পরীমণি যেন প্রতিহিংসার শিকার না হন



আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রায় সময়ই রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লিখি। আজ একটি সামাজিক বিষয় নিয়ে লিখতে চাই। বিষয়টি নারীর রূপ। পাতিবুর্জোয়া সমাজে রূপ ও সৌন্দর্য নারীর সম্পদ না শত্রু? গত বুধবার (৪ আগস্ট) লন্ডন সময় সকালে হঠাৎ ফেসবুক লাইভে এক নারীর আর্তচিৎকার শুনলাম- আমাকে বাঁচাও। কিন্তু কেউ তার চিৎকারে ছুটে আসছে না। এই নারী (নারী না বলে তরুণী বলাই ভালো। আমার ছোট মেয়ের চাইতেও বয়সে অনেক ছোট) আর কেউ নন বাংলাদেশের ছায়াছবির একজন রূপসী নায়িকা, পরীমণি।

রাজনীতি আমার লেখার উপজীব্য। ছায়াছবি, নায়ক-নায়িকা নিয়ে মাথা ঘামাই না। পরীমণিকে নিয়েও আমার মাথা ঘামানোর কিছু ছিল না; যদি কিছুদিন আগে সাভার বোট ক্লাবে তাকে হেনস্তার অভিযোগে একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তি গ্রেপ্তার না হতেন। অবশ্যই এই ধনী ব্যক্তিকে 'সসম্মানে' জামিন দেওয়া হয়েছে। পরীমণি নামটির সঙ্গে তখনই আমার পরিচয়। তার অভিনীত কোনো ছবিও আমি দেখিনি। সুতরাং তিনি প্রথম শ্রেণির অভিনেত্রী কিনা তাও বলতে পারব না। শুধু পত্রপত্রিকায় তার ছবি দেখেছি।

এই সময় দুটি ঘটনা আমাকে পরীমণি সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। হেনস্তার অভিযোগে পরীমণি মামলা করেছেন ঢাকার এক প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু পুলিশ পরীমণিকেই থানায় ডেকে নিয়ে চার ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমি এ ব্যাপারে একটু ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিকতা করে কিছু ভেতরের খবর জানতে পারি। অন্যদিকে দেখি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে পরীমণির চরিত্র হননকারী খবর ও মন্তব্য বেরোচ্ছে। সহজেই বোঝা যায়, এটা পরীমণির বিরুদ্ধে 'অর্গানাইজড প্রোপাগান্ডা'।

আমি অনেক কথা জেনে পরীমণির অনেকটা সমর্থনে ঢাকার একটি দৈনিকে কলাম লিখি। তখন বুঝতে পারিনি এই কলামটি লিখে আমি ভিমরুলের চাকে আঘাত করেছি। আমার কাছে অনেক 'এবিউজিব টেলিফোন কল' আসতে থাকে। এই হুমকিদাতাদের একজন বলেন, 'তুমি শিগগিরই দেখবে তোমার পরীমণির অবস্থা আমরা কী করি?' আমি পরীমণি সম্পর্কে শঙ্কিত হলাম। অল্প বয়সের সুন্দরী মেয়ে। তার ওপর সিনেমা জগতে পা দিয়েছেন। অল্পবিস্তর পদস্খলন হতেই পারে। তার সুযোগ নিয়ে তাকে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ষড়যন্ত্রের শিকার করতেই পারেন। মেয়েটি রূপের দেমাগে মাথা ঠান্ডা না রেখে বাঘের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বিপদে পড়তে পারেন। তাকে সাবধান করা দরকার।

কিন্তু তার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, যোগাযোগও নেই। জানতে পারলাম, নাট্যকার চয়নিকা চৌধুরীর সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। বাংলা টেলিভিশনের কর্তৃত্বে আছেন এমন এক বন্ধুর মারফত চয়নিকা চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলাম। তারপর এ ব্যাপারে আর মাথা ঘামাইনি। দু'দিন পরই ঢাকার এক রাঘববোয়াল ধনী ব্যবসায়ী লন্ডনে এলেন। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। তার সঙ্গে দেখা হতেই বললেন, পরীমণিকে সমর্থন জানিয়ে কাগজে কলাম লিখে ভালো করেননি। মেয়েটির চরিত্র ভালো নয়। স্বভাবও ভালো নয়। তার সঙ্গে আপনার নাম জড়িয়ে ভালো করেননি।

বললাম, কারও ব্যক্তিগত চরিত্র বিচার করা আমার কাজ নয়। আমি জানি না পরীমণি ভালো কি মন্দ। তাকে প্রকাশ্য স্থানে হেনস্তা করা হয়েছিল, আমি তারই নিন্দা করেছি। ব্যবসায়ী বন্ধু বললেন, এবার চিরতরে তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেওয়া হবে। হয়তো জেলের ভাতও খেতে পারে। তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা হচ্ছে, তার কিছু কিছু আমি জানি। আমি উৎসুক হলাম। কী ব্যবস্থা হচ্ছে বলুন। তিনি বললেন, 'মুম্বাইয়ের সুন্দরী ২৩ বছর বয়সের নায়িকা চন্দ্রাবতীর পরিণতির কথা আপনার মনে আছে? দারুণ নির্যাতন হয়েছিল তার ওপর। তার প্রতিকার কি হয়েছিল? আজ তার নাম কারও মনে আছে?' মাত্র তো ২০ বছর আগের ঘটনা। আমি ঘটনাটি স্মরণ করার চেষ্টা করলাম। ব্যবসায়ী বন্ধু বললেন, চন্দ্রাবতীর রূপের দেমাগ ছিল। ক্লাবে-টদ্মাবে যেত, মদ, ড্রাগসও সেবন করত এক-আধটু। মুম্বাইয়ের এক ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে (নামটা আর বললাম না) তাকে বাসায় পার্টিতে ডেকে নিয়ে শ্নীলতাহানির চেষ্টা করেছিল। চন্দ্রাবতী বাসায় ফিরে ওই মাড়োয়ারিপুত্রের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। সেও পরীমণির মতো মাড়োয়ারিপুত্রের শক্তির সীমা বুঝতে পারেনি। ওই মাড়োয়ারি রাজনৈতিক ক্ষমতারও অধিকারী ছিল। শহরের এক পুলিশপ্রধানের সঙ্গে তার ছিল গোপন ব্যবসায়ের পার্টনারশিপ।

পুলিশই চন্দ্রাবতীর বিরুদ্ধে চক্রান্তটা সাজায়। চন্দ্রাবতীর বাসায় আর দশজন নায়িকার মতো মদের বোতল ছিল। পুলিশ তার সঙ্গে আরও মদের বোতল এবং মাদকদ্রব্য গোপনে বাড়িতে জমা করে। তারপর আকস্মিকভাবে ওই বাড়িতে পুলিশের হামলা। সাংবাদিকদের ডেকে দেখানো হলো মাদকদ্রব্য এবং যৌনক্রিয়ার নানা সরঞ্জাম। চন্দ্রাবতীকে গ্রেপ্তার করা হলো। কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে চন্দ্রাবতীকে সিনেমা জগৎ থেকে বিদায় নিতে হলো। কলঙ্ক ও দারিদ্র্য নিয়ে তাকে বাকি জীবনটা কাটাতে হয়েছে।

বললাম, ঘটনাটা আমার মনে পড়েছে। তবে সেই হতভাগ্য তরুণীর নাম চন্দ্রাবতী নয়। আপনি নামটি পাল্টে বলেছেন। তিনি ছিলেন মুম্বাইয়ের বলিউডের একজন বিখ্যাত নায়িকা। ব্যবসায়ী বন্ধু বললেন, নামটা ভুলে যাওয়াতে ইচ্ছা করেই একটা নাম বানিয়ে বলেছি। গল্পটা বড় কথা নয়, পরীমণিকে যদি পারেন সাবধান করে দিন। সে যেন মামলা প্রত্যাহার করে।

ব্যবসায়ী বন্ধু চলে গেলেন। বুঝলাম তিনি ওই গ্যাংয়ের লোক। যারা ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছেন পুলিশ ও র‌্যাব পরীমণিকে ধরে কী করে তা দেখার জন্য; তারা সে কথা প্রকাশ্যে বলেছেন এবং আরও বলেছেন, পুলিশের ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট না হলে তারা পরীমণির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করবেন। ভারতে যেসব ধনী ব্যবসায়ীর রাজনৈতিক কানেকশন আছে, তারা ফিল্ম জগতের এবং ফিল্ম জগতের বাইরেরও অনেক তরুণীর সর্বনাশ করে এমনকি হত্যা করে বহাল তবিয়তে থাকেন। বহু বছর আগের মিস ইন্ডিয়া ইন্দ্রানী রহমানকে নিয়ে কী কাণ্ড ঘটেছিল তা স্মরণ হলো। এ জাতীয় অধিকাংশ ঘটনায় পুলিশপ্রধানরা ছিলেন অপরাধী চক্রের অভিভাবক ও ব্যবসায়ী পার্টনার।

আমি পরীমণিকে বারবার সাবধান করতে চেয়েছি। চয়নিকা চৌধুরীকে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছি। তিনি নাকি সময়মতো তা পাননি। তারপর বুধবারের ঘটনা। ফেসবুকে লাইভ দিয়ে পরীমণির আর্তচিৎকার। স্পষ্ট শুনতে পেলাম পরীমণি বারবার বলছেন, আপনারা সাদা পোশাকে কারা এসে আমার দরজায় ভাঙচুর করছেন বলুন। জবাবও শুনতে পেলাম, আপনি দরজা খুলুন। এই কথা কাটাকাটি চলেছে এক ঘণ্টার ওপর। আমি বুঝতে পারলাম না যারা ভেতরে আসতে চাইছেন, তারা নিজেদের পরিচয় না দিয়ে একটা ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছেন কেন? এটা আইনসংগত হয়েছে কিনা তা আইনজীবীরা বলতে পারেন।

পরীমণির পর প্রযোজক-নাট্যকার নজরুল রাজকেও এ অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি বৃহস্পতিবারে এই নিবন্ধটি যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত পরীমণিকে র‌্যাব অফিসে আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমার প্রশ্ন- ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের কোনো নায়ক-নায়িকার ঘরে কি মাদকদ্রব্য পাওয়া যাবে না? কোনো ধনী ব্যবসায়ীর ঘরে কি এর বিরাট স্টক নেই? পরীমণির ঘরে যেসব মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে, তার মধ্যে কয়টি আইটেম বাংলাদেশে বৈধ এবং কয়টি আইটেম অবৈধ?

তারপর বেছে বেছে পরীমণির বাড়িতে হামলা কেন? র‌্যাব বারবার বলছে, 'সুনির্দিষ্ট অভিযোগে'র ভিত্তিতে এই অভিযান চালানো হয়েছে। এই 'সুনির্দিষ্ট অভিযোগকারী' কি বোট ক্লাবে যারা তাকে হেনস্তা করেছিল সেই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও আসামি? ঘরে অতিরিক্ত বৈধ-অবৈধ মাদকদ্রব্য থাকা সম্পর্কে পরীমণি কী বলেছেন অথবা তার কাছ থেকে কী স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে, আমি জানি না। কিন্তু অতীতে মুম্বাইয়ের কোনো কোনো চিত্রাভিনেত্রীকে নিয়ে পুলিশের সাহায্যে যেসব চক্রান্ত হয়েছে, তা থেকে সাবধান হয়ে আমাদের পুলিশ ও র‌্যাব কি সন্ধান নিয়েছে, বিদেশি ও অবৈধ মাদকদ্রব্যগুলো পরীমণির বাড়িতে গোপনে প্ল্যানেড এবং সেখানে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের হাত আছে কিনা?

পরীমণির সঙ্গে প্রযোজক ও নাট্যকার নজরুল রাজের অবশ্যই পেশাদারি সম্পর্ক থাকতে পারে। পরীমণি তার হাত ধরেই ফিল্মের জগতে পা রেখেছেন। নজরুল রাজের সঙ্গে তার অ্যাফেয়ারও থাকতে পারে। সেটাও কোনো অন্যায় নয়। হলিউড, মুম্বাই, কলকাতা এমনকি ঢাকাতেও নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে গোপন প্রেম, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ অহরহই ঘটছে। সেটা কি কোনো অপরাধ? দেখতে হবে নজরুল রাজের অপরাধ সম্পর্কে যে দীর্ঘ তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সঠিক কিনা এবং সেগুলো সঠিক হলে পরীমণি এর সঙ্গে যুক্ত কিনা? তিনি যদি যুক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে যথাযথ তদন্ত ও বিচারের পর আইন অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হোক, তাতে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু দেশে সন্ত্রাস দমনে র‌্যাবের প্রশংসিত ভূমিকা থাকলেও পরীমণির ক্ষেত্রে পুলিশ ও র‌্যাব তাকে আটক করার আগেই বাড়ি ঘেরাও করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তার প্রশংসা করা যায় না। আমি আইনজীবী নই। কিন্তু তাকে আটক করার আগে তার বাড়ি যেভাবে ঘেরাও করা হয়েছে, তাতে মানবাধিকার এবং তার নাগরিক অধিকার দুই-ই নিদারুণভাবে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে।

