়ে এইসব কিছু পরিবর্তনের দায়টা আর নেব না। বা নিজেদের পরিবর্তন করে পুরুষদের অ্যাকোমোডেট করব না। মনে রাখতে হবে যে, আমরা মেয়েরা নিজেদের যত ভাঙছি গড়ছি তা এই পুরুষতন্ত্রের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে করছি। আমাদের জানতে হবে এই চাপটা না থাকলে আমরা কী কী করতাম, কেমনভাবে বাঁচতে চাইতাম। এছাড়া আরো নানা রকম ডিস্ক্রিমিনেশান কর্মক্ষেত্রে আমাদের সহ্য করতে হয়। এগুলো প্রচুর বড় পরিসরে আলোচনা করার বিষয়। এখন তো মধ্যবয়স। অনেকটা জীবন পেরিয়ে এসেছি। এখন আমি পুরুষদের ভালোওবাসি না, ঘৃণাও করি না। পুরুষ প্রকৃতিটাই অবসোলিট হয়ে যাচ্ছে। ম্যাসকিউলিনিটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে যত দিন যাচ্ছে। আরো হবে। খুব অচিরে এই রিজেকশান অফ ম্যাসকিউলিনিটি নিয়ে বিপুল চর্চা শুরু হবে এটা দেখতে পাবে। পৌরুষ জিনিসটার এলিজি লেখা হলো বলে।

ইশরাত তানিয়া: উপমহাদেশ জুড়ে ইদানীং ধর্মের প্রবল মাতামাতি, কী ভাবছেন? সাম্প্রতিক রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সাহিত্য কি ঘুরে দাঁড়ানোর মতো শক্তির যোগান দিতে পারে?
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: আমি কোনোদিনই কারো শেখানো বুলি আওড়াতে পারিনি, চাইনি। আমার একদম ছোট থেকে নিজস্ব মতামত ছিল। এমন মতামত যা কিনা তুমি বলতে পারো কিছু দেখে, কিছু পড়ে, কিছু শুনে তৈরি হয়নি। একেবারে নিয়ে জন্মেছিলাম বলা যায়। ফলে আমার কথা সবার পছন্দ হয় না। তো, এই প্রশ্নের উত্তরে আমি এটাই বলব যে, পৃথিবীতে সমস্ত ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে ওঠার মতো সাহিত্য বলো, শাস্ত্র বলো, ডিসকোর্স বলো, কম লেখা হয়নি। যা লেখা হয়েছে তাই মানুষ সারা জীবনে পড়ে উঠতে পারবে না। আর সত্যি কথা বলতে কী, বোধ তৈরি হওয়ার জন্য একজন মানুষকে কোটি কোটি পথ প্রদানকারী বই পড়ার প্রয়োজন হয় না যে, সে সারা জীবন খালি পথ খুঁজেই যাবে, কোনো উদ্ধারই তার হবে না। ব্যাপারটা তা নয়। তাই যা লেখা হয়েছে, যথেষ্ট লেখা হয়েছে, এই সভ্যতা তার থেকে শিখতেই পারে। কিন্তু শিখেছে কি? সাহিত্যের নানান ধারা মানুষের মননকে ঋদ্ধ করেছে কিন্তু জীবনের গতিপথ পাল্টাতে পেরেছে কি? একজন কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না, তার বোধ, চেতনা একদম তৈরি, কিন্তু এখন দাঙ্গা লাগল, তাকে মারতে এলো কেউ, সে উঠে গিয়ে মারল বা মরল, দু ক্ষেত্রেই এই যে ঘৃণ্য জিনিসটা ঘটে গেল এটাকে তো সময় থেকে মুছে দেওয়া যাবে না, সময় তো ঘৃণাটাকে নিয়ে চলবে। ইতিহাস তার সাক্ষী হয়ে থাকবে। সেখানে মানুষ তার প্রজ্ঞা, তার জ্ঞান, রুচি, শিক্ষা সব একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে জলাঞ্জলি দেবে। দিতে সে বাধ্য কারণ সে আসলে একটা বড় চক্রান্তের ভেতর একটা গিনিপিগ। একটা পরিস্থিতির শিকার। এত ভালো ভালো সব লেখা আছে, যা ঘটনার পর ঘটনা দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, এই সব ধর্ম টর্মের কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষ বোঝে, জানে, কিন্তু এঁটে উঠতে পারে না। আমি তো এরকমও কথা বলেছি যে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, কী সেটা? আঘাত লাগার একটা প্রমাণ তো থাকে, শরীরে, মনে, কী আঘাত লাগল তার একটা প্রামাণ্যতা তো আছে, থাকবে? কেউ পারবে প্রমাণ করতে? কিন্তু দেখো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত একটা কত্ত বড় বিষয়। এমনকি এমন ছেঁদো একটা দাবিকে আইনও স্বীকার করে, যে হ্যাঁ বাবা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে! যাই হোক, জানি না কী ধাতুতে তৈরি হয়েছিলাম, জীবনে এসব প্রশ্ন জাগলোই না। সাহিত্যের কাজ এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা, সাহিত্য তার কাজ করে যাবে। আবার দেখো সাহিত্যের একটা বিপজ্জনক বিনির্মাণ হচ্ছে। কাউন্টার সাহিত্য লেখা হচ্ছে। সেগুলোও তো ঢুকে আসছে। যেটা ধর্মকে আবার জীবনের মূলে ফিরিয়ে দিতে চাইছে। যে মানুষ কিছু না, ধর্মের জন্যই মানুষ, তাই মানুষ আর কিছু ভাববে না, ধর্মের জন্য বাঁচবে মরবে। মারিও পুজো বলে গেছিলেন, যে পৃথিবীর সর্ব প্রথম মাফিয়া ছিলেন পোপ আলেকজান্ডার। মারিও সারা জীবন মাফিয়াদের নিয়ে পৃথিবীর জনপ্রিয়তম বই লিখে গেছেন। তিনি একথা বলছেন। ধর্ম এইরকমভাবেই কাজ করে মানুষের জীবনে।
এখানে একটা কথা বলতে চাই, এই উপমহাদেশকে ধর্মের গ্রাস থেকে, অন্ধকার থেকে বাঁচাবে মেয়েরা। মেয়েরা জানে ধর্মের সবচেয়ে বড় বলি তারা। তাদের বাঁচতে দেওয়া হবে না। মেয়েরা লড়াই করবে, সাহিত্য অর নো সাহিত্য, মেয়েরা একেবারে নখ, দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে ধর্মের রাক্ষসকে।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;