‘বাস্কেট কেস’ থেকে উন্নয়নের সেরা গল্প!

  • কবির য়াহমদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

হেনরি কিসিঞ্জার নামে এক মার্কিনীর পরিচয় যতটা জানে মানুষ তার চেয়ে বেশি জানে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার মূল্যায়ন, একটা মন্তব্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছিল তখন সেই মার্কিনী বাংলাদেশকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। হেনরি কিসিঞ্জারের মন্তব্যের সেই বাংলাদেশ এখন নেই, কিন্তু তার সেই মন্তব্য আছে। এই মন্তব্যের রাজনৈতিক প্রচারণাও আছে। এই প্রচারণা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চালানো হয়। বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ হিসেবে দেখার সেই প্রচারণায় গা ভাসিয়েছিল তৎকালীন মার্কিন কিছু গণমাধ্যম। বাংলাদেশ নিয়ে আশা নাই, এমনই ছিল ইঙ্গিত।

‘বাস্কেট কেস’ শব্দযুগল ব্যবহার কেবল বাংলাদেশকে নিয়েই হয়েছে এমন না। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে এই শব্দদ্বয়ের ব্যবহার হয়েছিল। প্রথমবার পা হারানো আহত সৈনিকদের ক্ষেত্রে, যারা অপরের সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতে পারত না। দ্বিতীয়বার এর ব্যবহার হয় আরও বিস্তৃতভাবে, তখন কেবল আহত সৈন্যরাই নয় ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বলা শুরু হয় ‘বাস্কেট কেস’। ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান হয়ে এর ব্যবহার হয় ১৯৭১ সালের সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিই কেবল এমন নয়, তৎকালে প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের একাধিক নিবন্ধেও বাংলাদেশ ছিল ‘বাস্কেট কেস’। বদলেছে সেই দিন। এখন কেবল পশ্চিমা নেতারাই নয় পশ্চিমা মিডিয়াও বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক যুগ আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে লিখেছিল ‘বাংলাদেশ, ‘বাস্কেট কেস’ নো মোর’।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (২১ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনদিনের সফরে ঢাকা এসেছেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন) এক্সেল ভন টর্টসেনবার্গ। অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন। বিশ্বব্যাংকের এমডি বলেছেন, ‘গত পাঁচ দশকে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে অন্যতম দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ হলো উন্নয়নের সেরা গল্প।’ নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র দূরীকরণ ও করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্যের প্রশংসা করেছেন বিশ্বব্যাংকের দ্বিতীয় প্রধান এই কর্মকর্তা।

বিশ্বব্যাংকের এমডি যখন বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের সেরা গল্প’ হিসেবে আখ্যা দিলেন তখন আমাদের মনে পড়ে এক যুগ আগে এই বিশ্বব্যাংকই বাংলাদেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু থেকে তাদের প্রতিশ্রুত অর্থায়ন ফিরিয়ে নিয়েছিল। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংকের সদর দফতর ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বৈশ্বিক সংস্থাটি পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় অভিযোগে তাদের প্রতিশ্রুত ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বব্যাংকের সেই অভিযোগ পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সেই ঋণ বাতিল করার পর বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সাহস দেখিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিলের পর থেমে থাকেনি বাংলাদেশ, একের পর এক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মেট্রোরেল, পাতাল রেল, কর্ণফুলী টানেলসহ আরও অনেক মেগা প্রকল্প বাংলাদেশের আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ হয়ে রয়েছে। এখন তাই ওয়াশিংটন থেকে বিবৃতি দিয়ে ঋণ বাতিল করা নয়, ঢাকায় এসে বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ঘোষণাও দিতে হচ্ছে বিশ্বব্যাংকে।

ঋণ কারা পায়? উত্তর খুব সহজ যাদের পরিশোধের ক্ষমতা রয়েছে। এডিবি, বিশ্বব্যাংক, জাইকাসহ বৈশ্বিক উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য সম্পর্কে নিঃসন্দেহ বলে তারা বাংলাদেশকে ঋণ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। অথচ এই দেশের আর্থিক সামর্থ্য নিয়ে কদিন আগেও না কত ধরনের সংশয়-শঙ্কার হাওয়া বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাচ্ছে, বৈদেশিক রিজার্ভ আশঙ্কাজনক অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে, ব্যাংকে টাকা পাচ্ছে না মানুষ; এমন অগণন গুজবে গা ভাসাচ্ছিল মানুষ। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির সেই সব গুজব শেষ পর্যন্ত মিথ্যা বলে প্রমাণের পথে। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যায়নি, ব্যাংকে গিয়ে টাকা না পেয়ে ফিরে আসছে না মানুষ; ওসব ছিল রাজনৈতিক অপপ্রচার। ওসব যদি সত্য হতো তবে এডিবি, বিশ্বব্যাংক, জাইকাসহ কোন উন্নয়ন সহযোগী বাংলাদেশে অর্থায়ন করতে সাহস করত না।

বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট, বাস্কেট কেস যারা বলত সেই পশ্চিমারা এখন এই বাংলাদেশকে দেখছে উন্নয়নের সেরা গল্প হিসেবে। অর্থনৈতিক সামর্থ্যের প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টাতে পেরেছে বাংলাদেশ। এটা আমাদের অর্জন। বাংলাদেশের লক্ষ্য ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা। লক্ষ্য কঠিন, তবে বাংলাদেশ যে গতিতে এগুচ্ছে তাতে আশাবাদী হওয়াই যায়!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক