পরীমণি যেন প্রতিহিংসার শিকার না হন

  • আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

প্রায় সময়ই রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লিখি। আজ একটি সামাজিক বিষয় নিয়ে লিখতে চাই। বিষয়টি নারীর রূপ। পাতিবুর্জোয়া সমাজে রূপ ও সৌন্দর্য নারীর সম্পদ না শত্রু? গত বুধবার (৪ আগস্ট) লন্ডন সময় সকালে হঠাৎ ফেসবুক লাইভে এক নারীর আর্তচিৎকার শুনলাম- আমাকে বাঁচাও। কিন্তু কেউ তার চিৎকারে ছুটে আসছে না। এই নারী (নারী না বলে তরুণী বলাই ভালো। আমার ছোট মেয়ের চাইতেও বয়সে অনেক ছোট) আর কেউ নন বাংলাদেশের ছায়াছবির একজন রূপসী নায়িকা, পরীমণি।

রাজনীতি আমার লেখার উপজীব্য। ছায়াছবি, নায়ক-নায়িকা নিয়ে মাথা ঘামাই না। পরীমণিকে নিয়েও আমার মাথা ঘামানোর কিছু ছিল না; যদি কিছুদিন আগে সাভার বোট ক্লাবে তাকে হেনস্তার অভিযোগে একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তি গ্রেপ্তার না হতেন। অবশ্যই এই ধনী ব্যক্তিকে 'সসম্মানে' জামিন দেওয়া হয়েছে। পরীমণি নামটির সঙ্গে তখনই আমার পরিচয়। তার অভিনীত কোনো ছবিও আমি দেখিনি। সুতরাং তিনি প্রথম শ্রেণির অভিনেত্রী কিনা তাও বলতে পারব না। শুধু পত্রপত্রিকায় তার ছবি দেখেছি।

বিজ্ঞাপন

এই সময় দুটি ঘটনা আমাকে পরীমণি সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। হেনস্তার অভিযোগে পরীমণি মামলা করেছেন ঢাকার এক প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু পুলিশ পরীমণিকেই থানায় ডেকে নিয়ে চার ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমি এ ব্যাপারে একটু ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিকতা করে কিছু ভেতরের খবর জানতে পারি। অন্যদিকে দেখি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে পরীমণির চরিত্র হননকারী খবর ও মন্তব্য বেরোচ্ছে। সহজেই বোঝা যায়, এটা পরীমণির বিরুদ্ধে 'অর্গানাইজড প্রোপাগান্ডা'।

আমি অনেক কথা জেনে পরীমণির অনেকটা সমর্থনে ঢাকার একটি দৈনিকে কলাম লিখি। তখন বুঝতে পারিনি এই কলামটি লিখে আমি ভিমরুলের চাকে আঘাত করেছি। আমার কাছে অনেক 'এবিউজিব টেলিফোন কল' আসতে থাকে। এই হুমকিদাতাদের একজন বলেন, 'তুমি শিগগিরই দেখবে তোমার পরীমণির অবস্থা আমরা কী করি?' আমি পরীমণি সম্পর্কে শঙ্কিত হলাম। অল্প বয়সের সুন্দরী মেয়ে। তার ওপর সিনেমা জগতে পা দিয়েছেন। অল্পবিস্তর পদস্খলন হতেই পারে। তার সুযোগ নিয়ে তাকে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ষড়যন্ত্রের শিকার করতেই পারেন। মেয়েটি রূপের দেমাগে মাথা ঠান্ডা না রেখে বাঘের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বিপদে পড়তে পারেন। তাকে সাবধান করা দরকার।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু তার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, যোগাযোগও নেই। জানতে পারলাম, নাট্যকার চয়নিকা চৌধুরীর সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। বাংলা টেলিভিশনের কর্তৃত্বে আছেন এমন এক বন্ধুর মারফত চয়নিকা চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলাম। তারপর এ ব্যাপারে আর মাথা ঘামাইনি। দু'দিন পরই ঢাকার এক রাঘববোয়াল ধনী ব্যবসায়ী লন্ডনে এলেন। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। তার সঙ্গে দেখা হতেই বললেন, পরীমণিকে সমর্থন জানিয়ে কাগজে কলাম লিখে ভালো করেননি। মেয়েটির চরিত্র ভালো নয়। স্বভাবও ভালো নয়। তার সঙ্গে আপনার নাম জড়িয়ে ভালো করেননি।

বললাম, কারও ব্যক্তিগত চরিত্র বিচার করা আমার কাজ নয়। আমি জানি না পরীমণি ভালো কি মন্দ। তাকে প্রকাশ্য স্থানে হেনস্তা করা হয়েছিল, আমি তারই নিন্দা করেছি। ব্যবসায়ী বন্ধু বললেন, এবার চিরতরে তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেওয়া হবে। হয়তো জেলের ভাতও খেতে পারে। তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা হচ্ছে, তার কিছু কিছু আমি জানি। আমি উৎসুক হলাম। কী ব্যবস্থা হচ্ছে বলুন। তিনি বললেন, 'মুম্বাইয়ের সুন্দরী ২৩ বছর বয়সের নায়িকা চন্দ্রাবতীর পরিণতির কথা আপনার মনে আছে? দারুণ নির্যাতন হয়েছিল তার ওপর। তার প্রতিকার কি হয়েছিল? আজ তার নাম কারও মনে আছে?' মাত্র তো ২০ বছর আগের ঘটনা। আমি ঘটনাটি স্মরণ করার চেষ্টা করলাম। ব্যবসায়ী বন্ধু বললেন, চন্দ্রাবতীর রূপের দেমাগ ছিল। ক্লাবে-টদ্মাবে যেত, মদ, ড্রাগসও সেবন করত এক-আধটু। মুম্বাইয়ের এক ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে (নামটা আর বললাম না) তাকে বাসায় পার্টিতে ডেকে নিয়ে শ্নীলতাহানির চেষ্টা করেছিল। চন্দ্রাবতী বাসায় ফিরে ওই মাড়োয়ারিপুত্রের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। সেও পরীমণির মতো মাড়োয়ারিপুত্রের শক্তির সীমা বুঝতে পারেনি। ওই মাড়োয়ারি রাজনৈতিক ক্ষমতারও অধিকারী ছিল। শহরের এক পুলিশপ্রধানের সঙ্গে তার ছিল গোপন ব্যবসায়ের পার্টনারশিপ।

পুলিশই চন্দ্রাবতীর বিরুদ্ধে চক্রান্তটা সাজায়। চন্দ্রাবতীর বাসায় আর দশজন নায়িকার মতো মদের বোতল ছিল। পুলিশ তার সঙ্গে আরও মদের বোতল এবং মাদকদ্রব্য গোপনে বাড়িতে জমা করে। তারপর আকস্মিকভাবে ওই বাড়িতে পুলিশের হামলা। সাংবাদিকদের ডেকে দেখানো হলো মাদকদ্রব্য এবং যৌনক্রিয়ার নানা সরঞ্জাম। চন্দ্রাবতীকে গ্রেপ্তার করা হলো। কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে চন্দ্রাবতীকে সিনেমা জগৎ থেকে বিদায় নিতে হলো। কলঙ্ক ও দারিদ্র্য নিয়ে তাকে বাকি জীবনটা কাটাতে হয়েছে।

বললাম, ঘটনাটা আমার মনে পড়েছে। তবে সেই হতভাগ্য তরুণীর নাম চন্দ্রাবতী নয়। আপনি নামটি পাল্টে বলেছেন। তিনি ছিলেন মুম্বাইয়ের বলিউডের একজন বিখ্যাত নায়িকা। ব্যবসায়ী বন্ধু বললেন, নামটা ভুলে যাওয়াতে ইচ্ছা করেই একটা নাম বানিয়ে বলেছি। গল্পটা বড় কথা নয়, পরীমণিকে যদি পারেন সাবধান করে দিন। সে যেন মামলা প্রত্যাহার করে।

