মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে রুখতে হবে আত্মহত্যা প্রবণতা
‘নিদ্রাহীনতা সহ্য করতে পেরে’ আত্মহত্যা করেছেন এক তরুণ। মেহেদী হাসান নামের ঊনত্রিশের ওই তরুণ ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সহকারী পরিচালক। রাজধানীর পান্থপথের একটি বাসায় তার ঝুলন্ত মরদেহের পাশে ছিল একটি চিরকুট, যেখানে লিখা ছিল—‘নিদ্রাহীনতা আর সহ্য করতে পারতেছি না’। স্রেফ নিদ্রাহীনতায় কেউ আত্মহত্যা করতে পারে? এটাই একমাত্র কারণ?
মেহেদী হাসানের ভাই মনোয়ার হোসেন জানাচ্ছেন, ‘গত বছরের মার্চ মাসে মারা যান তাদের মা। এরপর থেকে ঘুমাতে পারতেন না মেহেদী। ঘুমের জন্য তাকে অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখানো হয়েছে। অনেক কাউন্সেলিং করা হয়েছে। কোনো লাভ হচ্ছিল না। ঘুমের ওষুধ দিলেও একসময় কোনো কাজ হচ্ছিল না। ঘুম না হওয়ার কারণে অনেক ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল। এই মে মাসে দুই থেকে তিন ঘণ্টা ঘুম হয়েছে।’ ভাইয়ের ধারণা, ‘ঘুমের ওই সমস্যার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে জমা হতাশাই তার ভাইয়ের জন্য কাল হয়েছে।’ অর্থাৎ নিদ্রাহীনতা ছিল প্রকাশিত অবস্থা, কিন্তু তিনি ছিলেন চূড়ান্ত রকমের বিষণ্ণ, ভুগছিলেন একাকীত্বে। এই হতাশা-বিষণ্ণতা-একাকীত্বই তাকে ঠেলেছে আত্মহননের পথে।
মেহেদী হাসানের এই আত্মহত্যার সপ্তাহেই এদিকে সিলেটে তিনদিনের ব্যবধানে ঘটেছে তিনটি আত্মহত্যার ঘটনা। গত বুধবার (২৫ মে) সিলেটের এমসি কলেজের নতুন ছাত্রী হোস্টেল থেকে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী স্মৃতি রানী দাসের ঝুলন্ত মরদেহ গত বৃহস্পতিবার জেলার সদর উপজেলার লামা আকিলপুর গ্রামের আব্দুর রশিদ নামের ষাটোর্ধ্ব একজন গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা এবং এর পরেরদিন নগরের একটি আবাসিক এলাকায় এমসি কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সৌরভ দাশ রাহুলের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর বাইরে বিভিন্ন গণমাধ্যম খুঁজলে হয়তো আরও ঘটনা পাওয়া যেতে পারে। এধরনের ঘটনা ও সংবাদ আমরা না চাইলেও ঘটছে, থামছে না মোটেও।
এই ধরনের সংবাদ আসার পর আত্মহত্যার মধ্যে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিচয়ে কিছুটা আলোচনা করি, নয়তো অনেক সংবাদ এড়িয়ে যাই। কিন্তু এই প্রবণতা রুখতে, মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খুব বেশি বিশেষজ্ঞ মতামত চোখে পড়ে না। বলা যায়, অনেকটাই অনালোচিত এই মানসিক স্বাস্থ্য। ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক, কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এসব নিয়ে প্রভাববিস্তারি আলোচনা নেই বললেই চলে। কী কারণে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো ঘটছে, কোন উপায়ে এটা বন্ধ হতে পারে এসব নিয়ে ভাবা উচিত মনোবিজ্ঞানীদের। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্র এধরনের গবেষণা কার্যক্রমকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমরা যতখানি এনিয়ে আলোচনা করি তার খণ্ডাংশ পর্যায়ের উদ্যোগ চোখে পড়ে না!
