রাস্তার খাবারে স্বাস্থ্যবিধিসম্মত মান নিশ্চিত করতে হবে
রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরের ফুটপাত, পার্ক, রেল-বাস স্টেশন এবং জনাকীর্ণ এলাকায় অনেক খাবারের দোকান দেখা যায়। ফুটপাতে বিভিন্ন রকমের লোভনীয় খাবার পথচারীদের আকৃষ্ট করে। গরমের সময় বিভিন্ন ধরনের শরবত বিক্রির প্রচলন বেশি। পথচারী এবং শিশুরা মাঝে মাঝে তাদের ক্ষুধা ও তৃষ্ণা মেটাতে কম দামে রাস্তার খাবার কিনে খায়। শিশু থেকে বয়স্ক সব বয়সি মানুষ এই খাবার পছন্দ করে। তবে , এই খাবারগুলো বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এই খাবারগুলো কোথায় এবং কীভাবে তৈরি হয়, তার খোঁজখবর সাধারণত কেউ রাখে না।
শীত এলেই রাস্তায় তৈরি খাবারের ধরন বদলে যায়। এসময় রাস্তায় বিভিন্ন পিঠা তৈরি ও বিক্রি করা হয়। এসব পিঠার মধ্যে ভাপা পিঠা, পোয়া পিঠা ও চিতই পিঠা উল্লেখযোগ্য। চিতই পিঠার সঙ্গে থাকে বিভিন্ন ঝাল চাটনি, আখের বা খেজুরের গুড় বা পাটালি। খেতে সুস্বাদু হলেও নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেও এসব খাবার তৈরি করা হয়। যারা পিঠা তৈরি করে পরিবেশন করে, তাদের কাপড় ও হাত থাকে অপরিচ্ছন্ন। বিক্রেতারা যে হাতে টাকা আদান প্রদান করে সেই হাতেই পিঠা তৈরি করে পরিবেশন করে। এই পিঠা জীবাণু দ্বারা দূষিত হয়।
রাস্তার খাবারের দোকানগুলো সাধারণত খোলা বাতাসে থাকে। এসব খাবার পোকামাকড়, মাছি দ্বারা দূষিত হয়। রাস্তার খাবার জনপ্রিয় কারণ এটি সাধারণত সস্তা, চর্বিযুক্ত এবং নোনতা। এ ধরনের খাবার খেলে মানুষ যে সব রোগে আক্রান্ত হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, আলসার, হৃদরোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সড়ক ও ফুটপাতে দিন দিন এই ধরনের খাবারের দোকান বাড়ছে। এসব দোকানের খাবারকে সাধারণত স্ট্রিট ফুড বলা হয়। সহজলভ্য এবং সস্তা হওয়ায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এসব খাবার। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণার পর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশিরভাগ রাস্তার খাবারে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থাকে। বিভিন্ন ধরনের উপর নির্ভর করে, এই খাবারগুলোতে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ভয়ঙ্কর ব্যাকটেরিয়া থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয় এবং প্রায় ৪৫০,০০০ মানুষ মারা যায়। এছাড়াও, ৫ বছরের কম বয়সি ৪৩ শতাংশ শিশু অনিরাপদ খাদ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রতি বছর ১২৫,০০০ শিশু মারা যায়।
আমাদের দেশে ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের খাদ্যে রাসায়নিক দূষণ ও জীবাণু সংক্রমণের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ রাস্তার খাবারে ই-কোলাই, সালমোনেলা এবং ইস্ট মোল্ডের মতো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।
গত বছর (২০২১) জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের খাদ্য নিরাপত্তা জরিপের দ্বিতীয় পর্যায়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নগরীর ফুচকা ও ঝালমুড়ির ৯০ শতাংশে টাইফয়েডের জীবাণু রয়েছে। ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ভেলপুরি, ফুচকা এবং ঝালমুড়িতে কলেরা ব্যাকটেরিয়া ই.কোলাই পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পাঁচটি ভেলপুরি এবং তিনটি ঝালমুড়ির নমুনায় টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়া সালমোনেলা পাওয়া গেছে, এছাড়া ফুচকার ৩০টি নমুনায় ব্যাকটেরিয়া, ভেলপুরির ১২টি নমুনার ৭৫ শতাংশ, ঝালমুড়ির ১৩টি এবং আচারের চারটি নমুনায় ইস্টের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর ৪৬টি থানায় অবস্থিত বিদ্যালয়ের সামনে থেকে ৪৬টি ঝালমুড়ি, ৩০টি ফুচকা, ১৬টি ভেলপুরি ও ৪২টি আচারের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত নমুনাগুলোর মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষা খামির এবং ছাঁচ, কলিফর্ম, সালমোনেলা, ই-কোলাই উপস্থিতির জন্য করা হয়। এতে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ভেলপুরি, ফুচকা ও ঝালমুড়িতে ই-কোলাই পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকায় ১৪০ ধরনের স্ট্রিট ফুড পাওয়া যায়। যা শহরের ৭০ শতাংশ মানুষ খায়। এই সব খাবারেই প্রাণীর মলের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। এই ব্যাকটেরিয়া প্রধানত পানি থেকে খাদ্যে প্রবেশ করে। আর খাবার থেকে মানুষের পেটে প্রবেশ করে। এই খাবারগুলো তৈরি করা থেকে খাওয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটাই অস্বাস্থ্যকর। এসব খাবার খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে।
তারা আরও বলেন, বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ খাদ্য খুবই জরুরি। খাদ্য ও স্বাস্থ্য একে অপরের পরিপূরক। টেকসই জীবনযাপন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। অনিরাপদ খাদ্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম। অনিরাপদ খাদ্য অনেক জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী রোগের জন্য দায়ী।
যদিও বিশেষজ্ঞরা এসব খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দেন তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাস্তার খাবার যারা তৈরি ও বিক্রি করেন তাদের সংখ্যাটিও কম নয়। ঢাকাসহ সারাদেশে লাখ লাখ দরিদ্র নারী, পুরুষ ও শিশু এইসব খাবার দোকান চালিয়ে জীবন-জীবীকা নির্বাহ করেন। সেদিকটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার।
সুতরাং উভয় দিক বিবেচনা করে রাস্তায় বিক্রি করা খাবারের স্বাস্থ্যসম্মত উপায় ও মান নিশ্চিতকরণে সরকারিভাবে একটি ‘রাস্তার খাবারের স্বাস্থ্যবিধিসম্মত ও গুণগতমান নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ’ গঠন করা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ করে ও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় রাস্তার খাবারের স্বাস্থ্যবিধিসম্মত মান মনিটরিং ও তদারকি করতে হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও বিধি তৈরি করতে হবে।
বিশ্বের সবদেশেই রাস্তায় খাবার বিক্রি হয়। তবে তা যথেষ্ট মানসম্মত। উন্নত দেশগুলো এদিক দিয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। আমাদের দেশে দিন দিন মানুষের গতিশীলতা বাড়ছে। শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিদিন ৬০ লাখ মানুষ বাইরে থেকে আসা যাওয়া করে। তাদের বড় একটি অংশ রাস্তার খাবার খেয়ে থাকে।
এছাড়াও ঢাকায় যারা বসবাস করেন তাদেরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছুটি বা অন্য কোনো দিনে পরিবার ও বাচ্চাসহ রাস্তায় তৈরি খাবার খেয়ে থাকে। যাদের অনেকেই পেটের অসুখসহ নানাবিধ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। ফলে রাস্তার খাবার জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। কাজেই রাস্তার খাবারে স্বাস্থ্যবিধিসম্মত মান নিশ্চিত করতে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
লেথক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।