বেপরোয়া ইউএনওদের থামান!

  • কবির য়াহমদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

ফের আলোচনায় এসেছেন এক ইউএনও। বান্দরবনের আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেহরুবা ইসলাম একটা ফুটবল টুর্নামেন্টে অতিথি হয়ে এসে পুরস্কারের ট্রফি ঘোষণা দিয়ে আছাড় মেরে ভেঙেছেন। খেলায় দুপক্ষের বাদানুবাদ হতে পারে, বিজয়ী-বিজিত নির্ধারণে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু প্রধান অতিথি হয়ে আসা মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার এমন আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত, অশোভন; ঔদ্ধত্য বললেও অত্যুক্তি হয় না। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়েও তিনি উপস্থিত অগণন জনতার প্রতি স্পষ্টতই অসদাচরণ করেছেন, তাদেরকে অসম্মান করেছেন।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে উপজেলার চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের মাংতাই হেডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে আবাসিক স্বাধীন যুব সমাজের উদ্যোগে জুনিয়র একাদশ বনাম রেপারপাড়া বাজার একাদশ ফুটবল টিমের ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেহরুবা ইসলাম। সমাপনী খেলায় ৭০ মিনিট খেলার পর ড্র হয়ে যায়। এ কারণে রেফারি দুই দলকে টাইব্রেকার খেলার সিদ্ধান্ত দেয়। খেলায় ৪টা টাইব্রেকারে আবাসিক জুনিয়র দলের ৩টা গোল হয় এবং টাইব্রেকারে রেপার পাড়া একাদশের একটা গোল হয়। খেলার নিয়ম অনুযায়ী আবাসিক জুনিয়র একাদশ চ্যাম্পিয়ন এবং রেপার পাড়া একাদশ রানার্স আপ হয়। এরপর প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেহরুবা ইসলাম বলেন, ‘খেলায় হার জিত থাকবে। এতে কারও মন খারাপের কারণ নেই।’ তিনি উপস্থিত জনসাধারণের কাছে খেলার ফলাফলে সন্তুষ্ট কিনা জানতে চাইলে কয়েকজন খেলার ‘ফলাফল মানি না’ বলাতে ইউএনও ক্ষিপ্ত হন। এরপর তিনি খেলার চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্স আপ ট্রফি ভেঙে ফেলেন। এ সংক্রান্ত ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে ইউএনওকে ট্রফি ওপরে তুলে টেবিলে আছাড় মারতে দেখা যায়। [ইত্তেফাক, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২]

বিজ্ঞাপন

গ্রামাঞ্চলে ফুটবল খেলায় এমনিতেই প্রতিপক্ষরা বিতর্কে জড়ায়, হাতাহাতি-মারামারির ঘটনা পর্যন্ত গড়ায়। টাইব্রেকারে ফল নির্ধারণ অনেক ক্ষেত্রে অনেকেই মানে না, অর্থাৎ ওখানে যা হয়েছিল তার কোনোটাই অস্বাভাবিক নয়। আয়োজকরা শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে বিজয়ী ও বিজিত নির্ধারণ করেন। কিন্তু ইউএনও মেহরুবা ইসলাম মাঠের বিবাদের সমাধান করতে তো পারেনইনি বরং যা করেছেন তাতে তার পেশাগত অবস্থান ও মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদীনের ভাষায় ইউএনও বক্তব্যকালে কেউ কেউ ‘ব্যাড সাউন্ড’ করায় ক্ষুব্ধ হয়ে ট্রফিগুলো ভেঙে ফেলেন।

ইউএনওর এই ট্রফি ভাঙার ভিডিয়ো সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, একাধিক গণমাধ্যম এনিয়ে প্রতিবেদন করেছে। আলোচনা চলছে, প্রতিবাদ করছেন অনেকেই। ভিডিয়োচিত্র থাকায় এটা নিয়ে আলোচনা এতদূর এসেছে, তা না হলে প্রান্তিক সেই সংবাদ প্রান্তেই থেকে যেত। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও জানা যেত না, হয়তো একজন সরকারি কর্মচারীর বেপরোয়া আচরণ ওখানেই সীমিত থাকত। প্রত্যক্ষদর্শীরাই কেবল মুখ বুজে সহ্য করে বাড়ি ফিরত। হ্যাঁ, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সবাই ফিরেছে। এছাড়া আর উপায় কী যেখানে ক্ষমতা সেখানে আমজনতা আদতে অক্ষমই!

একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তার বক্তব্যকালে উপস্থিত লোকজনের কথাবার্তায় কেন বিরক্ত হবেন, কেন তিনি এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন? যেখানে যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে সন্তোষজনক সমাধানের পথ নির্দেশের দায়িত্ব তার সেখানে তিনি কেন এভাবে উত্তেজিত হবেন? এটা কি তার পেশাগত দক্ষতার অভাব, পরিস্থিতি শান্ত করার মানসিকতা না থাকার প্রভাব, নাকি ঔদ্ধত্য? যেখানে তার দায়িত্বই ছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে একটা সন্তোষজনক সমাধান, সেখানে তিনি যা করেছেন সেটা স্রেফ ঔদ্ধত্য ছাড়া আর কী!