আমি এক ইংরেজ আইনজীবীকে বিষয়টি জানাতেই তিনি বলেছেন, পরীমণির উচিত ছিল তার একজন উকিলকে আগে ডেকে আনার দাবি জানানো এবং সেই আইনজীবীর সামনে পুলিশকে তার বয়ান বলা। কোনো আইনজীবীর উপস্থিতি ছাড়া তার জবানবন্দি গ্রহণ করা হলে তা জবরদস্তিমূলকভাবে আদায় করা হয়েছে বলে ধরা হবে। তাছাড়া ব্রিটেনে অনুরূপ একটি মামলার জুডিশিয়ারি তদন্তে দেখা গেছে, ভিকটিমকে তার শক্তিশালী প্রতিপক্ষ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পুলিশের সহযোগিতায় চক্রান্তের শিকার করেছে। পরীমণির ঘটনাতেও দেখা যায়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পরীমণি হেনস্তার অভিযোগে মামলা করায় প্রতিপক্ষ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পাল্টা মামলা করতে আগ্রহী। দেশে পর্নো ব্যবসা, নারী ব্যবসা, ব্ল্যাকমেইলিং ইত্যাদি দারুণভাবে বাড়ছে। সেই পাপচক্রের জালে এই অল্প বয়সের তরুণী যদি জড়িয়ে থাকেন, তাহলে তাকে তা থেকে উদ্ধার করা হোক এবং আইন অনুযায়ী তার বিচার ও শাস্তি হোক। কিন্তু কয়েক বছর আগে মুম্বাইয়ের চিত্রজগতে যা ঘটেছিল, এক প্রভাবশালী ধনী ব্যবসায়ী এক সুন্দরী নায়িকাকে তার লালসার শিকার করতে না পেরে তার বন্ধু পুলিশ কমিশনারের সহায়তায় তাকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে যেভাবে তার জীবন ও ক্যারিয়ার ধ্বংস করেছিল, ঢাকায় পরীমণির ক্ষেত্রে সেই ষড়যন্ত্রের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

(লন্ডন, ৫ আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ২০২১)

   

শ্রম অথবা পন্ডশ্রম

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সায়েম খান, লেখক ও কলামিস্ট
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

পৃথিবীর শুরুতে শ্রম ছিল একটি গুরুত্বহীন বিষয়। প্রাচীন মিশরীয় যুগে যে দাসপ্রথার উদ্ভব হয়, সেখানে দেখা যায় মানুষকে দাস হিসেবে বন্দী রাখা হতো ও তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করানো হত। সেটা পাহাড় কেটে প্রাসাদ বানানো কিংবা পাথরের উপর পাথর বসিয়ে পিরামিড বানানো। ক্ষমতার কাছে শ্রম ছিল কুক্ষিগত। এক হিসেবে ধরা যা্য় পর্যবেক্ষণিক অর্থে “দাস” শব্দটি ছিল শ্রমের আদিশব্দ। সময় ও কালের গতিধারায় মানবজীবন পরিবর্তনশীল ও পরিবর্ধনশীল। সভ্যতার ক্রমবিকাশে প্রয়োজনের তাগিদে সৃষ্টি হয় কাজ। আর সেই কাজের জন্য শ্রমের আবিস্কার। গোটা পৃথিবী হয়ে পড়ে শ্রম-নির্ভর। মালিক-শ্রমিক নামক দুটি গোত্রের আবির্ভাব হয় এই শ্রমকে কেন্দ্র করে।

এক দলের কাজের প্রয়োজন, আরেক দলের কাজ করানোর প্রয়োজন। আর সেই থেকে শ্রম বিক্রির ধারণার উদ্ভব হয়। পৃথিবীতে শিল্প-বিপ্লবেরও বহু আগে মানুষের শ্রমের মুল্যায়ন ছিল সস্তা। ইউরোপে কল-কারখানা স্থাপনার পর থেকে ব্যাপকভাবে পুরো সমাজ-ব্যবস্থা হয়ে পড়ে শ্রমিক নির্ভর। কিন্তু শুরুতে আজকের এই আধুনিক সমাজ-ব্যবস্থার মত এতটা শ্রমিক বান্ধব ছিলনা। বেশি সময় কাজ করানো, মজুরি কম দেওয়া, কর্মঘন্টায় মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদ, সব মিলিয়ে গোটা পৃথিবীতে শাষক ও শোষিত নামক দুটি গোষ্ঠী তৈরী হয়। শ্রমিকের মানেই মানবেতর জীবন। ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় গড়ে উঠে ঔপনিবেশিক তত্ত্ব। দরিদ্র হতে থাকে আরও দরিদ্র। ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, মহামারীতে আক্রান্ত হতে থাকে মানুষ। শাষকচক্র তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মেতে উঠে যুদ্ধ-বিগ্রহে। আর তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এই শ্রমিক তথা দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধশ্রম নামে এক নতুন শ্রমের ধারণার উদ্ভব ঘটে। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশের শাষকশ্রেণী পুরুষদের জোর করে পাঠিয়ে দিত যুদ্ধক্ষেত্রে। এজন্য তাদের মোটা অংকের মজুরি প্রদান করা হত। যুদ্ধের পর গোটা পূর্ব ইউরোপে এক ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। তা হল পূর্ব ইউরোপ অনেকটা পুরুষ শুন্য হয়ে গেল। যা আঘাত করল পুরো সমাজ ব্যবস্থায়। এক প্রকার নীরব দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। নারী, শিশু চলে যেতে থাকল ইউরোপের অন্য অংশ। নারীদের মধ্যে দেখা দিল বহুবিবাহ, বহুগামীতা ও পতিতাবৃত্তি। সমাজ-ব্যবস্থায় ছেয়ে গেল এক অশ্লীলতা ।

উনিশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপে শ্রমিক গোষ্ঠির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রম ইতিহাসের বিকাশ ঘটে। পুরো ইউরোপে তখন খন্ড খন্ড শ্রমিক আসন্তোষ, ধর্মঘট ও আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী শ্রম অধিকারের প্রভাব বিস্তার ঘটতে থাকে। আধুনিক যন্ত্রপাতি অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে পশমী বাণিজ্যের সাথে জড়িত শ্রমিকরা ব্রিটেনে লুডিইটস আন্দোলন শুরু করে, যা তৎকালীন সময়ে ব্রিটেনের আলোচিত ঘটনার একটি বলে ধরা হয়। আমেরিকার হেইমার্কেট দাঙ্গা, হোমস্টেড ধর্মঘট, পুলম্যান স্ট্রাইক ইত্যাদি শ্রম অধিকারের ধারাকে সমুন্নত করতে বিশেষ অবদান রেখেছিল। যার ফলে আজ আমরা উদযাপন করি মহান মে দিবস।