আত্মহত্যার এই প্রবণতার পেছনে আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক চাপ থেকে বিষণ্ণতা, মানসিক অবসাদ, নির্যাতন, আবেগের কথা মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন। যে কারণে যারাই আত্মহত্যা করছেন তারা স্রেফ একটা সংবাদই হচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়। পুলিশের খাতায় একটা মামলার রেকর্ড পর্যন্তই দায় সারা হয় রাষ্ট্রের! মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা হয় না, এমনকি আলোচনাও হয় না।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থার সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য ফেডারেশন একসঙ্গে কাজ করছে। ২০০৩ সাল থেকে ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ নামে একটি দিবস প্রতিবছরের ১০ সেপ্টেম্বর পালিত হয়েও আসছে। গতবছর এ দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরি করা’। এর আগের বছরের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করা’। ওইসব অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা নানা মতামত দিয়ে থাকেন, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ অংশগ্রহণও করে থাকেন। কিন্তু দিবসি আয়োজন হিসেবেই শেষ পর্যন্ত থাকে ওসব আয়োজন। এনিয়ে এর পর আর কোন আলোচনা কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোন উদ্যোগের খবর আসে না। দিবসের প্রতিপাদ্যের কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, উদ্যোগ নেওয়া হয়নি আত্মহত্যা প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করারও।
আত্মহত্যা অপ্রতিরোধ্য নয়, এটা প্রতিরোধসাধ্য। এজন্যে দরকার সামাজিক আন্দোলন, দরকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, উদ্যোগ। এই সমস্যার মুখে কেবল আমরা একাই নই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্বের নিম্ন আয়ের কোনো দেশেই আত্মহত্যা প্রতিরোধে কোনো কৌশল বা কর্মপন্থা ঠিক করা নেই। নিম্ন মধ্য আয়ের দেশগুলোর ১০ শতাংশ মাত্র দেশে আছে প্রতিরোধ ব্যবস্থা। আমাদের অবস্থান নিম্ন মধ্য আয়ের দেশের পর্যায়ে তবে আমরাও সম্ভবত প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকা দলের একটা অংশ, অন্তত ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যা প্রবণতার বাস্তবতা সেটাই বলছে।
আত্মহত্যাকে সংক্রামক বলেই ধারণা করা হয়। একজনকে দেখে অন্যজন ও পথে পা বাড়ায় বলে মনে হয়। তাই একটা ঘটনার অব্যবহিত পর পরই আরও অনেকগুলোর ঘটনার সংবাদ সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করে। মানুষের আত্মহত্যার এই প্রবণতা বন্ধ করতে তাই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দান, যুব সংগঠনগুলোকে যথাযথ প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসাসহ শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে এটাকে পাঠ্য করার চিন্তা করা যেতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে নিয়ে এসে এটাকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে সরকার একটা জাতীয় হটলাইন চালু করে সেবা দেওয়ার চিন্তাও করতে পারে।
শুরুতে এক তরুণের আত্মহত্যার কথা বলেছিলাম। ‘নিদ্রাহীনতা’ এ আত্মহত্যার কারণ বলা হচ্ছে। কিন্তু এই নিদ্রাহীনতার সমস্যাটা তার ব্যক্তিক। ব্যক্তিগত এই সমস্যায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক প্রভাবজনিত যে সমস্যা সেটা সকলের। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তাকে তার ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে সমাধানের পথ দেখাতে পারেনি। হয়তো সেভাবে কেউ আগ্রহও দেখায়নি। এই অনাগ্রহ কিংবা অবজ্ঞা তাকে ঠেলে দিয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথে।
মেহেদী হাসান কিংবা এমসি কলেজের দুই শিক্ষার্থীসহ নিবন্ধে উল্লেখ বৃদ্ধ যে কারণেই আত্মহত্যা করেন না কেন, তবে তাদেরকে স্রেফ গণমাধ্যমের সংবাদ হিসেবে না রেখে বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের ভবিষ্যতকে মাথায় রেখে আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে গুরুত্ব দেওয়ার দাবি করি।