একচোখা সমাজে অনিশ্চয়তায় যে শিশু

  • কবির য়াহমদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

শাকিব খান ও শবনম বুবলি নিয়ে ব্যস্ত গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম। নানা রকমের ইঙ্গিতবহ সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আলোচনায় আসছে আরও অনেকের নাম। এসবের যতটা না সংবাদ, তার চেয়ে বেশি গল্প। সামাজিক মাধ্যমে যেহেতু ব্যবহারকারীরা নিজেই সর্বেসর্বা; সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই নেই নিয়ন্ত্রণ। গণমাধ্যমে প্রতিবেদক, সম্পাদকের আলাদা জায়গা রয়েছে, রয়েছে পৃথক সম্পাদনা নীতি, দায়বদ্ধতা; কিন্তু সেখানেও প্রকাশিত নিয়ন্ত্রণহীনতা। জোয়ারে ভেসে যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা, কে কার আগে কীভাবে পাঠক ধরতে পারে সে প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। এর ফাঁকে যে শিশু নিপীড়ন হচ্ছে সে কথা কে বলবে তাদের, সে কথা কে শোনাবে তাদের!

নিপীড়ন মানে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন; এখানে সীমিত থাকতে চলবে না। ছোট্ট অবুঝ একটা শিশু সন্তানের ছবি প্রকাশ করে একটা ভবিষ্যৎ যে আমরা অনিশ্চিত করে দিচ্ছি সে চিন্তার সময় বোধহয় আমাদের কারো নেই। তাই শিশুর ছবি প্রকাশে বেপরোয়া বেশিরভাগই। সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে যখনই শাকিব খান ও শবনম বুবলির আড়াই বছরের শিশু সন্তানের মুখ ভাসছে তখন একটা করুণ ভবিষ্যতের ছবি সামনে আসছে। একটা মায়াবি মুখের ভবিষ্যৎ কীভাবে অনিশ্চিত হতে যাচ্ছে সে চিন্তাই করছি এখন।

শেহজাদ খান বীর, শাকিব-বুবলির সন্তান। আড়াই বছর পর দুজন সামাজিক মাধ্যমে পৃথক পোস্ট দিয়ে সে তথ্য জানিয়েছেন। এরআগে বুবলি তার বেবি বাম্পের ছবি প্রকাশের পর সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছিল এই সন্তানের বাবা শাকিব খান।

বিজ্ঞাপন

এরআগে, অপু বিশ্বাসের একটা পুত্র সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে অনেক জল ঘোলা করে স্বীকার করেছিলেন শাকিব। অপু কান্নাজড়িত কণ্ঠে লাইভে এসে তার সন্তানের কথা জানিয়েছিলেন। সে সময় সন্তানের বয়স ছিল ছয় বছর। বুবলিকে অবশ্য কেঁদে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হয়নি, জায়গায়-জায়গায় ধর্না দিতে হয়নি; তার আগেই মিলেছে পুত্রের স্বীকৃতি। এখানে শাকিব খান পুত্রের স্বীকৃতি দিতে গড়িমসি না করলেও তিনি যে সৎ বাবা, সৎ স্বামী, সর্বোপরি সৎ মানুষ নন সেটা বলাই বাহুল্য।

আব্রাহাম খান ও শেহজাদ খান পিতৃপরিচয় পেয়েছে। তবে তারা অন্যদের মতো কি স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে ওঠার পরিবেশ পাবে? এ সমাজ কি এটা মেনে নিতে প্রস্তুত? মনে হয় না। তারা যখন বড় হতে থাকবে, যখন তারা বুঝতে শুরু করবে তখন সমাজের অঙুলিগুলো তাদের দিকেই আসতে থাকবে। মায়ের চরিত্রহনন থেকে শুরু করে তাদের নিজেদের চরিত্র নিয়ে নানা কথা ভাসতে থাকবে সমাজে, এমনকি তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। অথচ এমন পরিস্থিতির জন্যে তারা মোটেও দায়ী নয়। অন্য সবার মতো পৃথিবীতে তারা নিজেদের ইচ্ছায় আসেনি। তবু তাদেরকে সইতে হবে সামাজিক এই একচোখা নীতির চাপ!