রুশ বিপ্লবের সময়কালে নাগরিকদের মানবেতর জীবন যাপন ও অভাব অভিযোগ ছিল সাধারণ ঘটনা। ১৯১৭ সালে শ্রমিক অস্থিরতা ও দাঙ্গার মাধ্যমে এই বিপ্লবে শামিল হয় শ্রমিকরা। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে শ্রমিকদের একাত্বতা ঘোষণার মাধ্যমে রুশ বিপ্লবের সফলতা আসে এবং বলশেভিক (কম্যুনিজম) সরকার গঠিত হয়। কালে কালে, যুগে যুগে, পৌত্তলিক থেকে ঔপনিবেশিক, ঔপনিবেশিক থেকে আধুনিক, সব যুগে সব সময়ে শ্রমিকরা ছিল নিঃগৃহীত, নিস্পেশিত। আর তাই নিজেদের অধিকার আদায়ের ঝান্ডা উঁচিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নতি হয়েছে কিঞ্চিত। তারা তাদের নির্দিষ্ট্ কর্মঘন্টায় মজুরী পায়। কর্মস্হলে পায় তাৃর প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা। কিন্তু এই সুবিধা ভোগকারী শ্রমিকরা হল প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শ্রমিকরা আজও অবহেলিত। শ্রমিক অসন্তোস, কর্মস্থলে বিয়ভিন্ন ত্রুটির কারণে শ্রমিকের মৃত্যুঝুঁকি, শ্রমবাজারে মন্দাভাব ইত‌্যাদি বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর এক নিত্যকার ঘটনা। বাংলাদেশের শ্রমিকদের আজ বিদেশ গমণের প্রবণতা এইসব কারণে।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সূচক উর্ধ্বমুখী হলেও শ্রমিক বান্ধব দেশ হিসেবে আজও আমরা নিজেদের দাবী করতে পারিনি। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা। আর তাই আমরা প্রকারান্তরে শ্রমিকদের দাসই ভেবে থাকি। এজন্যই বাড়ীর কাজের লোক, রিকশা-চালক, দারোয়ান এইসব মেহনতি মানুুষগুলোর মহান মে দিবসে কোন ছুটি নেই।তারা জানেও না এই দিবসটি কি। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তাদের ন্যায্য শ্রম অধিকার।

আগামী পৃথিবীর জন্য রয়েছে শ্রমিকদের জন্য রয়েছে এক ভয়ংকর বার্তা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (ফোর আইআর)। ইংরেজীতে যাকে বলা হয়, The Fourth Industrial Revolution (4IR)। শারিরীক, ডিজিটাল ও জীবতাত্ত্বিক বলয়ের সংমিশ্রণ।তথ্য প্রযুক্তির উন্নতি সাধন, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স আর কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মত বিষয়গুলো এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনা করেছে বলে অনেকে মনে করেন। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে পৃথিবীতে এক অসাম্য ও চরম দারিদ্র্যের সূচনা হবে। রোবট ও যন্ত্রপাতি হবে কল-কারখানার শ্রমিক। স্বল্পদক্ষ শ্রমিকরা গণহারে হবে চাকুরীচ্যুত। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা চরম হতাশাব্যঞ্জক হবে। আমরা চাই শ্রমিকের অধিকার, শ্রমিকের স্বাধিকার। শ্রমিকের ঘাম ঝড়ে হয়েছে জংগল থেকে নগর পত্তন। সুউচ্চ অট্রালিকায় রয়েছে শ্রমিকের হাতের ছোঁয়া। তাবৎ পৃথিবীর উন্নতির অন্তরালে রয়েছে লক্ষ-কোটি শ্রমিকের দেহের ঘাম।

আর তাই মানব সভ্যতা গড়ে উঠার প্রকৃষ্ট হাতিয়ার হল এই দুনিয়ার মজদুর।সবাই বলি, “দুনিয়ার মজদুর এক হও!”

-সায়েম খান, লেখক ও কলামিস্ট

;

মিয়ানমার সংকট

বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে



ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রোহিঙ্গা সংকট প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ বাড়িয়েছে। বিশেষ করে রাখাইন ও চিন রাজ্যে চলমান সংকটে দেশটি সম্পর্কে আমরা অনেক তথ্য জানতে পারছি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি চিন সমস্যা নিয়ে বেশ লেখালিখি হচ্ছে। সেজন্য ভারতের মিজোরাম সম্পর্কেও অনেক নতুন তথ্য আমাদের পাঠক জানতে পারছে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ও রাজ্যগুলো সম্পর্কে পাঠকদের ধারণা আরও স্পষ্ট ও তথ্য সমৃদ্ধ হওয়ার অবকাশ আছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে অশান্ত প্রতিবেশী সৃষ্ট সংকটের কারণে আমাদের শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। মিয়ানমার বাংলাদেশের মধ্যেকার সীমান্তের নিরাপত্তা বর্তমানে মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে হুমকির মুখে রয়েছে ও পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এর পাশাপাশি মিয়ানমার সৃষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যার বোঝা বাংলাদেশ গত সাত বছর ধরে টেনে চলছে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষের কারণে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গোলাগুলির ঘটনায় বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো লাইনে মর্টারশেলের আঘাতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের জনপদে গোলাগুলির কারণে বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় সেখানকার জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। সে সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বারা স্থলসীমান্ত ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, বাংলাদেশের আকাশসীমায় বিমানবাহিনীর অনুপ্রবেশ এবং বাংলাদেশে গুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের মত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা হুমকি তৈরির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। এ ধরনের আচরণ দ্রুত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের অন্তরায় এবং আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি স্বরূপ। এই সংঘাত দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে ও সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চারবার তলব করে প্রতিবাদ জানানো হয়। বাংলাদেশ সে সময় কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে সহিষ্ণু মনোভাব দেখিয়েছিল।

বর্তমানে এই ঘটনার আবারও পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির চলমান যুদ্ধে একের পর এক মর্টার শেলের শব্দে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছে। সীমান্তের ওপারে সংঘর্ষের কারণে এপারের সেন্টমার্টিনসহ টেকনাফের সীমান্ত এলাকার মানুষ আতঙ্কে দিন পার করছে। বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি ও মর্টারশেল বিস্ফোরণের ঘটনায় দুজনের মৃত্যু ও নয়জন আহত হয়। এপ্রিল মাসে নাফ নদীতে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে দুই বাংলাদেশি জেলে আহত হয়, বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে ফেরার পথে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ঘাটে এই গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। সেখানে অবস্থানরত মিয়ানমারের নৌবাহিনীর জাহাজকে বাংলাদেশের পতাকা দেখিয়ে গুলি না করার সংকেত দেওয়ার পরেও তারা তা উপেক্ষা করে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষীর (বিজিপি) কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠায়। ঘটনার ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তার কারণে পরবর্তীতে প্রায় ৩০০ জেলে তাদের নৌকা নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যেতে পারেনি। এছাড়াও বিজিপি সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফে ফেরার পথে একটি যাত্রীবাহী ট্রলার আটক করে প্রায় দুই ঘণ্টা তাদেরকে আটকে রাখে। গুলিতে বাংলাদেশি জেলেদের আহত হওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এসব ঘটনা প্রতিবেশী দেশের মধ্যেকার শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি নষ্ট করছে।

ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর আরাকান আর্মির সাথে বিজিপি’র সংঘর্ষের তীব্রতায় বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফায় মিয়ানমারের ৩৩০ জন বিজিপি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি জাহাজে বিজিপি, সেনাবাহিনী ও শুল্ক কর্মকর্তাসহ ৩৩০ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বিজিবির তত্ত্বাবধানে তাদেরকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয় প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত বিজিপি সদস্যদেরকে বিজিবির তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

