৫ মে! আদর্শের স্রোত পাল্টে দিয়েছে!
বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি ঘটনা রাজনীতির ধারা পাল্টে দিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে পাকিস্তানপন্থীদের অন্তর্ভূক্তিকরণ, ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে সংসদীয় রাজনীতির আরম্ভ, ২০০৩ সালে গ্রেনেড হামলায় বিএনপির প্রতি আওয়ামী লীগের চিরস্থায়ী দ্বেষ সৃষ্টি, ২০১৩ সালের হেফাজত ইসলামীর গণজমায়েতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মৌলবাদের অনুপ্রবেশ; প্রত্যেকটি ঘটনায় রাজনীতির ও আদর্শের স্রোত পাল্টে দিয়েছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি কোন ঘটনা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত ও ক্ষতির সৃষ্টি করে তা হবে ৫ মে হেফাজতের ঢাকা দখলের পরিকল্পনা ৷ প্রধানবিরোধীদল বিএনপি কার্যত ২০০৩ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার পর থেকে আওয়ামী লীগের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে ছিল। আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র না থাকলেও তাদের কার্যক্রমে বোঝাই যাচ্ছিল তারা চায় না বিএনপি টিকে থাকুক। গ্রেনেড হামলায় তারেক জিয়াসহ মন্ত্রী এমপিদের সংশ্লিষ্টতা বিএনপিকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে নৈতিকভাবে দাঁড়ানোর মনোবল যোগাচ্ছিল না। এই বেকায়দা অবস্থায় হেফাজতে ইসলাম বিএনপির জন্য আশার আলো হয়ে আসে।
হেফাজতের উত্থানের পটভূমি একই বছরের শাহবাগের গণজাগরণের মঞ্চের উত্থানের প্রতিক্রিয়াতেই। রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে মাত্র নব্বই দিন আগেই ঢাকার শাহবাগের তরুণ ও যুবকরা কয়েকদিন গণসমাবেশ করে। কাদের মোল্লার ফাঁসিও হয়। যুদ্ধাপরাধে সম্পৃক্ত মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো শাহবাগের প্রতিবাদী যুবকদের 'নাস্তিক' তকমা দিয়ে 'কথিত' নাস্তিকদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দেয়। অভিযোগ রয়েছে, এদের অর্থের যোগানদাতা চট্টগ্রামের সাকা চৌধুরী পরিবার। রাজাকার সাকা নিজেও তখন ফাঁসির অপেক্ষায় দিন গুণছেন। দেশের প্রধান দুইটি মাদরাসা হাটহাজারি ও পটিয়া এই কার্যক্রমে শামিল হওয়ার কথা থাকলেও, অভিযোগ আছে টাকা ভাগবাটোয়ারা সংক্রান্ত মনোমালিন্যে পটিয়া মাদরাসা হেফাজতের কার্যক্রমে নীরব ছিল।
হেফাজতের সে জমায়েতে দেশের প্রায় সব মাদরাসা ও এতিমখানা থেকে লাখ খানেক শিশু কিশোরদের মতিঝিলে তুলে আনা হলো। পুরো ঘটনায় খুশি ছিল বিএনপি। হেফাজত প্রথমে ১৩ দফা দাবি দিলেও, ৫ মে তারা এসে সরকার পতনের ঘোষণা দিলেন। ফলে, যা হবার তাই হলো। সে রাতে সরকার হেফাজতকে প্যাঁদিয়ে বিদায় করলেন। পরদিন মতিঝিলে তাদের পালিয়ে যাওয়ার সময় ফেলে যাওয়া জুতো পড়েছিল।
হেফাজত সেই ঘটনায় পরাজিত হলেও তাতে সরকারি দলের মনোজগতে বিশাল একটি পরিবর্তন হয়। হেফাজত সরকারবিরোধী প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে যায়। সরকারের তখন পর্যন্ত কোন বিরোধীদল ছিল না। তারা আওয়ামী লীগের অলখে গোকূলেই বাড়িয়াছে।
৫ মে, মতিঝিলে কয়েক ঘণ্টার নোটিশে কয়েকলাখ লোক নিয়ে আসা সহজ ব্যাপার নয়। যেকোনভাবেই হোক হেফাজত সেটা করেছে। আওয়ামী লীগও ঝামেলায় যেতে রাজি না। 'ইয়া নাফসি'ফর্মুলায় ক্ষমতায় থাকলেই হলো। দেশে কোন শক্তি দ্বিতীয় হলো আওয়ামী লীগ তা নিয়ে মাথায় ঘামায় নি।
তাছাড়া মোল্লামৌলভীগণ ছোটখাটো ঝামেলা করলেও শেখ হাসিনাকে প্রাণে মেরে ফেলার মতো সাহস দেখায় নি যেটা বিএনপি দেখিয়েছে। মুফতি হান্নান নামে যেই মৌলভী শেখ হাসিনাকে হত্যায় কয়েকবার প্রচেষ্টা চালিয়েছে তিনি আব্দুস সালাম পিন্টু, লুৎফুজ্জামান বাবর বা তারেক রহমানের ভাড়াটে ছিলেন বা চালিত হচ্ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য শত্রু বিএনপি জামায়াতই, এমন ধারণা আওয়ামী লীগের জন্য পোক্ত হয়েছিল আগেই। সুতরাং তারা নিপাত যাক।
হেফাজতের সাথে সমঝোতায় আওয়ামী লীগকে আদর্শত্যাগের মূল্যে এগুতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে মাঠের নেতারাও ইসলামের গুণকীর্তন করেছেন, টুপি পরছেন, নিয়মিত মহল্লার মাহফিলে যাচ্ছেন, ইসলামের সবক দিচ্ছেন ও নিচ্ছেন। আওয়ামী লীগে ব্যক্তিগতভাবে ধর্ম পালনে উৎসাহ থাকলেও প্রকাশ্যে দলগত বৈঠকে সভা সমাবেশে নিজেদের ধার্মিক প্রমাণের চেষ্টা ইতিপূর্বে ছিল না।
এখনকার আওয়ামী লীগ ধর্মের সেবক। জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, চরমোনাই, জাকেরমঞ্জিল বা দেওয়ানবাগীও কম্পিটিশনে পেরে উঠছেনা। শুধু আওয়ামী লীগকেই বলি কেন? হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননকে কয়েক বছর আগে ভক্তিভরে হ্বজব্রত পালনের ছবি ফেসবুকে অনুরাগীরা দিয়ে সাচ্চা মুসলমান প্রমাণ করেছেন। এরপর এই তালিকায় সিপিবির মঞ্জুরুল আহসান খানও যোগ দেন। ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত বিষয়, কিন্তু তাদের হ্বজের সংবাদ গণমাধ্যমে চোখে পড়ার মতোই ছিল। অনেকে নিবৃতে হ্বজ করেন, কেউ জানতেও পারেন। এদের প্রচার এতটা জমেছিল কেন?
আওয়ামী লীগ এ আমলে বাহাত্তুরের সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলো বহাল রাখলেও, জিয়ার প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম মুছে ফেলার সাহস দেখায় নি। হেফাজতের ১৩ দফাও ধীরে ধীরে মেনে নেয়া হল, পাঠ্যপুস্তকে ইসলামি পড়ালেখা সংযোজন করা হল। কথিত ব্লগারদের কিছু গ্রেফতার করা হলো। ধর্মাবমাননার আইনগুলোর প্রয়োগে তৎপর হলো। মাঝে মাঝে পার্কে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট প্রেমিকযুগল গ্রেফতার করে ইসলাম রক্ষা করেন। বিমানবন্দরে লালনের ভাস্কর্য, ঢাকায় জাতির পিতার ভাস্কর্য স্থাপন করলেন না। ছাত্রলীগ রমজানের শুভেচ্ছা জানিয়ে মিছিল করে। আওয়ামী লীগ প্রধানের উপাধি হয় কওমি জননী। এগুলো কোনটিই অপরাধ নয়, কিন্তু আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যে এসব ছিল না।
হেফাজতের ৫ মে,র পর আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শচ্যুতি হয়েছে। আওয়ামী লীগ আবার যেকোন সময় এই আদর্শে প্রত্যাবর্তন করবে না তা নয়, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে হাজার হাজার কর্মীর মননে গেঁথে দেওয়া ইসলামের সেবক হয়ে উঠার আকাঙ্ক্ষা তখন মুছে দেওয়া সম্ভব। আওয়ামী লীগকে একটি অর্ধমৌলবাদী প্রজন্ম নেতৃত্ব দিবে।
আমরা স্বীকার করি বা নাই করি, আওয়ামী লীগের ইতিহাসই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস। আওয়ামী লীগের যখন স্রোতধারা পরিবর্তন হয় পুরো রাজনীতি তথা রাষ্ট্রের স্রোত পরিবর্তন হয়। আওয়ামী লীগ যখন সাম্প্রদায়িক হয় পুরো রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক হয়।
৫ মে আদর্শের গতিপথ পাল্টে দেওয়ার কৃতিত্ব হেফাজতে ইসলামির বটেই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি দায়ী আওয়ামী লীগের আত্মবিশ্বাসহীনতা ও দীর্ঘযুগ ক্ষমতায় থাকার আকাঙ্ক্ষা। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ একটি একটি মৌলবাদী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বুনেছিলেন। হালের আওয়ামী লীগের সেই সাহস নেই। এখনতো এমনও দেখা যায় বঙ্গবন্ধুকেও ইসলামের কান্ডারি প্রমাণে ঢাকার দেয়ালে চিকা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের স্রষ্টা শেখ মুজিব, এমন প্রচার সব দেয়ালেই লেখা হয়েছে। পাকিস্তানের রেখে যাওয়া বায়তুল মোকাররম সোসাইটি ও ইসলামিক একাডেমিকে একত্রীকরণ করে ১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আইন হয়, ইতিহাস এভাবেও বলা যায়, কিন্তু তা বলা হয় না। শেখ মুজিবুর রহমানকে ইসলামের কান্ডারি প্রমাণের চেষ্টা করতেই হবে কেন, একথা বলার লোকও আওয়ামী লীগে নীরব! এটা পরিচয় সংকট নয়, আত্মবিশ্বাসের সংকট ।
আওয়ামী লীগ এখন যে ধর্মীয় ভাবধারার রাজনৈতিক একটি সমাজ সৃষ্টি করছে তাতে তারা দীর্ঘকাল টিকে যাচ্ছে হয়তো, যদি পরাভূত হয় তখন ধর্মীয় ভাবধারার আরেকটি গোষ্ঠীই ক্ষমতায় আসবে। তারা কট্টর মৌলবাদী হতে পারে, আফগানিস্তানের মতো তালেবানিও হতে পারে, আওয়ামী লীগকে ধর্মদ্রোহের বিনাশও করতে পারে। ইসলামী একনায়কতন্ত্রের রাষ্ট্রগুলোতে এটাই ঐতিহ্য। এটা কি আওয়ামী লীগ ভেবেছে?
বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাস ধর্মীয় মৌলবাদ প্রতিহতের ইতিহাস, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করার ইতিহাস। এখন, রাজনৈতিক নেতারাই ভয়ে থাকেন কখন না আবার 'নাস্তিক' ট্যাগ খেয়ে যান। তাই তারা তসবিহ নিয়ে ঘুরেন। ৫ মে বাঙালির রাজনীতির চিত্র পাল্টে দিয়েছে। আপাতত এটাই সত্য।
লেখক: মনোয়ার রুবেল, ফ্রিল্যান্স লেখক।