পরি-সামাজিক মূলধন ও বোধ কি ফুরিয়ে গেল?
হঠাৎ করে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের ওপর আঘাতের ধরণ দেখে মনে হচ্ছে- মার্কিন মুল্লুকে অল্পবয়স্কদের আক্রমণে মানুষ মেরে ফেলার ঘটনা কি আমাদের দেশেও শুরু হয়ে গেল? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ঘটনায় খুনি বা বন্দুকধারীকে মানসিক রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে অনেক ঘটনার জন্য পারিবারিক ও সামাজিক অবহেলা ও নিয়ন্ত্রণহীনতাকে দায়ী করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও কি তাই? আমাদের পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধ ও মূলধন কি ফুরিয়ে গেল?
খেলার মাঠে একজন শিক্ষককে তারই এক ছাত্র ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে উপুর্যপুরি আঘাত করে মাটিতে ফেলে দিলে আশপাশের সবাই কি হা করে তাকিয়ে দেখেছিল? তারা প্রতিবাদ করে থাকলে তার ধরণ দেখার জন্য সাক্ষী কলেজ ক্যাম্পাসের সিসি ক্যামেরা অচল করে রাখা হয়েছিল। সিসি ক্যামেরার বিদ্যুৎ সংযোগ আগে থেকেই বিচ্ছিন্ন করে রাখে তারপর মারপিটের ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে সংবাদে জানা গেল। এসব নানা ঘটনার ব্যাখ্যা শুনে মনে হলো সাভারের আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনার সূত্র অনেকটা দীর্ঘ।
উক্ত কলেজের দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের ছাত্র জিতু। পুরো নাম আশরাফুল আহসান। স্কুলের তথ্যানুযায়ী তার বয়স ১৯। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হাজী ইউনুস আলীর নাতি সে। তার বাবা হাজী উজ্জল বেশ বিত্তশালী ও এলাকার একজন প্রভাবশালী মানুষ। জুন ২৮ তারিখে ঘটনার পর সবার সামনে দিয়ে জিতু পালিয়ে গেলে তার বাবা উজ্জল হাজিকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হয। তারপরদিন জিতুকে গ্রেফতার করা হয় কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে।
প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে- জিতু বেশ বেপরোয়া প্রকৃতির। তার বাবার অনেক জমি ও সম্পত্তি রয়েছে আশুলিয়ায়। এলাকাটি বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ছেয়ে যাওয়ায় সেখানে চাকরিজীবিদের জন্য বাসা ভাড়ার চাহিদা প্রচুর। সেজন্য তাদের জমিতে অনেক মেস, বাসা-বাড়ি তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সেখানে বাইরের মানুষ ভাড়া নিয়ে থাকে। এদের উপর কতৃত্ব খাটাতে ৩০-৪০ জনের গ্যাং ছিল জিতুর। তাদেরকে নিয়ে সে স্কুলের সামনে আড্ডা দিত। মেয়েদেরকে উত্যক্ত করতো, রাতের বেলা দল বেঁধে এলাকায় চলাফেরা করতো। এলাকাবাসী অতিষ্ঠ ছিল তার আচরণে। তার দাদার প্রতিষ্ঠিত স্কুলের শিক্ষক ছিলেন উৎপল কুমার সরকার। তিনি স্কুলের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ছিলেন। এজন্য জিতুকে শাসন করতেন।
কিন্তু জিতু তার শাসন মানতো না। দশম শ্রেণিতে পড়াশুনা করলেও জিতু একটি মেয়ের সাথে প্রেম করতো। এত অল্প বয়সে পড়াশুনা না করে প্রেম করায় তার প্রেমে বাধা দিয়েছিলেন উৎপল কুমার। জিতু সম্পর্কে কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সাইম ইসলাম বলেন, জিতুর সঙ্গে একটি মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। স্যার সেই মেয়ের বাসায় ফোন করে শক্তভাবে বিচার দিয়েছিলেন যেন মেয়েটা জিতুর সঙ্গে না মেশে। এটার ক্ষোভ থেকেই জিতু স্যারকে খেলার দিন পিটিয়েছে।
কলেজের সমাজকল্যাণ বিষয়ের একজন শিক্ষক বলেছেন, জিতু এমনিতেই বখাটে স্বভাবের। সে ছাত্র হিসেবেও বেশি ভালো না। এ ছাড়া, নিয়মিত স্কুলে আসতো না। ছাত্র হিসেবে খারাপ হলেও সে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করতো। স্কুলের নিয়ম-কানুনও মানতো না। এসব নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ অনেকবার বিচারে বসেছিল। উৎপল কুমারসহ তারা অনেকভাবে জিতুকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। এমনকি জিতুর অভিভাবককেও বলেছেন কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি।