আরাকান আর্মির সাথে চলমান সংঘর্ষে মার্চ মাসের বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ আরও ২৮৮ জন মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদেরকে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার দ্বিতীয় দফায় ২৩ এপ্রিল রাখাইন রাজ্যের সিটওয়ে বন্দর থেকে একটি নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠায়। ২৪ এপ্রিল জাহাজটি বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় এসে গভীর সাগরে অবস্থান নেয়। সেই জাহাজে ১৭৩ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয় যারা বিভিন্ন মেয়াদে মিয়ানমারের জেলে বন্দী ছিল। মিয়ানমারের বাংলাদেশ দূতাবাস দেশটির সরকারের সাথে কয়েক দফায় বৈঠক করে তাদেরকে ফেরত পাঠায়। ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী বিজিপি সদস্য, চারজন সেনা সদস্য, ইমিগ্রেশন সদস্যসহ মোট ২৮৮ জনকে বিজিপির কাছে হস্তান্তর করে ও তারা সেই জাহাজে মিয়ানমারে ফিরে যায়। বিজিবি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার বিজিপি, সেনা সদস্য ও অন্যান্যদের মানবিক সহায়তা দিয়েছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগে তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ম নীতি মেনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে যা প্রশংসার দাবি রাখে।

রাখাইনে চলমান সংঘর্ষে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরাকান আর্মির পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের থান্ডওয়ে টাউনশিপে আরাকান আর্মি এবং জান্তা বাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। সংঘর্ষের সময় কাছাকাছি থাকা জান্তা নৌবাহিনী ও আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি চালায়। সেনাবাহিনী এই এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে থান্ডওয়ে টাউনের সমস্ত প্রবেশপথে আরও সামরিক চেকপয়েন্ট স্থাপন করেছে। সামরিক চেকপয়েন্টগুলো বাসিন্দাদের চাল ও জ্বালানি বহনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিটওয়ে এবং চকপিউ টাউনশিপ ঘিরে রেখেছে, তারা অ্যান শহরে জান্তার ওয়েস্টার্ন কমান্ড এলাকার কাছেও আক্রমণ চালাচ্ছে। এর প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনী স্কুল, হাসপাতাল এবং ধর্মীয় স্থানসহ আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকা বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বোমাবর্ষণ করছে এবং পরিবহন, ইন্টারনেট এবং ফোন সংযোগ বন্ধ রেখেছে।

১১ মার্চ আরাকান আর্মি রাখাইনের দক্ষিণে রামরি শহর দখল করেছে। বর্তমানে সংঘর্ষ চলমান অঞ্চলের জনগণ খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক সুবিধার অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের রাজধানী দখলের জন্য অগ্রসর হচ্ছে এবং সংঘর্ষ বিস্তৃতি লাভ করায় বর্তমানে জান্তা রাখাইন জনগণকে ইয়াঙ্গুন ত্যাগ করতে বাধা দিচ্ছে। রাখাইন মিয়ানমারের দ্বিতীয় দরিদ্রতম রাজ্য এবং এখানে পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ না থাকায় প্রায় ৬০ হাজার রাখাইনের অভিবাসী বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে কাজ করে। সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ জারির পরপরই, সরকার রাখাইন থেকে ইয়াঙ্গুনে আসা বিমান যাত্রীদের ওপরও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আরাকান আর্মি এখন পর্যন্ত ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিসহ ১৮০টির বেশি জান্তা ঘাঁটি এবং ফাঁড়ি দখল করেছে। তবে সমগ্র রাখাইনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, সেইসাথে আরও অনেক রক্তক্ষয় হবে।

মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ বিরোধ, রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও সশস্ত্র লড়াইয়ের ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ বাংলাদেশেকে সীমান্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে চাপ দিচ্ছে। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা ২০১৭ সালে জান্তা বাহিনীর নৃশংস দমনপীড়নের শিকার হয়ে রাখাইন থেকে পালিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। চলমান সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা এবং আশ্রিত রোহিঙ্গারাও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বাংলাদেশকে সব সময়ই মিয়ানমারের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উত্তর রাখাইনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা মূলত এই এলাকা থেকেই এসেছে এবং প্রত্যাবাসন শুরু হলে তারা এখানেই ফিরে যাবে। ভবিষ্যতে যাই হউক না কেন এই এলাকা আরাকান আর্মির প্রভাব বলয়ে থাকবে। মিয়ানমারের সংকট ও সংঘাত প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ডের জন্যেও বিপদের কারণ হচ্ছে। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সংঘাত-সহিংসতা সীমান্তসংলগ্ন দেশগুলোর ওপর প্রভাব ফেলছে। রাখাইনে চীন, ভারত, জাপান ও অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও অন্যান্য স্বার্থ রয়েছে। তাদের স্বার্থ সুরক্ষায় দেশগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। চীন জানুয়ারি মাসে আরাকান আর্মি ও সামরিক সরকারের মধ্যে সমঝোতার জন্য বৈঠক করেছে।

ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় প্রতিনিধি আরাকান আর্মির সাথে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করছে। থাইল্যান্ডও সীমান্ত বাণিজ্য চলমান রাখতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ চলমান রোহিঙ্গা সংকট সত্ত্বেও মিয়ানমারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এবং আন্তর্জাতিক আইন কানুন মেনে সুআচরণ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সীমন্ত অঞ্চলে মিয়ানমারের চলমান সংকটের কারণে স্থানীয় জনগণ আতঙ্কে আছে এবং আমাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের আচরণে আমাদের জলসীমায় এখনও বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। মিয়ানমারের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ তাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকার ও বিদ্রোহী উভয়ের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। রাখাইন রাজ্যের স্থিতিশীলতা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আর্থিক, সামাজিক ও নিরাপত্তা সমস্যা মোকাবিলায় এই সংকটের সমাধান জরুরি। চলমান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যুগ যুগ ধরে চলা রাখাইনে ও রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের ইতিহাস তুলে ধরে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি এন ইউ জি ও আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের মত বাংলাদেশকেও নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।

ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন, এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল (অব.) মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক

;

রাজনৈতিক দলের ‘চেইন অব কমান্ড’ ও হাস্যকর বাস্তবতা



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক দলগুলির সক্রিয় অংশগ্রহণমূলক কোনো কর্মসূচি সেই অর্থে নেই বললেই চলে। তবু দেশে সাধারণ মানুষের মাঝে রাজনীতি নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। এর প্রমাণ মেলে গ্রামাঞ্চলে পাড়া-মহল্লার মোড়ে কিংবা বাজারের চায়ের দোকানে। গেল রোজার ঈদের পূর্বে গ্রামের এক বাজারে গিয়ে দেখা গেল চায়ের দোকানের জমজমাট আড্ডা। কোনো আসন খালি না থাকায় পেছনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যা বোঝা গেল-তাতে সারাদিন মাঠে-ঘাটে কৃষি কাজ করা মানুষগুলো দেশের খবরাখবর শহুরে মানুষদের চেয়ে কম রাখেন না!