ব্যবসায়ী বন্ধু চলে গেলেন। বুঝলাম তিনি ওই গ্যাংয়ের লোক। যারা ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছেন পুলিশ ও র‌্যাব পরীমণিকে ধরে কী করে তা দেখার জন্য; তারা সে কথা প্রকাশ্যে বলেছেন এবং আরও বলেছেন, পুলিশের ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট না হলে তারা পরীমণির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করবেন। ভারতে যেসব ধনী ব্যবসায়ীর রাজনৈতিক কানেকশন আছে, তারা ফিল্ম জগতের এবং ফিল্ম জগতের বাইরেরও অনেক তরুণীর সর্বনাশ করে এমনকি হত্যা করে বহাল তবিয়তে থাকেন। বহু বছর আগের মিস ইন্ডিয়া ইন্দ্রানী রহমানকে নিয়ে কী কাণ্ড ঘটেছিল তা স্মরণ হলো। এ জাতীয় অধিকাংশ ঘটনায় পুলিশপ্রধানরা ছিলেন অপরাধী চক্রের অভিভাবক ও ব্যবসায়ী পার্টনার।

আমি পরীমণিকে বারবার সাবধান করতে চেয়েছি। চয়নিকা চৌধুরীকে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছি। তিনি নাকি সময়মতো তা পাননি। তারপর বুধবারের ঘটনা। ফেসবুকে লাইভ দিয়ে পরীমণির আর্তচিৎকার। স্পষ্ট শুনতে পেলাম পরীমণি বারবার বলছেন, আপনারা সাদা পোশাকে কারা এসে আমার দরজায় ভাঙচুর করছেন বলুন। জবাবও শুনতে পেলাম, আপনি দরজা খুলুন। এই কথা কাটাকাটি চলেছে এক ঘণ্টার ওপর। আমি বুঝতে পারলাম না যারা ভেতরে আসতে চাইছেন, তারা নিজেদের পরিচয় না দিয়ে একটা ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছেন কেন? এটা আইনসংগত হয়েছে কিনা তা আইনজীবীরা বলতে পারেন।

পরীমণির পর প্রযোজক-নাট্যকার নজরুল রাজকেও এ অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি বৃহস্পতিবারে এই নিবন্ধটি যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত পরীমণিকে র‌্যাব অফিসে আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমার প্রশ্ন- ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের কোনো নায়ক-নায়িকার ঘরে কি মাদকদ্রব্য পাওয়া যাবে না? কোনো ধনী ব্যবসায়ীর ঘরে কি এর বিরাট স্টক নেই? পরীমণির ঘরে যেসব মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে, তার মধ্যে কয়টি আইটেম বাংলাদেশে বৈধ এবং কয়টি আইটেম অবৈধ?

তারপর বেছে বেছে পরীমণির বাড়িতে হামলা কেন? র‌্যাব বারবার বলছে, 'সুনির্দিষ্ট অভিযোগে'র ভিত্তিতে এই অভিযান চালানো হয়েছে। এই 'সুনির্দিষ্ট অভিযোগকারী' কি বোট ক্লাবে যারা তাকে হেনস্তা করেছিল সেই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও আসামি? ঘরে অতিরিক্ত বৈধ-অবৈধ মাদকদ্রব্য থাকা সম্পর্কে পরীমণি কী বলেছেন অথবা তার কাছ থেকে কী স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে, আমি জানি না। কিন্তু অতীতে মুম্বাইয়ের কোনো কোনো চিত্রাভিনেত্রীকে নিয়ে পুলিশের সাহায্যে যেসব চক্রান্ত হয়েছে, তা থেকে সাবধান হয়ে আমাদের পুলিশ ও র‌্যাব কি সন্ধান নিয়েছে, বিদেশি ও অবৈধ মাদকদ্রব্যগুলো পরীমণির বাড়িতে গোপনে প্ল্যানেড এবং সেখানে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের হাত আছে কিনা?