বিজ্ঞাপন

আলীকদমের ইউএনওর ঔদ্ধত্য কি কেবলই এখন? না, দেশের নানা প্রান্তে এমন ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে আসে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ‘স্যার’ না বলায় হেনস্তা করার উদাহরণ নতুন নয়। কেবল ইউএনওদের কেউ কেউ নয়, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের অনেকের মধ্যে এমন নাক উঁচু ভাব বিদ্যমান। এসবের কিছু গণমাধ্যমে আসে, অনেকগুলো আড়ালেই থেকে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে, যেখানে মাঠপ্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হয়েও তারা আইন নিজের হাতে তুলেছেন, আইন অমান্য করেছেন, জনতার প্রতি অভব্য আচরণ করেছেন। গত বৃহস্পতিবার বগুড়া সদরের ইউএনও সমর পাল নৈশপ্রহরী আলমগীর হোসেনকে লাঠিপেটা করে তার হাত ভেঙে দেন বলে অভিযোগ এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে গত জুলাইয়ে কক্সবাজারের টেকনাফের ইউএনও মোহাম্মদ কায়সার খসরু স্থানীয় সাংবাদিক সাইফুল ফরহাদকে গালিগালাজ করেন। একই মাসের ৯ তারিখে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময়ে মানিকগঞ্জ সদরের ইউএনও রুনা লায়লাকে ‘ম্যাডাম’ না বলে ‘আপা’ বলে সম্বোধন করায় ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাসকে লাঠিপেটা করে তার সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যরা। এপ্রিলে নেত্রকোনার কলমাকান্দার ইউএনওকে ‘স্যার’ না বলায় লাঠিপেটার শিকার হন এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র। সূত্র: ডয়চে ভ্যালে।

এগুলো সামান্য উদাহরণ, নিকট অতীতের উদাহরণ। গণমাধ্যমে এসেছে বলে আলোচিত হচ্ছে। এরবাইরে অনেক খবর গণমাধ্যমে আসে না। কেন আসে না এর দায় কিছুটা আবার ওই গণমাধ্যমেরও, কারণ যত নিউজ তারচেয়ে বেশি ‘নিউজ কিল’ হয় বলে একটা অভিযোগ আছে, সে বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা অধিকাংশই এড়িয়ে যান। এতে প্রকৃত তথ্য অনেক সময় উঠে আসে না বলে ধারণা। তবে আলীকদমের ঘটনা হাজারো মানুষের সামনে হওয়ায় এখানে সামাজিক মাধ্যমের প্রবেশ ঘটেছে, ভিডিয়োও প্রকাশ হয়েছে সঙ্গে সঙ্গেই। তাই নিউজ কিলিং বাস্তবতাকে চাপা দিয়েছে সামাজিক মাধ্যম।

দেশে পাঁচশ’র কাছাকাছি উপজেলা রয়েছে। সব উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা যে নিবন্ধে উল্লেখ ইউএনওদের মতো আচরণ করেন না এমনও না। সবাইকে একপাল্লায় মাপা যাবে না ঠিক, কিন্তু যখন কেউ কেউ বিধিবহির্ভূত কিছু করে থাকেন এবং নানা জায়গায় নানা সময়ে একের পর এক বেপরোয়া ভাবের প্রকাশ ঘটে তখন আমরা না চাইলেও পদবি-প্রতিষ্ঠানের উপরই গিয়ে দায় পড়ে। ইউএনওদের রিপোর্টিং অথোরিটি কি এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে? প্রশ্ন আছে। উত্তর অজানা। তবে দায়িত্বশীলদের কঠোর ভূমিকার উদাহরণ থাকলে এমন ঘটনা বারবার ঘটত না বলে আমাদের ধারণা।

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কী হয় কিছু ক্ষেত্রে এটা অজানা নয়। কুড়িগ্রামের ডিসি মোছা. সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে একটা সংবাদ যাওয়ায় মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে কারাদণ্ড দিয়ে আলোচনায় আসা ডিসি ও রেভিনিউ ডেপুটি কালেকটর (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন বিভাগীয় শাস্তির মুখে পড়েছিলেন। এরপর তারা পৃথকভাবে শাস্তি মওকুফের আবেদন করে সফল হয়েছিলেন। এতে কী প্রমাণ হয়? প্রমাণ কি হয় না যত বড় ঘটনাই হোক না কেন এর পরিণতি একটা বিভাগীয় শাস্তি এবং এটা আবার মাফ করানোও যায়! তার উপর আছে ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ নামের তাদের সংগঠন। অনেকেরই বিস্মৃত হওয়ার কথা না বরিশালের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লার সঙ্গে স্থানীয় ইউএনওর বিবাদের পর কীভাবে প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছিল এক বিবৃতির মাধ্যমে। যদিও শেষ পর্যন্ত রফা হয়েছিল, কিন্তু ওই ঘটনা কি মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ সকল স্তরে প্রভাব ফেলেনি? এছাড়া আছে গত এক দশকের দেশের সামগ্রিক অবস্থা যেখানে জনতার কথা বাদই দিলাম কোণঠাসা খোদ আওয়ামী লীগ; সর্বেসর্বা প্রশাসন। আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচি বলতে গেলে নেই দেশে, সরকারি কর্মসূচির আদলে যা কিছুই পালিত হয় সেখানে কেন্দ্রবিন্দুতে প্রশাসনের নানা স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এগুলো কি বাড়াবাড়িতে কিছুটা হলেও সহায়ক হয়নি?

নাগরিকদের সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিধিমালা বলে শাস্তির কথা। বিধিমালা যদি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন না হয় তবে এধরনের অশিষ্ট আচরণ চলতেই থাকবে। যেখানে বেপরোয়া আচরণ সেখানেই দায়িত্বশীলদের কঠোর ভূমিকা আশা করি। তা না হলে এটা বাড়তেই থাকবে!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।