কোন দলের কোন নেতা কবে কী বলেছেন, কোন নায়িকার সংসার ভেঙে গেছে, ক্রিকেট খেলায় কোন দেশ কাকে হারিয়েছে ইত্যাদি বিতর্ক ছাপিয়ে পুতিন-বাইডেন কি বলেছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধসহ গোটা বিশ্ব পরিস্থিতিই যেন তাদের মুখস্থ! এসব চায়ের স্টলেরও আবার দলীয় পরিচয় আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের জন্য পৃথক স্টল। আর অন্য দলগুলোর সমর্থকরা সবগুলোতে মিলেমিশে থাকেন। আড়াই দশক পূর্বে গ্রাম ছেড়ে আসার যে স্মৃতি তাতে গ্রামের মানুষের এমন রাজনৈতিক সচেতনতা আগে কখনও দেখিনি। গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মূলত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রসারে মানুষের মাঝে এই সচেতনতা এসেছে। চা-স্টলের এসব আড্ডা আবার অনেক সময় সহিংসতাতেও গড়ায়।

এতে করে প্রতীয়মান হচ্ছে-দেশে রাজনৈতিক দলগুলির সক্রিয় কর্মসূচি না থাকলেও সাধারণ মানুষের মাঝে রাজনীতিমনস্কতা বিলীন হয়নি। বরং মিডিয়ার কল্যাণে দেশে-বিদেশে ঘটে যাওয়া সব খবরা-খবরই তারা রাখেন এবং নিজেদের চা-আড্ডায় স্ব-স্ব ভাবনা-চিন্তা উগড়েও দেন। সেখানে দলের সমর্থক হলেও অনেক সময় নিজ দলের কেন্দ্রীয় কোনো নেতার অসংযত বক্তব্য নিয়েও সমালোচনায় ছাড়েন না অনেকে। ‘পাবলিক পার্লামেন্ট’ বলে বহুল শ্রুত যে টার্মটি ব্যবহার করা হয় তা বোধহয় গ্রামের এই চা-স্টলগুলির প্রতিচ্ছবি।

রাজনৈতিক দলগুলিতে রাজনীতিহীনতার মাঝেই আবারও এসেছে এক নির্বাচনী উপলক্ষ্য। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকারের সক্রিয় প্রতিষ্ঠান হতে না পারলেও উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে দলগুলির স্থানীয় নেতাকর্মীদের উৎসাহের কমতি নেই। নির্বাচিত পদ-পদবি হলেই কিছু সুযোগ-সুবিধার অংশীদার হওয়া যায়, সেইসঙ্গে কর্মী-অনুসারীদের প্রতিপালনও করা যায়-যা রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে। এমন বাস্তবতার দৌড়ে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের অনেক নেতাও শামিল হয়েছেন উপজেলা নির্বাচনে। এমপি হওয়ার দৌড়ে যারা ছিটকে পড়েছিলেন, লজ্জাশরম ভেঙে আকাঙ্ক্ষার অবনমন ঘটিয়ে অনেকেই উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছেন।

ক্ষমতার ভেতরে ও বাইরে থাকা দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র ‘হাইকমান্ড’ এর কিছু বক্তৃতা-বিবৃতি এই নির্বাচনকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি কয়েকবার সংবাদ সম্মেলন ডেকে উপজেলা নির্বাচনে দলের কিছু অনুশাসন মেনে চলার ‘কড়া’ নির্দেশনা শুনিয়েছেন। এই কড়া বার্তাটি হচ্ছে, এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের এই উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়া।

গেল কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্ষমতাসীন দলের অন্দরে তো বটেই, গোটা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই এ নিয়ে নানা শোরগোল চলছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও এমপিদের সঙ্গে হাইকমান্ডের অনানুষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত দেনদরবার ব্যাপকভাবেই চলছে। দলের ‘কঠোর অবস্থান’ এর সঙ্গে দ্বিমত ও স্বজনদের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কায় কোনো কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের ঘটনাও নাকি ঘটেছে!

রাজনৈতিক সূত্রের খবর অনুযায়ী, দলের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাকি এও বলেছেন যে, তার ছেলে চেয়ারম্যান না হলে এলাকার উন্নয়নই নাকি হবে না!

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, দেশের অধিকাংশ জেলাতেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অমান্য করে এমপি ও মন্ত্রীদের স্বজনরা প্রার্থী হয়েছেন এবং তাদের প্রার্থিতা বৈধ বলেও ঘোষিত হয়েছে। আমরা বিগত জাতীয় নির্বাচন ও তারও পূর্বে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন, এমনকি উপ-নির্বাচনগুলিতেও বহু নেতাকেই দলের সিদ্ধান্ত অমান্যের কারণে নোটিশ-বহিষ্কার, স্থায়ী বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে দেখেছি। আবার পরবর্তীতে দলের পক্ষ থেকে সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে বহিষ্কৃত নেতাদের দলে ফেরাতেও দেখেছি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে বহিষ্কৃত গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে ফের দলে ফেরানোর সিদ্ধান্তে নেতাকর্মীদের মাঝে বিস্ময়ও পরিলক্ষিত হয়েছে। এমন বাস্তবতায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের হাই কমান্ড থেকে এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনদের প্রার্থী না হওয়ার ‘কড়া নির্দেশনা’ সাধারণ মানুষ, এমনকি মাঠের কর্মী-সমর্থকদের কাছে ‘হাস্যকর’ প্রতিপন্ন হচ্ছে কিনা তাও বোধহয় ভেবে দেখা দরকার।

অন্যদিকে, রাজনৈতিক কর্মসূচিহীন অবস্থায় কিছু সংবাদ সম্মেলন আর বিদেশি কুটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে সীমাবদ্ধ বিএনপি’র দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দলের ৭৩ জনকে বহিষ্কার করেছে। তাদের মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী ২৮ জন, ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ২৪ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী রয়েছেন ২১ জন। দলের হাই কমান্ডের অদূরদর্শী ও হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে দীর্ঘদিন ধরে মাশুল গুণতে থাকা বিএনপি’র নেতা ও কর্মীরা যে অধৈর্য হয়েই দলীয় সিদ্ধান্তের থোরাই কেয়ার করছেন এও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ না পেলে নেতা বা কর্মীদের মাঝে যে এক ধরনের রাজনীতিহীনতা ভর করেছে তা দলটির তৃণমূলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বললে টের পাওয়া যায়।

স্বৈরতন্ত্রের আশ্রয়ে দীর্ঘ সময় দেশ শাসন করা এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির নেতারা স্ট্যান্ডবাজি আর অন্যদলের লেজুড় হতে গিয়ে বর্তমানে এসে এমন গুরুত্বহীন অবস্থায় পর্যবেশিত হয়েছে যে এই দলের নেতাদের কথা মানুষ কতটা গুরুত্ব দেন তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া দলটির অন্তর্কোন্দল এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে দলের বর্তমান প্রধান নিজেই হতাশ। তাহলে সেই দলের কর্মী ও সমর্থকরা কতটা দিশাহীন তা সহজেই বুঝে নেওয়া যায়। সুতরাং উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের প্রবক্তা জেনারেল এরশাদের দলের কোনো ঠিকানাই পাওয়া যাচ্ছে না আসন্ন প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে।