স্কুলের পরিচালক জিতুর আত্মীয় হবার সুবাদে কেউই তার অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতো না। সবাই ওর উচ্ছৃংখল আচরণকে নীরবে মেনে নিত। এতো গেল জিতুর কথা। অন্যদিকে নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক শিক্ষককে ধর্মীয় অবমাননার জন্য জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানো হয়েছে। মহানবি (সা.)-কে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যকারী ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে ফেসবুকে নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রের ফেসবুকে পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলেন ওই কলেজের ছাত্র ও স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা। একই ধর্মের হওয়ায় তাকে সাপোর্ট দিচ্ছে- এমন অভিযোগ তুলে স্থানীয়রা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেন। প্রিন্সিপালকে জুতার মালা পরানোর ঘটনা আসলে দুঃখজনক।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, প্রিন্সিপালকে জুতার মালা পরানোর পর হঠাৎ করেই দেখছি, আমরা ফেসবুক নামক যন্ত্রে খুব বেশি নিজের কথা, অন্যের কথা প্রচার করে থাকি কিংবা লাইক দিয়ে থাকি। সেখানে আমরা বলবো...না জেনে না শুনে, নিজের কথা না বুঝে ফেসবুকে কোন উক্তি বা কমেন্টস না করার জন্য আমি পরামর্শ দেবো।’(ইত্তেফাক ২৯.৬.২০২২)। এর একদিন পর নড়াইলের কলেজ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে রিট দায়ের করা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পক্ষে অ্যাডভোকেট পূর্ণিমা জাহান এ রিট দায়ের করেন।
আরও একটি ঘটনা- জুন ২৯, ২০২২ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক শিক্ষিকাকে হেনস্তা করার অভিযোগে একই বিভাগের শিক্ষার্থী আশিক উল্লাহকে সাময়িক বহিষ্কার ও গ্রেফতার করা হয়েছে। আইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আশিক একটি হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, আশিকউল্লাহ দীর্ঘদিন ধরে একাধিকবার শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষার্থীদের সাথে অশোভন আচরণ করে আসছিল। বুধবার সকালে আইন বিভাগের একজন সিনিয়র প্রফেসরকে হেনস্তা করার প্রতিবাদের ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন করেছে। নগরীর মতিহার থানায় ওই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে একটি মামলা করা হয়েছে। পরে সন্ধ্যায় পুলিশ আশিক উল্লাহকে গ্রেফতার করেছে।
এসকল ঘটনা শিক্ষা সহায়ক পরিবেশ বিরুদ্ধ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি সুসম্পর্ক বিরাজমান না থাকে তালে সেখানে সুশিক্ষাদান সম্ভব নয়। হঠাৎ করে কি এমন হলো যে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ওপর বিরাগভাজন হয়ে গেল?
দেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ঢেউ লাগার পর থেকে তেমন কোন পরিবর্তন অন্তত: শিক্ষাখাতে লক্ষ্য করা যায়নি। তবে করোনাকালীন দু’-আড়াই বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।
শিশু কিশোরদের পারিবারিক ও নৈতিক অবক্ষয় সারা পৃথিবীর সকল সমাজে আঘাত করেছে। সেটা তাবৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও আঘাত করেছে। অনলাইন পাঠদান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে। এটা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি সৃষ্টি করেছে। এছাড়া আমাদের মতো দেশে শিক্ষার্থীরা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে নৈতিকতা শেখে না। শিশু, কিশোর ও নবীনরা প্রচলিত অবাধ ঘুষ, দুর্নীতি, মিথ্যা, জোচ্চুরির মতো বিষয়গুলো সমাজে ও পরিবেশ থেকে শিক্ষালাভ করে। রাষ্ট্রের বড় বড় মহারথীদের মুখ থেকেও মাস্তানি, হত্যার হুমকি, আস্ফালন ইত্যাদিসহ নানা কটূক্তিকর ভাষা শেখে। এত তারা আরো বেশি আস্কারা পায়। এগুলো আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূলধনকে দ্রুত নিঃশেষ করছে। এগুলোকে আর বেশি ফুরোতে দেওয়া যাবে না।
তারা দেখে আমাদের দেশের বড় বড় মহারথীরা চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি করে আস্ফালন করে। তারা অপরকে কটূক্তি করে আরও বাহবা পায়। তাদের কোন শাস্তি হয় না। ইয়াবা সম্রাট চিকিৎসার নামে জেল থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের বেডে বছরের পর বছর আয়েশ করে কাটায়। কিন্তু ইয়াবার পুরিয়া বিক্রিকারীরা জেল খাটে। জ্ঞান নির্ভর না হয়ে অঙ্গুলির হেলানে তোষণ ও তোষামদে নীতিগ্রহণ ও কাজ-কারবার চলে। দুর্নীতিবাজরা সরকার ঘোষিত জিরো টলারেন্সকে অবজ্ঞা করে, ভয় পায় না।
ধনীর দুলালরা ঘরে-বাইরে আতু আতু প্রশ্রয়ে বড় হয়। বড় ভাইদের মদদে মাস্তানি করতে চরম দুর্ধর্ষ হয়ে উঠতে ভয় পায় না। তারা অসামাজিক হয়ে ওঠায় নৈতিকতাকে প্রশ্রয় দেয় না। সেসব দুলালরা দলবাজি, গ্যাংবাজির সুবাদে হয়ে উঠে মারমুখী, বেপরোয়া ও এক সময় শিক্ষাগুরুর ঘাতক। সাভারের কলেজ শিক্ষক উৎপল কুমার হত্যার ঘটনা এর বাইরের বেশি কিছু কি?
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।