বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে সংকুচিত জবাবদিহির ক্ষেত্র
জেলা পরিষদ নির্বাচনে অন্তত ১৯ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিনে জানা গেল একক প্রার্থী অন্তত ১৯ জেলায়। নিয়ম অনুযায়ী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে তাদেরকে নির্বাচিত ঘোষণার কথা রয়েছে।
স্থানীয় সরকারের অন্যতম প্রতিষ্ঠান জেলা পরিষদ। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনের পর আগামী ১৭ অক্টোবর হতে যাচ্ছে এর দ্বিতীয় নির্বাচন। কী কারণে দরকার স্থানীয় সরকারের এই প্রতিষ্ঠান, কী তাদের কাজ এনিয়ে আছে নানা আলোচনা। জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত না হওয়া এই পরিষদ গঠিত হয় নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে যেখানে ভোটার হিসেবে থাকেন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। তিন পার্বত্য জেলা বাদে দেশের বাকি ৬১ জেলা পরিষদের এই নির্বাচনে এবার ভোটার সংখ্যা ৬৩ হাজারের বেশি।
১৯ জেলায় চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী থাকায় আসছে নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ ভোটারের চেয়ারম্যান পদে ভোট দেওয়া লাগবে না। তবে ৬১ জেলা পরিষদেই সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ভোটগ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন। ১৫ সেপ্টেম্বর মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিনে চেয়ারম্যান পদে ১৬২, সাধারণ সদস্য পদে ১৯৮৩ এবং সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ৭৫১ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ১৮ সেপ্টেম্বর যাচাই-বাছাই শেষে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সুযোগ থাকছে প্রার্থীদের। এতে আরও কিছু জেলায় চেয়ারম্যান পদে কেউ প্রার্থিতা প্রত্যাহার হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!
নির্বাচন কমিশনের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন সিলেট, মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝালকাঠি, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, নারায়ণগঞ্জ, ফেনি, বরগুনা, বাগেরহাট, ভোলা, মাদারীপুর, মুন্সিগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, লালমনিরহাট, শরিয়তপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদের আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। এটা ব্যক্তিগতভাবে তাদের জন্যে ঝুঁকিহীন এক অর্জন হতে যাচ্ছে হয়তো কিন্তু সামগ্রিক দিক চিন্তা করলে এটা সুখকর কোনো উদাহরণ নয়। এমনিতেই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক সারাদেশে। এই বিতর্ক উসকে দেওয়ার শুরুটাও হয়েছে ওই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচিত হওয়া নিয়ে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের জোটের মনোনীত প্রার্থীরা। সে নির্বাচনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশ নেয়নি।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার উদাহরণ নতুন কিছু নয়, তবে সংখ্যায় এটা আলোচনায় আসার মতো কোনোকালেই ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এটা একদিকে যেমন নির্বাচনের প্রতি মানুষের অনীহা, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা কি নয়? আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা ওইসব এলাকায় নির্বাচিত হচ্ছেন ঠিক, কিন্তু নির্বাচন-ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক কি জোরদার হচ্ছে না?
যে সব জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী সেসব জায়গায়ও একাধিক ব্যক্তি মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন, কিন্তু জমাদানের সময়ে অনেকের খোঁজ মিলল না। এখানে পর্দার অন্তরালে দেন-দরবারের ঘটনা কি উড়িয়ে দেওয়া যায়, অনাকাঙ্ক্ষিত চাপের প্রসঙ্গ কি একেবারেই ছিল না? ধরে নিলাম কেউ চাপে ছিল না, নিজ থেকে অনেকেই শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল করেছে, তবু নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফেরাতে কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকারের এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে বেশি সংখ্যক প্রার্থীর সমাবেশ ঘটানো দরকার ছিল। আওয়ামী লীগ উদ্বুব্ধকরণের এই কাজ করতে পারত। নির্বাচনের প্রতি আস্থা ফেরাতে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এক নির্বাচনের পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে এখানে তারা ভূমিকা পালন করলে লাভ ছাড়া ক্ষতির সুযোগ ছিল না।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ নেই, নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা নেই, নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে সেটাও সন্দেহের দোলাচলে। সবশেষ দুই নির্বাচন এবং বিগত নির্বাচন কমিশনের কীর্তিকলাপের প্রতি মানুষ বিরক্ত। এসব বিবেচনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিছুটা দায়িত্ব নিতে পারত। সেটা তারা করেনি। এখানে যদিও তাদের বাধ্যবাধকতা নেই, তবু নৈতিক দায়িত্ব বলে যে কথা তা লিখিত থাকে না কোথাও; সেটা অন্তত করতে পারত দলটি। এখানে দায়িত্ব যদিও নির্বাচন কমিশনের, তবু দেশে নির্বাচনের পরিবেশের নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব কিন্তু সরকারের। কম গুরুত্বপূর্ণ একটা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন নিয়ে সরকার উদ্যোগী হয়ে এই নির্বাচনকেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে পারলে দিনশেষে তারাই লাভবান হতো।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাওয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১৯। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত এটা বাড়ুক কিংবা না-ই বাড়ুক শতাংশের হিসেবে এটা ৩১-এর বেশি। অর্থাৎ এসব এলাকায় চেয়ারম্যান প্রার্থীদের তাদের নির্বাচকমণ্ডলীর মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। ভোটের জন্যে জনপ্রতিনিধিদের কাছাকাছি গেলে তাদের দায়বদ্ধ হতে উদ্বুব্ধ করত, জবাবদিহির ক্ষেত্র তৈরি হতো। নির্বাচিত হতে যাওয়া সকলেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য পর্যায়ের নেতা। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এই হিসেবে প্রান্তিক পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের কাছে পেলে তাদের সমস্যা-সম্ভাবনার বিষয়টিও আলোচনা করতে পারত। কিন্তু এটা এখন আর হচ্ছে না। দূরে থাকা বেশিরভাগ নেতা তাদের থেকে আরও দূরে যাওয়ার পথ রচনা হচ্ছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে।
নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ব্যতিরেকে যারাই নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন তারা ব্যক্তিগতভাবে স্বস্তি পাচ্ছেন হয়তো কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশের বিকাশের জন্যে এটা সহায়ক নয়, বরং তা প্রতিবন্ধকই। ভোটে নির্বাচিত আর ভোট ছাড়াই নির্বাচিত এ দুই থেকে তারা যেভাবেই দায়িত্ব পাক না কেন এতে তাদের পদবি-জনিত মর্যাদার হেরফের হবে না সত্য, তবে জবাবদিহির ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। তারা দায়িত্ব পাচ্ছে, কিন্তু দায়িত্ববোধ কতখানি জাগ্রত হবে এনিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
যারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন তারা যদি প্রার্থিতায় আগ্রহীদের কারও প্রতি অপ্রকাশ্য হলেও অযাচিত কোন চাপ না প্রয়োগ করেন তবে হয়তো তারা নৈতিকভাবে দুর্বল হবেন না, তবে তাদের নির্বাচিত হওয়ার ধরণের সঙ্গে কিছু প্রশ্ন লেগেই থাকছে। সরকারও হয়তো এজন্যে দায় নিতে চাইবে না, পুঁথিগতভাবে হয়তো তাদের দায় দেওয়াও যাবে না, কিন্তু দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে যে প্রশ্ন সে প্রশ্নের যৌক্তিক ভিত্তি কি দিচ্ছে না জেলা পরিষদের এই নির্বাচন? ৬১-র মধ্যে ১৯টি জেলা পরিষদেই চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন লাগছে না, এটা কি আমাদের সামগ্রিক নির্বাচন-ব্যবস্থার গরিবি হাল নয়? জেলা পরিষদ নির্বাচনও আমাদের দুর্বল দিক প্রকাশ্য করে দিচ্ছে!
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।