পরীমণির সঙ্গে প্রযোজক ও নাট্যকার নজরুল রাজের অবশ্যই পেশাদারি সম্পর্ক থাকতে পারে। পরীমণি তার হাত ধরেই ফিল্মের জগতে পা রেখেছেন। নজরুল রাজের সঙ্গে তার অ্যাফেয়ারও থাকতে পারে। সেটাও কোনো অন্যায় নয়। হলিউড, মুম্বাই, কলকাতা এমনকি ঢাকাতেও নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে গোপন প্রেম, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ অহরহই ঘটছে। সেটা কি কোনো অপরাধ? দেখতে হবে নজরুল রাজের অপরাধ সম্পর্কে যে দীর্ঘ তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সঠিক কিনা এবং সেগুলো সঠিক হলে পরীমণি এর সঙ্গে যুক্ত কিনা? তিনি যদি যুক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে যথাযথ তদন্ত ও বিচারের পর আইন অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হোক, তাতে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু দেশে সন্ত্রাস দমনে র‌্যাবের প্রশংসিত ভূমিকা থাকলেও পরীমণির ক্ষেত্রে পুলিশ ও র‌্যাব তাকে আটক করার আগেই বাড়ি ঘেরাও করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তার প্রশংসা করা যায় না। আমি আইনজীবী নই। কিন্তু তাকে আটক করার আগে তার বাড়ি যেভাবে ঘেরাও করা হয়েছে, তাতে মানবাধিকার এবং তার নাগরিক অধিকার দুই-ই নিদারুণভাবে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে।

আমি এক ইংরেজ আইনজীবীকে বিষয়টি জানাতেই তিনি বলেছেন, পরীমণির উচিত ছিল তার একজন উকিলকে আগে ডেকে আনার দাবি জানানো এবং সেই আইনজীবীর সামনে পুলিশকে তার বয়ান বলা। কোনো আইনজীবীর উপস্থিতি ছাড়া তার জবানবন্দি গ্রহণ করা হলে তা জবরদস্তিমূলকভাবে আদায় করা হয়েছে বলে ধরা হবে। তাছাড়া ব্রিটেনে অনুরূপ একটি মামলার জুডিশিয়ারি তদন্তে দেখা গেছে, ভিকটিমকে তার শক্তিশালী প্রতিপক্ষ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পুলিশের সহযোগিতায় চক্রান্তের শিকার করেছে। পরীমণির ঘটনাতেও দেখা যায়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পরীমণি হেনস্তার অভিযোগে মামলা করায় প্রতিপক্ষ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পাল্টা মামলা করতে আগ্রহী। দেশে পর্নো ব্যবসা, নারী ব্যবসা, ব্ল্যাকমেইলিং ইত্যাদি দারুণভাবে বাড়ছে। সেই পাপচক্রের জালে এই অল্প বয়সের তরুণী যদি জড়িয়ে থাকেন, তাহলে তাকে তা থেকে উদ্ধার করা হোক এবং আইন অনুযায়ী তার বিচার ও শাস্তি হোক। কিন্তু কয়েক বছর আগে মুম্বাইয়ের চিত্রজগতে যা ঘটেছিল, এক প্রভাবশালী ধনী ব্যবসায়ী এক সুন্দরী নায়িকাকে তার লালসার শিকার করতে না পেরে তার বন্ধু পুলিশ কমিশনারের সহায়তায় তাকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে যেভাবে তার জীবন ও ক্যারিয়ার ধ্বংস করেছিল, ঢাকায় পরীমণির ক্ষেত্রে সেই ষড়যন্ত্রের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

(লন্ডন, ৫ আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ২০২১)