প্রত্যাবাসনে গরজের অভাব!
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বহু কাজ করেছি। সেই শুরুর প্রতিবেদনটি থেকে আজ অব্দি অনেক সংবাদ লিখলাম। আগামীতেও লিখবো হয়ত। এখনও আশা রাখি জটিল এই সংকটের সমাধান আসবে। কিন্তু এও মনে হয়, সংকট কারা যেন সমাধান করতে চান না! আন্তর্জাতিক ও দেশীয় অনেক স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত যে!
রোহিঙ্গা সংকটের শুরুর সময়টায় কাজ করি বাংলানিউজে। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, দেশের শীর্ষ অনলাইন পোর্টাল সে সময়। নেতৃত্বে ছিলেন, দেশে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের জনক, এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন।
শুক্রবার সকাল। বার্তাকক্ষে তখন। আগের রাতে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতা হয়েছে। একদল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ফাঁড়ি বা তাদের কর্তব্যের স্থানে হামলা চালিয়েছে, এই খবর এলো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে। করলাম নিউজটা। পরে ওই হামলার জের ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর চললো নির্মম নির্যাতন, গণহত্যা। তখন আমরা নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের পক্ষে অবস্থান নিলাম। সাংবাদিকতা বলে জনগণের কথা। সাংবাদিকতা বলে খেটে খাওয়া মানুষের কথা। সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা বলে সাংবাদিকতা। যদি গুটি কয়েক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর জন্য পুরো সম্প্রদায়কে সাজা পেতে হয়, তাহলে বিষয়টা রীতিমতো আরো বড় অপরাধ। মিয়ানমার অপরাধ করতে করতে তা গণহত্যায় রূপ দিলো। সে সময়ের সাংবাদিকতায় উঠে এসেছে অমানবিক সত্য, বর্বরতার চিত্র।
প্রচুর নিউজ করি সে সময়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া ঘেটে ঘেটে কাজ করেছি। একটা পর্যায়ে বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করলো রোহিঙ্গারা। এরপর শুরু হলো কক্সবাজারের টেকনাফ থেকেও সংবাদ সংগ্রহ। সে নিউজগুলোও সেন্ট্রাল ও আন্তর্জাতিক ডেস্ক থেকে দেখা হচ্ছিল। একদিকে গণহত্যা অন্যদিকে লাখ লাখ রোহিঙ্গার ঢল বাংলাদেশে। গাছ কেটে উজাড় হলো প্রিয় টেকনাফ, উখিয়া। বন্য হাতির বাসস্থান বিলিন হতে লাগলো। সবকিছু যখন নিউজের চোখে দেখছি, তখন মনের ভেতরে হতাশা কাজ করতে শুরু করলো। রোহিঙ্গা সংকটের হতাশা। মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল, এলো তো ১০ লাখ যাবে কি এক লাখ? অর্থাৎ ১০ লাখ যে এসেছে এক লাখও কি ফিরে যাবে কখনো? এমন কি কখনও হয়? হলেও বাংলাদেশ পারবে? কত বছরে পারবে? কারণ আগে থেকেই প্রায় চার, সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে অবস্থান নিয়েছে। একজনও যায়নি ফিরে। তাদের মধ্যে বহু মানুষ হয়েছে অপরাধী। এই গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গারাও দিনের সূর্য বদলের সঙ্গে সঙ্গে অসহায় থেকে অত্যাচারী হয়ে উঠবে না- তা কে জানে!
সে সময়ের ভাবনাগুলো মনকে ধসিয়ে দিয়েছিল। হতাশায় ডুবে ছিলাম। দিন গেছে, কমেছে হতাশা। কিন্তু যে কারণগুলোতে হতাশা ছিল, তা আরো স্পষ্ট হয়েছে। তাই এখন মনে কাজ করে ক্ষোভ। মিয়ানমার যেমন খারাপ, রোহিঙ্গারাও কম মন্দ নয়। বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে এ নিয়ে কৃতজ্ঞতা রয়েছে কিছু মানুষের, তবে নেই বেশির ভাগেরই। অনেকে আবার অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। এর পেছনে রয়েছে স্থানীয় অনেক নেতার হাত। তারা মাদকের ব্যবসা করান রোহিঙ্গাদের দিয়ে। ইয়াবা ব্যবসার বড় হাতিয়ার রোহিঙ্গারা। এমনকি নারী ব্যবসা, মানবপাচারের মতো কাজেও রোহিঙ্গা হয় ভিকটিম, নয় নিয়ন্ত্রক বা সহযোগী। অনেক রোহিঙ্গা আবার নিজেই নিজের নেতা। তারা আলাদা জগত গড়ে তুলেছে। কয়টি টাকার জন্য খুন, অপহরণ তাদের কাছে ডাল ভাত। সার্বিকভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে, এই ক্ষোভ কিন্তু নতুন নয়- অনেক দিনের। তবুও কোনো কাজ হচ্ছে না!
বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য সব ধরনের মানবিকতা দেখিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় এতো বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু মুখেই বলা হচ্ছে, সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার প্রত্যাবাসন। কিন্তু কাজে যার কোনো নজির নেই। এটা নিশ্চিত করতে কঠোর হওয়ার সময় কি আসেনি?
কোভিড-১৯ এর জন্য থেমে আছে প্রত্যাবাসনের কাজ। করোনা পরিস্থিতিতে সীমিত পরিসরে সবকিছু চললেও, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসের আলোচনা সীমিত কেনো, এক বিন্দু পরিমাণে হয়নি। ঝিম মেরে বসে থাকলে সংকট কখনোই সমাধান হয় না, হয় আরো গোলমেলে। যেখানে অপরাধী পিচ্ছিল মিয়ানমার, সেখানে তাদের সুযোগ দিলে দেশটি শিং মাছ হয়ে বেরিয়ে হাঙ্গর হয়ে হামলা চালাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট। টানা কয়েক বছর চলে গেলো। টানা যায়নি জের। এতো দিনেও সমস্যার সমাধান করতে না পারার জন্য পররাষ্ট্রনীতিকে দায়ী করেছেন এক সময়ের বিরোধীদল, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সরকারের কড়া সমালোচক এই নেতা বলেন, 'রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পরায়, সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ও দুর্বলতাই দায়ী। এই সংকটের বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত আছে ও মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে চীন ও ভারত। এই দুটি দেশের সঙ্গে কোনো রকমের রফা করার সামর্থ্য এই সরকারের নেই।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ কোনো বৈদেশিক সফরেও যাননি বলে উল্লেখ করেন এই রাজনীতিবিদ। তার কথার যুক্তি আছে। আন্তর্জাতিকভাবে খুব একটা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারলাম কই আমরা!
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও প্রত্যবাসনে উদ্যোগী নয়। তাদেরও এর অংশ করতে হবে। চাপ প্রয়োগের কাজ শুধু সরকার একা করবে না। রোহিঙ্গাদের সেবা দেয়ার থেকেও বড় সেবা হলো, তাদের মূল অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার কাজ করা।
গত বছরের নভেম্বরে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসির) সহায়তায় গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করে। গাম্বিয়ার অভিযোগে বলা হয়, সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার ওপর নৃশংস সামরিক অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিয়ে, হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা, আহত ও নারীদের ধর্ষণ করেছে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধরা। এরপর শুনানি হয়। পরে চলতি বছরের ২৩শে জানুয়ারি নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) গুরুত্বপূর্ণ রায় দেন। রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে থাকা ছয় লাখ রোহিঙ্গা গণহত্যার মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে উল্লেখ করে মিয়ানমারকে গণহত্যা রোধ করতে, প্রমাণাদি ধ্বংস করা বন্ধ করতে ও এ বিষয়ে চার মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। যদিও আইসিজের ওই আদেশ প্রত্যাখ্যান করে মিয়ানমার। আর আমরাও হয়ে পড়ি উদাসীন। কারণ প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কতটুকু জানে পরবর্তী প্রতিবেদনগুলো জমা দেয়ার বিষয়ে?
এই করোনার সময়ও আমাদের উচিত ছিল, গাম্বিয়ার প্রতি সহযোগিতা আরও বাড়ানো। দেশটির সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখা। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, রাখাইন তাদের অধিকার। সেই অধিকার যেন ফিরিয়ে দেয়া হয়, সে বিষয়ে গাম্বিয়াকে পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ ক্রমাগত অনুরোধ করতে পারে, আহ্বান জানাতে পারে। রোহিঙ্গাদের অধিকার ও নিরাপদ প্রত্যাবান বিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করা যেতো ভার্চুয়ালি। কিন্তু কিছুই করেনি বাংলাদেশ।
এ অবস্থায় আগামী ৮ই নভেম্বর মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচন। অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারে যোগ দিতে- নির্বাচনে প্রার্থী হতে আবেদন করেন অন্তত ১২ জন রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদ। জন্মের সময় বাবা-মা মিয়ানমারের নাগরিক ছিলেন এমন প্রমাণ দিতে ব্যর্থতার অভিযোগে তাদের মধ্যে ছয়জনের প্রার্থিতা বাতিল হয়। নির্বাচনের সময় প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা আরও কঠিন হয়ে যাবে। যতদিন যাচ্ছে পানি আরও ঘোলা হচ্ছে। অন্যদিকে আমরা হচ্ছি আরও দায়িত্ব জ্ঞানহীন!
মিয়ানমারের জন্যই প্রত্যাবাসন হচ্ছে না, এই প্রশ্ন তোলার আগে নিজের গরজ নিয়ে ভাবা উচিত। সময় এসেছে, আমাদের এতো বছরের কাজের মূল্যায়ন করার। এক হাতে তালি বাজে না সত্য, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার হাত না থাকলে, তালি বাজাতে বিকল্প হাতের সন্ধান কত দূর?
সৈয়দ ইফতেখার: লেখক, সাংবাদিক।