এই অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলির হাই কমান্ডের ‘বিচার-বিবেচনা’ নিয়ে জনমানসে যে ‘হাস্যকর’ অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে তা মোটেও শুভ ইঙ্গিত বহন করে না। যারা দলগুলির সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের এই আত্ম-উপলব্ধি অত্যন্ত জরুরি যে, দেশের সাধারণ মানুষ এখন অনেক কিছুই বুঝতে শিখে গেছেন। গ্রামের সেই ‘পাবলিক পার্লামেন্ট’-গুলোতে প্রতিটি দলের ছোট-বড় সব নেতারই আমলনামার পোর্স্টমর্টেম হয়। ভালো ও সৎ কাজের প্রশংসার সঙ্গে বিতর্কিত ও জনস্বার্থের পরিপন্থি কার্যকলাপের কারণে সংশ্লিষ্টদের পিণ্ডি চটকাতেও তারা দ্বিধা করেন না। সাধারণ মানুষের এসব উপলব্ধি ও মতকে যারা গুরুত্বহীন মনে করে তাদের আত্মচিন্তার প্রসার ঘটাতে তৎপর সেইসব ‘রাজনীতিকদের’ ভবিষ্যৎ যে মোটেও শুভ নয়, ইতিহাস তা বার বার প্রমাণ করেছে। তাই জনগণের কাছে হাস্যাস্পদ হওয়ার কর্ম থেকে দূরদর্শী ও স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চা রাজনীতিতে খুবই জরুরি।

;

এক জায়গায় সবাই একাকার!



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

ছেলেবেলার এক বন্ধু এসেছিল আমাদের বাসায় বেড়াতে। বহুদিন আগে সে এই রাজধানীতে এসেছিল। তখন রাস্তাঘাট এত উঁচুনিচু ছিল না। তাই, বাসা চিনতে তার কষ্ট হতো না।

এবার দুপুর বেলা কমলাপুরে ট্রেন থেকে নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে বাসার কাছাকাছি এসেও বাসা খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই, মোবাইল ফোনে বার বার কল দিচ্ছিল। অটোরকিশাওয়ালা বন্ধুটির অসহায়ত্ব বুঝে ফেলে বোধহয় মওকা খুঁজছিল কীভাবে তার যাত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করা যায়।

আড়াইশ’ টাকার ভাড়া মেটাতে গিয়ে খুচরা টাকা না থাকায় একটি এক হাজার টাকার নোট এগিয়ে দেয়। সে আবার আমাকে কল দেওয়ার সময় অটোরকিশাওয়ালা একহাজার টাকার নোটটি নিয়ে বাকি টাকা ফেরত না দিয়ে দ্রুত অটো চালিয়ে পালিয়ে যায়!

এই, থামো, থামো বলে বাকি টাকা আর ফেরত পাওয়া যায়নি।

এরকম চুরি, ছ্যাঁচড়ামি, হাইজ্যাকিং, প্রতারণা, জালিয়াতি, দুর্নীতি আমাদের সমাজের নিত্যদিনের ঘটনা। এসব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষ বাহিনীরা তদারকিতে দিনরাত ব্যস্ত রয়েছেন। এজন্য বিভিন্ন প্রকারের দুর্নীতিদমনকারী সংস্থার কার্যক্রম প্রচলিত রয়েছে। তাদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে আরো অনেক গোয়েন্দা উইং।

সব ধরনের প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিদর্শন বিভাগ নামক শাখা রয়েছে। কিন্তু দমনকারীরাই যখন দুর্নীতিবাজ হয়ে যায়, তখন সমস্যা আরো জটিলতর রূপ ধারণ করে ফেলে।

সেগুলো পরিদর্শনের জন্য নিয়োজিত রয়েছেন শত শত পরিদর্শক। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে নিজস্ব পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রয়েছে স্কুল, কলেজ পরিদর্শন শাখা-উপশাখা। সহকারী শিক্ষা পরিদর্শকগণ মাঠ পর্যায়ে শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মসূচি তদারকি করে থাকেন। এজন্য তাদের ট্যুর প্রোগাম নির্ধারণ করা হয়।

সংবাদমাধ্যমে দেখা গেছে, এই ট্যুর প্রোগাম ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপার ঘটছে। এসব ট্যুর প্রোগাম করতে যাওয়া বেশ লাভজনক বিবেচিত হওয়ায় এটা বিক্রয় করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

কারণ, এখানে ‘নাই’কে ‘হ্যাঁ’ বা মন্দটাকে ভালো বলে রিপোর্ট প্রদান করলেই আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। ফলে, কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও চাকরি করা যায় অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি, ভবন, খেলার মাঠ, ল্যাবসুবিধা না থাকলেও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি মেলে। এসব অনুমতি মেলার পেছনের শক্তিকে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করে দেন দুর্নীতিবাজ দায়িত্বশীলরা।

দেশে ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে বহুলাংশে পরিচালিত হচ্ছে, বড় বড় নির্মাণকাজগুলো। অনেক ঠিকাদারের ঠিকাদারি সনদ নেই। অনেকের সনদ আছে কিন্তু ভেজাল অথবা ধার করা। এখানে কাজ প্রাপ্তির আগে টাকা ভাগ-বাটোয়ার বিনিময়ে কাজ বাগানো হয়। অভিজ্ঞ একজনের নাম ভাঙিয়ে অনভিজ্ঞ আরেকজন বা বহুজন সেসব কাজের অংশীদার সেজে কাজ করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে তোলেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সমাপ্ত করতে না পেরে সরকারী অর্থের অপচয় ঘটিয়ে বাজে বাড়িয়ে দেবার আন্দোলনের নামে কাজ বন্ধ করে রাখেন।

এটা আমাদের দেশের নির্মাণ সরকারি কাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। এজন্য জাপান বা মালয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের দেশে নির্মাণ কাজের খরচ বেশি গুণতে হচ্ছে।

এখনও নতুন পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে কালক্ষেপণ সমস্যা টাকা ছাড়া সমাধান হবার নজির নেই। সরকারি চাকরি পেতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হেনস্তা হবার ঘটনা আমাদের দেশে স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। এজন্য একজন বিসিএস ক্যাডারকেও প্রমোশনের জন্য ভেরিফিকেশন রিপোর্ট পেতে অবৈধ অর্থ খরচ করার নজির রয়েছে।

কিছুদিন আগে একজন এমপি ঘোষণা দিলেন, তার ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা নির্বাচনি খরচের কথা! যেটা নির্বাচন কমিশনের তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার কথা। কিন্তু নির্বাচনক কমিশন সেটাকে পাশ কাটিয়ে গেছে!

এসব লেখা নিয়ে যখন ভাবছিলাম তখন হঠাৎ মাথায় বজ্রাঘাতের মতো একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকের প্রথম পাতায় সংবাদ শিরোনাম এসে সবকিছু ওলটপালট করে দিলো। তা হলো- র‌্যাবের সাবেক এক মহাপরিচালকের অর্থিক নিয়মের বিষয়টি।

পত্রিকাটিতে নানান অনিয়মসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি, ফ্ল্যাট, স্থাপনা ক্রয় এবং একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট তৈরির জন্য ছবিসহ নানা তথ্য।

পত্রিকাটি আবাদি জমিতে রিসোর্ট তৈরির জন্য লিখেছে, ‘কেনা জমির কয়েকজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্রমাগত চাপ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেন। ভয়ভীতিতে কাজ না হলে ভেকু দিয়ে জমির মাটি নিয়ে যেতেন। গভীর গর্ত করে শেষ পর্যন্ত জমি বিক্রি করতে বাধ্য করতেন। পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন পদে থাকায় তাঁর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি জমির মালিকরা।’

পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়েছে, ‘শুধু তাই নয়, রিসোর্টটির নিরাপত্তায় পাশেই বসানো হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি না হলেও এই রিসোর্টে প্রবেশ স্বাচ্ছন্দ্য করতে সাত কিলোমিটার সড়ক পাকা করা হয়েছে সরকারি খরচে।’

এছাড়া ওয়াসার সাবেক এমডি, কতিপয় সাবেক ভিসি, মহাপরিচালক ইত্যাদির দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির খবর বেশ চাউর হলেও সেগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াতে খুবই ধীরগতি লক্ষণীয়।

এদেশে ছাত্র সংসদের নেতা হওয়া বেশ লাভজনক। তাই ছাত্রনেতা হবার দৌড়ে লবিং, তোয়াজ-তোষণ, তোড়জোর, নির্বাচনি প্রচার খরচের বাহুল্য পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছে কি না তা জানা যায়নি। দেশের টেকনিক্যাল ও গবেষণাধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনীতির বাইরে রাখার আহ্বান কেউ কর্ণপাত করছেন না।

দেশের সিংহভাগ আমলা ও রাজনীতিবিদরা সন্তানদেরকে বিদেশে পড়াশোনার জন্য পাঠান। স্কলারশিপ ছাড়া বিদেশে পড়ার এত টাকা একজন সরকারি চাকুরে কীভাবে জোগাড় করেন!

একসময় রেলে ‘কালো বিড়াল’ ছিল বলে তৎকালীন মন্ত্রী সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সেই কালো বিড়ালের অস্তিত্ব ডিজিটাল টিকিটসহ গোটা রেল পরিবহন ব্যবস্থাপনায় এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, ‘কালো বিড়াল বনের মধ্যে বসতি গেড়েছে’!

কিন্তু আমার তো মনে হয়, ‘কালো বিড়াল’ দেশের সব জায়গায় ওঁৎ পেতে থেকে গোঁফে তা দিচ্ছে। তাদের গায়ে ঢিল ছোড়ার কেউ নেই। কারণ, এই পৃথিবীতে যে যত বড় অপরাধী, তার নেটওয়ার্ক তত বেশি শক্তিশালী। এর সঙ্গে থাকে সমকালীন রাজনৈতিক যোগাযোগ ও ভাগ-বাটোয়ারা অর্থনীতির যোগসাজশ।

পদবিধারী ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা’ চটকদার কথা বলে নানান কায়দায় জাল বিস্তার করে ভয়ভীতি দেখিয়ে অসহায় মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করে নিজেদের ভোগবিলাসের পথ প্রশস্ত করছেন। বিপদ আঁচ করে এসব মাফিয়া স্মার্টরা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আরো বেশি প্রচারে অর্থ খরচ করে ও মেগাদুর্নীতি শুরু করে দিয়েছেন।

দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব বলেন, ‘আইন সবার জন্য সমান। কেউ যদি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন, দুদক তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।’… আইনে প্রভাবশালী নিয়ে কিছু বলা নেই। সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীরও দুর্নীতির বিচার হয়েছে। সুতরাং যে কারো দুর্নীতির বিষয়ে দুদক চাইলে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে পারে।’

এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘… কারো বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির তথ্য উঠে এলে অবশ্যই সরকারকে গুরুত্বসহকারে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরের এ বিষয়ে বিশদভাবে অনুসন্ধানে নামা উচিত।

তিনি আরো বলেন, সরকারের যেকোনো পর্যায়েই চাকরি করুন না কেন, বৈধ উপায়ে কোনোভাবেই এত সম্পদ অর্জন করা সম্ভব নয়।...যদি সত্যিই এত সম্পদের মালিক হয়ে থাকেন, সেটি বিস্ময়কর। ...তার দুর্নীতির পুরো চিত্র উন্মোচন করা উচিত। কারণ আইন সবার জন্য সমান।’

অন্য এক পত্রিকায় বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে ...অনেকে ষড়যন্ত্র বা সন্দেহও প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু তাতে কারো দুর্নীতি কিংবা রাজকীয় আবাসস্থল, রিসোর্ট, বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার এসবকে তো আর বায়বীয় বলা যাবে না। একজন সরকারি চাকরিজীবী, যার মাসিক বেতন এক লাখ টাকাও নয়, তিনি কীভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের এত সম্পদের মালিক হলেন! এমন প্রশ্নের জবাব তো দেশের মানুষ চাইতেই পারে’।

সেদিন এক ভিক্ষুক প্রচণ্ড গরমের মধ্যে দড়িতে পা বেঁধে রাজপথে বস্তা গায়ে গড়াগড়ি দিয়ে শুয়ে থালা পেতে ভিক্ষা করছেন… নিকটস্থ এক দোকানি দীর্ঘসময় সেটা পর্যবেক্ষণ করে তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বললে তিনি রাজী হননি। কিন্তু একটি লাঠি হাতে নিয়ে তাড়া করতেই সেই ভিক্ষুক উঠে দৌড়ে পালিয়ে গেল!

এদের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজ ও মেগা-অপরাধীদের অমিল কোথায়! মিল একজায়গায় অবশ্যই আছে। তা হলো ভিক্ষুকেরা ভিক্ষার পয়সা দিয়ে চাঁদা দেয় মাস্তানদের। আর বড় অপরাধীরা বড় অংকের ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেশের নীতি-নির্ধারকদের।

আসলে ছোট-বড়, ভদ্র, স্মার্ট, সব দুর্নীতিবাজরাই এক জায়গায় সবাই একাকার হয়ে গেছেন! তা হলো, অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন।

স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, চাঁদাবজি, পরিদর্শন, জালিয়াতি, চুরি, ভেজালকরণ ইত্যাদি যেন সবার মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলবাজ অপরাধীরা সবসময় দলের কৃপা ও দয়া পেয়ে ছাড় পাবার নিয়ম আমাদের কৃষ্টিতে নতুন করে বিকশিত হচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে হেডলাইন সংবাদ বের হলেও তাদের বিরুদ্ধে তদন্তেও দুদকের ধীরগতির কথা সংবাদে প্রচরিত হচ্ছে। ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের’ পক্ষে রাজনৈতিকভাবে একচোখা ও দলকানা নীতিও সাড়ম্বরে চালু হয়ে গেছে। তাই, এখন শুধু অপেক্ষা এসব মেগা-অপরাধমূলক ঘটনার প্রেক্ষিতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা দেখার।

*লেখক- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিনE-mail: [email protected]

;