ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি

  • ড. মতিউর রহমান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এ বছর ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১১২ জন। ২০১৯ সালে মারা যায় ১৭৯ জন। এ বছর ৩০,০২৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ২০১৯ সালে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিলেন ১০১,৩৫৪ জন।

যদিও হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা এখনও ২০১৯ সালের তুলনায় কম, তবে প্রবণতাটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হন না। করোনা বা সাধারণ জ্বর মনে করে বাড়িতেই চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে যান। অবস্থা খারাপ হলেই হাসপাতালে ভর্তি হন। ফলে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। পরিসংখ্যান দেখায় এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও মৃত্যু সংখ্যা বেড়েছে।

বিজ্ঞাপন

ইতিমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক প্যাটার্ন লক্ষ্য করা গেছে। কিছু হাসপাতালের রিপোর্টে দেখা গেছে যে ৬৪ শতাংশ রোগী তাদের হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে মারা গেছে। চিকিৎসকরা বিশ্বাস করেন, এই রোগের প্রতি জনসাধারণের বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া এত বেশি হাসপাতালে ভর্তি পরবর্তী মৃত্যুর হারের কারণ হতে পারে। ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যদি আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তাহলে মৃতের সংখ্যা কম হতো বলে তারা মনে করেন।

আরেকটি দিক, যা কম উদ্বেগজনক এবং কৌতূহলজনক নয়, তাহ'ল হাসপাতালে যারা মারা গেছেন তাদের লিঙ্গ পক্ষপাত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক ব্রিফিংয়ে দেখা গেছে, ডেঙ্গুজনিত কারণে নারীদের মৃত্যুহার পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণ। ঘটনাটি ব্যাখ্যা করার জন্য, কেউ কেউ নারীদের অসুস্থতার প্রতি সমাজের অবহেলাজনিত মনোভাবের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এর ফলে তাদের দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ফলস্বরূপ মৃত্যু হয়। এই বিষয়ে আরও অনুসন্ধান এবং সংশ্লিষ্ট সকলের যথাযথ মনোযোগ দাবি করে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিদিন ঢাকা মহানগরীর ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের তথ্য অনুযায়ী, একমাত্র পঙ্গু হাসপাতাল ছাড়া সব হাসপাতালেই ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ঢাকার বাইরে যেসব জেলায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি তার মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার, যশোর ও পাবনা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী এ বছর দেশের ১০টি জেলা ছাড়া সব জেলায়ই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, দেশের সব শহরেই ডেঙ্গু বহনকারী এডিস মশা রয়েছে। সারাদেশের সব শহর ও উপজেলায় মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নেই। অনেক জেলায় মশা নিয়ন্ত্রণে জনবল, যন্ত্রপাতি ও কীটনাশকের অভাব রয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন কী করছে তা নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে।

এটি সুস্পষ্ট যে এডিস ইজিপ্টি নামে পরিচিত মশার প্রজনন ক্ষেত্র সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হল, এই রোগের প্রকোপ এখন আর বর্ষাকাল এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বছরই কম বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সুতরাং ডেঙ্গু নির্মূল অভিযান সারা বছরই অব্যাহত রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে।

বর্তমানে মশা নিধন অভিযান সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার অন্যতম দায়িত্ব। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে, এমন একটি সংস্থা গঠন করা দরকার যার কাজ হবে সারা বছর ধরে এডিস মশা এবং তাদের লার্ভা মারা।

সুতরাং, ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি স্বাধীন ও নিবেদিত সংস্থা গঠনের পাশাপাশি, মশা নির্মূল করার পদ্ধতিগুলি এবং রাসায়নিক এজেন্টগুলির ধরণ এবং গুণমানগুলি আরও পরীক্ষা করাও গুরুত্বপূর্ণ। শুধু কীটনাশক ছিটানো ছাড়া এডিস মশা মারার জন্য বাজারের অন্যান্য পদ্ধতির দিকেও নজর দিতে হবে। এই বিষয়ে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যেতে পারে এবং, যদি দরকারি হয় তার অনুকরণ করা যেতে পারে।

এর পাশাপাশি কীটতত্ত্ববিদরা একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার কথাও বলছেন। এই সংস্থার কাজ হবে মশা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ নিয়ে গবেষণা করা, মাঠ পর্যায়ে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। ২০১৭ সালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কে কৃষ্ণমূর্তি বাংলাদেশ সরকারকে এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি অন্তর্বর্তী পরিকল্পনা দেন। পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল। এক একটি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা ও দায়িত্বও সংক্ষেপে বলা হয়েছে।

এ পরিকল্পনায় কোনো কাজ হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার অনেক কাজের মধ্যে একটি হচ্ছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া মোকাবিলায় কৌশল প্রনয়ণ করা। তবে ডেঙ্গুর বিষয়ে এমন কোনো কৌশল নেই।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো জাতীয় কৌশল বা পরিকল্পনা নেই। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় গুরুত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদের নয় বলে তারা মনে করেন। এমন বাস্তবতায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি সমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সম্পৃক্ত করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

ডেঙ্গু বহনকারী মশা জনস্বাস্থ্যের জন্য যে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকারসহ সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে দায়িত্ব নিতে হবে। একটি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে ডেঙ্গু সমস্যার সমাধান জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী