প্রথম পরীক্ষায় কেমন করল নির্বাচন কমিশন
অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জাতীয় সংসদের কোনো আসনের উপনির্বাচন মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়ার এমন সিদ্ধান্ত এই প্রথমবার ঘটল। আগে একাধিকবার একাধিক নির্বাচনে নানা অনিয়ম-সহিংসতার অভিযোগ উঠলেও বরাবরই সকল নির্বাচন কমিশন অনেকটা প্রতিকারহীন ভূমিকায় থাকলেও এবার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসি যে সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা অনুকরণীয়। আস্থাহীনতা ও আলোচনার মধ্য দিয়ে যাওয়া নির্বাচন কমিশনের এটা অর্জনই বলতে হবে।
ইসি তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ করার সাহস দেখাতে পেরেছে। এই ক্ষমতা সংবিধান তাদের দিলেও কেউ কখনও প্রয়োগের কথা ভাবেনি। এই কমিশন তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতার ব্যবহার করেছে।
গাইবান্ধার এই উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তাদের এই অবস্থান অভাবিত নয়, দলটি এই সময়ে বেশিরভাগ নির্বাচনই বর্জন করছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের বাইরে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি অংশ নিয়েছে, এছাড়া প্রার্থী ছিলেন আরও তিনজন, অর্থাৎ পাঁচজন প্রার্থী অংশ নিয়েছেন উপনির্বাচনে। ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়ার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন, জাতীয় পার্টির প্রার্থী এ এইচ এম গোলাম শহীদ রনজু (লাঙ্গল), বিকল্পধারা বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর আলম (কুলা), স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ (আপেল) ও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান (ট্রাক)। লাঙ্গলের কিছু ভোট ব্যতিরেকে এই আসনে শক্ত অবস্থানই ছিল আওয়ামী লীগের, এছাড়া উপনির্বাচনে সাধারণত ভোটাররা তাদের পছন্দের উপরের দিকে সরকার-দলের প্রার্থীকেই রেখে থাকেন। বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া ভোট হওয়ায় ছিল না উত্তাপ, তেমন আলোচনা; তবু এই উপনির্বাচনেও অনিয়মের আশ্রয় নিতে হলো ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও তার নেতাকর্মীকে!
৩ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮ জন ভোটারের এই আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ১৪৫ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হলে বেলা ১২টার দিকে প্রতিদ্বন্দ্বী চার প্রার্থী একযোগে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজে রাজধানীর আগারগাঁওস্থ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে বসে নির্বাচন পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রতি কেন্দ্র সিসিটিভির আওতায় ছিল। সিইসি নির্বাচন বন্ধের সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার কথা বলেছেন, ভোটকেন্দ্রে অনাহূতদের প্রবেশের কথা স্বীকার করেছেন, এবং সবশেষে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নির্বাচন স্থগিত করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথাও জানান।
নির্বাচনের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা অনেক নির্বাচনের কিছু কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিতের ইতিহাসই দেখি। কখনই পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেখিনি। ইসির সে ক্ষমতা থাকলেও সেটা কখনই প্রয়োগ করা হয়নি। গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম উপনির্বাচনেই এবার সেটা প্রয়োগ হয়েছে। ইসির এই সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন তাদের পেশাদারত্বের পরিচয় বহন করছে, অন্যদিকে এই কমিশনের নির্বাচন নিয়ে সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ইতিবাচক হওয়ার প্রেরণা যোগাচ্ছে। তবে কথা থাকে, একটা উপনির্বাচন নিয়ে ইসির যেখানে কিছু করে দেখানোর জায়গা আছে সেখানে একযোগে দেশের ৩০০ আসনের নির্বাচন নিয়ে সেটা করার কি ক্ষমতা আছে? ক্ষমতার প্রসঙ্গ এলে বলা যায়, আরপিও ইসিকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু ক্ষমতা প্রয়োগের সক্ষমতা নিয়েই আবার প্রশ্ন আছে!
নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচনের জন্যে সরকার কমিশনকে সহায়তা করতে বাধ্য। নির্বাচনের জন্যে সকল কিছুতে সরকার ইসিকে সহায়তা করেছে। নির্বাচনের সরঞ্জাম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সকল কিছু ছিল ইসির নিয়ন্ত্রণে, কেন্দ্রে-কেন্দ্রে টহল দিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্য দায়িত্বশীলরা। তবু ভোটকেন্দ্রে অনাহূতদের প্রবেশ ঘটেছে। তারা ভোটারদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করছে বলে সিইসি মনে করেছেন, প্রমাণ পেয়েছেন। মাঠপর্যায়ের প্রশাসন কি তবে ইসির কথা শোনেনি? ভোটগ্রহণের আগ পর্যন্ত এখানে মাঠপ্রশাসন ইসির কথামতো কাজ করলেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণের যে পরিবেশ সেটা নিয়ে সচেতন থাকেনি। সে সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। ভোটকেন্দ্রের বাইরের পরিবেশ শান্ত রাখার প্রাথমিক ও দৃশ্যমান কাজটুকু করলেও ভেতরের দায়িত্ব পালনে তাদের অবহেলা ছিল।
বাইরের পরিবেশ শান্ত, মারামারি নেই, জোরজবরদস্তি নেই; দেশবাসী জানত শান্তিপূর্ণভাবে হচ্ছে এই উপনির্বাচন। কিন্তু এখানে বাধ সেধেছে সিসিটিভি এবং রাজধানীতে বসে নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া। এই পর্যবেক্ষণ না হলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অভিযোগ সত্ত্বেও ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে এমন ঘোষণা দিতে পারত নির্বাচন কমিশন। তবে তারা নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানোর যে মিশনে নেমেছে সেখানে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টায় বেরিয়ে এসেছে ভেতরের দুরবস্থা। ইসিকে তাই ধন্যবাদ, তাদের পেশাগত সততার জন্যে; অন্তত এই উপনির্বাচনে।
গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করে দিয়ে ইসি দেশকে এই বার্তা দিতে চেয়েছে তারা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্যক অবগত এবং সাংবিধানিক ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতনও। উপনির্বাচন নিয়ে এই সিদ্ধান্ত ইসির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে, একইসঙ্গে সকল রাজনৈতিক দলকে ইসি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার বাইরে বেরিয়ে আসার কথাও বলছে।
এক আসনের উপনির্বাচন ও ৩০০ আসনের নির্বাচন নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় আগ্রহী এখনও যারা তারা যদি কেবল নেতিবাচক প্রচারণা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন তবে নির্বাচন কমিশন কখনই সফল হবে না। দলীয় সরকারের অধীনে হোক আর জাতীয় সরকার কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে কাঠামোর মধ্য দিয়েই আগামী নির্বাচন হোক না কেন নির্বাচন অনুষ্ঠানের মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আমাদের নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের যে সংস্কৃতি সেখানে কাজী হাবিবুল আউয়ালের এই কমিশন অন্য কিছু করে দেখিয়েছে। এটা তাদের অর্জন নিঃসন্দেহে।
স্রোতের বিপরীতে যেকোনো কিছু অসম্ভব না হলেও কঠিন বৈকি। কঠিন কাজের জন্যে দরকার শক্তি-সামর্থ্য। সাংবিধানিক ক্ষমতা ইসির শক্তি, কিন্তু সামর্থ্য প্রমাণে দরকার সকলের সহযোগিতা-সমর্থন। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না—এই রাজনৈতিক ধারণার বাইরে বের না হলে এই ইসি কেন কোনো ইসিই কোনোদিনও দেশে গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন করতে পারবে না।
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।