আমাদের দেশে ভিকটিম নারী ও শিশুর ছবি প্রকাশে আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। এটা যদিও সীমিত আকারে, আইনি প্রতিবিধানের পর্যায়ে। তবে সামগ্রিকভাবে শিশুর নিরাপত্তায় আইন ও আইনের প্রকাশ নাই দেশে। আজকের এই আব্রাহাম কিংবা শেহজাদ বুঝতে শেখার পর তাদেরকে নিয়ে বিগত-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যে ইঙ্গিতবহ সংবাদ ও কথাবার্তা তার প্রতিবিধান কীভাবে চাইবে আইনের কাছে? এই বয়সে তারা মানহানি বিষয়ে জানে না, কিন্তু যখন এটা জানবে-বুঝতে পারবে তখন এই মানহানির জন্যে, তাদের ছবি বিনা-অনুমতিতে প্রকাশের কারণে কি ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবে। অবশ্য শিশুরা যতক্ষণ শিশু ততক্ষণ তাদের নিজেদের নিয়েও সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা নাই, তাই অদ্যকার এই পরিস্থিতির প্রতিবিধান কীভাবে হবে?

আমাদের দেশে এ সংক্রান্ত আইন নেই। দ্য টেলিগ্রাফের একটা প্রতিবেদনে ফ্রান্সে এ সংক্রান্ত একটা আইন থাকার কথা জেনেছিলাম। ওই আইনের অধীনে শিশুর প্রাইভেসি লঙ্ঘনের দায়ে পিতা-মাতার এক বছর পর্যন্ত জেল এবং ৪৫ হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। কয়েক বছরের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্করা শিশুকালের তাদের ছবি প্রকাশের কারণে পিতামাতার বিরুদ্ধে মামলা করে ক্ষতিপূরণ দাবিও করতে পারে। দেশটিতে এই আইন থাকার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এসব শিশুর ছবি নানা অপরাধীদের কাছে চলে যেতে পারে, এবং অপরাধের কাজে সেগুলো ব্যবহৃত হতেও পারে।

পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন আইন আছে কি-না এখনই বলতে পারছি না। এটা মনে পড়েছে কেবল ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে গিয়ে চোখে পড়ায় এবং চলমান বাস্তবতার কারণে। কারণ ওই একই, শাকিব-বুবলির সন্তান শেহজাদ খান বীর, যা ছবি ভাইরাল সামাজিক মাধ্যমে। এই ছবি তার মা-বাবাও প্রকাশ করেছেন। তারা প্রকাশ করেছেন সন্তানের পিতৃত্বের দাবি ও স্বীকৃতি প্রসঙ্গে। তবে আমাদের নিয়ন্ত্রণহীন সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীদের কারণে এখানে পোডোফাইলের যে বিপদ সংকেত সেটা কীভাবে আগ্রাহ্য করি, যেখানে সংবাদমাধ্যমে প্রায়শই আসে নানা খবর। বলতে দ্বিধা নেই, এটা অনলাইনে যেমন আছে, তেমনি আছে অফলাইনেও। এছাড়া এই বিপদের সঙ্গে আছে শিশুর প্রাইভেসি, যা এখনই হয়তো সে অনুধাবন করতে পারছে না, কিন্তু যখন পারবে তখন কী মানসিক অবস্থা হবে তার; ভাবা যায়!

বিজ্ঞাপন

আমাদের সমাজ ভিকটিমকে দায় দিতে আগ্রহী। নিপীড়নের ওপর আরেকদফা নিপীড়ন। এই মানসিকতা সর্বক্ষেত্রে। সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীদের অনেকেই আবার এসবে যে ভাষায় প্রতিক্রিয়া দেখান তাতে অনেকের আবার লুঙ্গি খোলার অবস্থা! আক্রমণাত্মক সেই সব ব্যবহারকারীদের কারণে অনেক সময় নৈতিকতার পরাজয় দেখি আমরা। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিনোদন জগতের বাসিন্দাদের পারিবারিক সমস্যার এই প্রসঙ্গ আমাদেরকে অনলাইনে শিশু-নিরাপত্তার দিকটি নিয়ে গভীর ভাবনার দাবি রাখে।

এখানে কে দোষী, কে নির্দোষ সে তর্ক-বিতর্কে জড়ানোর উদ্দেশ্য নয়; উদ্দেশ্য একটাই শিশুর প্রাইভেসি-নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তা। এ সংক্রান্ত কোনো আইন থাকলে সে আইনের বহুল প্রচারের দাবি করি, আর আইন না থাকলে এনিয়ে ভাবার প্রয়োজনীয়তার কথাই বলি! এই একচোখা সমাজে আমরা শিশুর অনিশ্চিত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নয়, সার্বিক নিরাপত্তার দাবি করি।

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।